ক্ষমা পাওয়ার পূর্বশর্ত তওবা
কল্পনা করুন, এলাকায় আপনি খুব বেশি ক্ষমতাবান ব্যক্তি। এলাকার সর্বোচ্চ প্রভাবশালী বাবার আদরের সন্তান আপনি। যাকে আলালের ঘরের দুলাল বলা হয়। কিন্ত আপনার এই ক্ষমতা আপনাকে কুপথে পরিচালিত করছে। আপনি প্রতিনিয়তই অসহায় মানুষের প্রতি অন্যায় করে চলেছেন। গলির মোড়ের দোকান থেকে প্রতিদিন আপনার সাঙ্গ-পাঙ্গসহ চা-বিস্কুট, পান-সিগারেট খেয়ে টাকা মন চাইলো তো দিচ্ছেন, আবার মন চাচ্ছে নাতো দিচ্ছেন না। এটা যে আপনি অন্যায় করছেন, সেটা আপনিও জানেন, দোকানিও জানেন। ক্ষমতার জোরে আপনি সেটা গায়ে মাখছেন না বা ভাবছেন পাপ হচ্ছে না, অন্যদিকে ভয়ে দোকানি আপনাকে কিছু বলতে পারছেন না। এলাকার মসজিদের নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ইমাম সাহেব রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আপনার সাঙ্গ-পাঙ্গসহ ইমাম সাহেবের যা ছিল তা কেড়ে নিলেন। উনি অসহায়ের মতো একবার আপনার দিকে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে চলে গেলেন। এটাও যে অন্যায় সেটা আপনিও জানেন আবার ইমাম সাহেবও। কিন্তু ক্ষমতার জোরে আপনি গায়ে মাখছেন না বা ভাবছেন পাপ হচ্ছে না, আর ভয়ে ইমাম সাহেবও কিছু বলছেন না। এভাবে নানান উপায়ে আপনি বিভিন্ন জনের ক্ষতি করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। আপনি যে আপনার এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব করছেন সেটা এলাকার কমবেশি সবাই মোটামুটি জানে, কিন্তু ভয়ে কেউ কিছু বলছে না। এদিকে আপনার খোছ পরোয়া নেহি, আপনি আছেন আপনার তালে।
এভাবেই চলছে জীবন। হঠাৎ এমন একদিন আসলো, যেদিন আল্লাহ কোনো এক উছিলায় আপনাকে হিদায়াত দান করলেন। আপনার মধ্যকার ফিতরত উদয় হলো, আপনার ভেতরে নৈতিকতা বীজ বুনলো, আপনি বুঝতে পারলেন এতোদিন যা করে এসেছেন তা পাপ, মহা পাপ। বুঝতে পেরেছেন আপনি মহা ভুলের মধ্যে ছিলেন এতোদিন। আপনি সুপথে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। আল্লাহ প্রদত্ত এবং রাসূল (সা.) এর নির্দেশিত পথে নিজের জীবন পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
যেই ভাবা সেই কাজ, আপনি সর্বপ্রথম গেলেন গলির মোড়ের দোকানির কাছে। গিয়ে তার কাছ থেকে ক্ষমা চাইলেন। ওয়াল্লাহি খুশিতে ছলছল নয়নে তিনি আপনাকে ক্ষমা করে দিবেন বিনা শর্তে, পূর্বের কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই। এভাবে ইমাম সাহেব থেকে শুরু করে এলাকার যত মানুষের আপনি ক্ষতি করেছেন, তাঁদের কাছে ক্ষমা চাইলেই বিনা ক্ষতিপূরণেই আপনাকে ক্ষমা করে দিবেন, তাতে কোনো ভুল নেই। বরং এই ভেবে সবাই হাল ছেড়ে বাঁচবেন যে, আজকে থেকে কেউ আর অত্যাচারের স্বীকার হবেন না।
এবার আপনার মনে ভাবনার উদয় হলো আমার এতো এতো পাপের পর আল্লাহ তায়ালা কি আমাকে ক্ষমা করবেন? আরশের সুশীতল ছায়াতলে কি অদৌ আমার আশ্রয় হবে? তবে এবার আপনাকেই বলছি, একটু চিন্তা করুন তো, যে মানুষকে মহান আল্লাহ তাঁর রহমতের বিশাল ভান্ডার থেকে ন্যানো অনু পরিমাণ রহমত দান করেছেন, সেই মানুষই আপনাকে বিনা শর্তে ক্ষমা করে দিলেন তাদের ক্ষতি করার পরও। তাহলে আপনি আল্লাহ তায়ালার কোনো ক্ষতি না করে (এতোদিন যা করেছেন সব নিজেরই ক্ষতি করেছেন) রহমতের ভান্ডার, রাহমানুর রহীম আল্লাহ কেন আপনাকে ক্ষমা করবেন না? বরং আল্লাহ খুশি হবেন, মহা খুশি। আপনি কি জানেন যে, আমরা যখন তওবা করে আল্লাহর কাছে ফিরে আসি তখন আল্লাহ এই ব্যক্তির চেয়ে বেশি খুশি হন, যে মরুভূমিতে তার উট হারিয়ে আবার তা খুঁজে পায়!
আপনাকে উদ্দেশ্যে করেই মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেছেন, ‘অতঃপর যে তওবা করে স্বীয় অত্যাচারের পর এবং সংশোধিত হয়, নিশ্চয় আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। (সূরা মায়িদা- ৫:৩৯)। অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘অনন্তর যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে, অত:পর তওবা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয়, আপনার পালনকর্তা এসবের পরে তাদের জন্যে অবশ্যই ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সূরা নাহল- ১৬:১১৯)। ‘অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে, অত:পর অনতিবিলম্বে তওবা করে; এরাই হল সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান। (সূরা নিসা- ৪ : ১৭)।
আপনি যখন কোনো পরম আত্মীয় বা আপনজনের ঘরে অনেক দিন যান না বা ভুলে যান। তখন কোথাও আচমকা আপনার সাথে দেখা হলে তিনি আবদার খাটিয়ে বলেন- ‘কিরে কি হলো তোমার? আজকাল বাড়িতে যাওনা, ফোন-টোনও দাওনা, ঘটনা কি? ভুলে গেলে নাকি আমাদের?’ ঠিক তেমনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা যিনি আপনাকে পরম যতেœ আশরাফুল মাখলুখাত বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, ঈমানদারদের অভিভাবক মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করেন- ‘তারা আল্লাহর কাছে তওবা করে না কেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে না কেন? আল্লাহ যে ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সূরা মায়িদাহ- ৫:৭৪)। ‘তারা কি একথা জানতে পারেনি যে, আল্লাহ নিজেই স্বীয় বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং যাকাত গ্রহণ করেন? বস্তুতঃ আল্লাহই তওবা কবুলকারী, করুণাময়।’ (সূরা তওবা- ৯:১০৪)।
এছাড়া তওবার ব্যাপারে হাদিসেও বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে- আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি মরুভূমিতে তার পানীয় ও খাদ্য বহনকারী উটকে হারিয়ে ফেলার পর আবার তা ফিরে পেলে যতটা খুশি হয়, আল্লাহ তার চেয়ে বেশি খুশি হন যখন কোনো বান্দা তওবা করে তাঁর নিকট ফিরে আসে। (সহিহ মুসলিম- ২৭৪৭)। একই হাদিসে নবী কারীম (সা.) বলেছেন, ‘মরুভূমিতে হারানো উট ফিরে পাওয়ার পর, উটের লাগাম ধরে খুশির উচ্ছ্বাসে সে বলে উঠল, ‘আল্লাহ তুমি আমার বান্দা আমি তোমার রব’। চরম আনন্দের কারণে সে ভুল করে এ কথা বলে ফেলল।’ (সহীহ মুসলিম- ২৭৪৭)। তবে মহান আল্লাহ তায়ালার এসব ঘোষণার পরও যারা ফিরে আসবে না, তাদের জন্য আখিরাতে রয়েছে অত্যন্ত যন্ত্রণাময় এবং কঠিনতর আজাব।
আমাদের সমাজে আজকাল একটি বিষয় প্রচলিত আছে, তা হলো- মৃত্যুর পূর্বক্ষণে মওলানা ডেকে তওবা পড়ানো। যারা এইসব কাজ করে সেইসব কাঠমোল্লা বা ভন্ড আলেমদের প্রতি ধিক্কার। তারা কি মহান আল্লাহ পাকের এই ঘোষণাকে অস্বীকার করে? ‘আর এমন লোকদের জন্য কোনো ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমন কি যখন তাদের কারো মাথার উপর মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকে, আমি এখন তওবা করছি। আর তওবা নেই তাদের জন্য, যারা কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। আমি তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি। (সূরা নিসা- ৪:১৮)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘যদি সারা পৃথিবী পরিমাণ স্বর্ণও তার পরিবর্তে দেয়া হয়, তবুও যারা কাফের হয়েছে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে তাদের তওবা কবুল করা হবে না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব! পক্ষান্তরে তাদের কোনই সাহায্যকারী নেই।’ (সূরা আলে ইমরান- ৩:৯১)।
আমরা কিসের জন্য অপেক্ষা করছি? আসুন আমরা ইতিপূর্বে যা-ই করে থাকি না কেন আল্লাহর রাস্তায় ফিরে আসি, রাসূল (সা.) এর দেখানো পন্থায়। আসুন ভীত না হয়ে আল্লাহর রহমতের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর দরবারে অশ্রুবর্ষণ করে আমরা তওবা করি। যদিও আল্লাহর কাছে আমাদের এই পাপ-পঙ্কিলতাময় জীবন অতিবাহিত করার অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। তবুও বান্দা যখন আল্লাহর কাছে ফিরে আসে তখন আল্লাহ অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন এবং তাঁর রহমত বিশাল ও অন্তহীন এবং এই অভিজ্ঞতাটি খুবই মিষ্ট। আপনি কি করেছেন বা কীভাবে আপনার জীবন অতিবাহিত করেছেন তা বিবেচনা না করেই আল্লাহর রহমতের দ্বার সর্বদা আপনার জন্য খোলা থাকে।
আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ বলেন, বনী আদম! তুমি যতক্ষণ আমাকে ডাকতে থাকবে, আমার কাছে (ক্ষমার) আশা করতে থাকবে, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব; কোনো পরোয়া করব না। বনী আদম! তোমার পাপরাশি যদি মেঘমালা পর্যন্ত পৌঁছে যায়, অতঃপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি ক্ষমা করে দিব; কোনো পরোয়া করব না। বনী আদম! তুমি যদি পৃথিবী-ভর্তি পাপ নিয়ে আমার কাছে আসো এবং শিরক থেকে মুক্ত হয়ে আমার সাথে সাক্ষাৎ করো, তবে আমি পৃথিবী-ভর্তি ক্ষমা নিয়ে তোমার সাথে সাক্ষাৎ করবো।’ (তিরমিযী- ৩৫৪০)। আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং সঠিক পথে নিজেকে পরিচালিত করার তৌফিক দান করুন। আমীন।