পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন আছে কি, এটি বাতিলের সুপারিশ কতটা বাস্তবসম্মত?
১৯২০-এর দশকে ব্রিটিশ আমলে পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রথা শুরু হয়েছিল। সাধারণত চাকরি, পাসপোর্ট, লাইসেন্স এবং গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আবেদনকারীর তথ্য যাচাইয়ের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে প্রার্থীর চারিত্রিক ও সামাজিক অবস্থানও যাচাই করা হয়। তখন এ প্রথার মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দমন করতে চাকরিপ্রার্থীদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাই করা। কারণ সে সময় ভারতবর্ষে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা নানা গুপ্ত বা প্রকাশ্য হামলার শিকার হতেন।
তখন তারা চাকরির নিয়োগে ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ চালু করেছিলেন যাতে নিশ্চিত হওয়া যায়- প্রার্থীর কোনো ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক বিশ্বাস নেই। এটি বর্তমানে বিরোধী মতধারাকে দমন, বৈষম্য ও হয়রানির হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি পুলিশ সংস্কার কমিশন গত ১৯ নভেম্বর এক সুপারিশে জানিয়েছে, চাকরি ও পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাই বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন বলেছেন, ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি ও দুর্নীতি বন্ধ করা জরুরি। প্রার্থীর বা তার পরিবারের রাজনৈতিক পরিচিতি বিচার করা অযৌক্তিক। ভেরিফিকেশন পদ্ধতি এখন একটি বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে এবং এটি প্রার্থীদের জন্য বড় ধরনের হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা ভেরিফিকেশন পুরোপুরি তুলে দেওয়ার প্রস্তাবকে অযৌক্তিক মনে করেছেন। পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতির বিরুদ্ধে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন সাবেক সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান। তিনি স্থানীয়ভাবে চরিত্র সনদ সংগ্রহ করার কথা বলেছেন।
পুলিশ ভেরিফিকেশনে কোন কোন তথ্য যাচাই হয়
পুলিশ গোপনে বা প্রকাশ্যে প্রার্থীর উল্লিখিত ঠিকানায় সরজমিন তদন্ত করে থাকে। পুলিশের তথ্য অনুসারে, ভেরিফিকেশনের সময় ২১টি বিষয় যাচাই করা হয়।এরমধ্যে রয়েছে প্রার্থী ও তার বাবার পুরো নাম, জাতীয়তা, স্থায়ী ও অস্থায়ী ঠিকানা, বৈবাহিক অবস্থা, জন্ম তারিখ/জন্মস্থান, যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলেন, পূর্বের চাকরি।
সেইসাথে প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধার ছেলে/মেয়ে/নাতি/নাতনি কি না, অন্য কোনো কোটাধারী কি না, কোনো ধরনের প্রতিবন্ধীতা আছে কি না? নিকট আত্মীয়-স্বজন বাংলাদেশ সরকারের কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে চাকুরিরত থাকলে সেগুলোর তথ্য।
প্রার্থী কোনো মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বা নৈতিক স্খলনের রেকর্ড রয়েছে কি না, ইতোপূর্বে কোনো সরকারি চাকুরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন কি না, রাষ্ট্রদ্রোহী বা নাশকতামূলক কার্যকলাপে জড়িত আছেন/ছিলেন কি না, তিনি কোনো মামলায় অভিযুক্ত, গ্রেফতার, বা দণ্ডিত এবং নজরবন্দি কি না-এসবও দেখা হয়ে থাকে ভেরিফিকেশনে।
সেইসাথে প্রার্থীর চারিত্রিক ও সামাজিক অবস্থানও যাচাই করা হয় ভেরিফিকেশনে।
পুলিশ ভেরিফিকেশনের অংশ হিসেবে স্থায়ী ঠিকানা যাচাই করতে গিয়ে অনেকের সরকারি চাকরির নিয়োগ আটকে যাওয়ার যেমন অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে তেমনি অনেকে পাসপোর্ট ভেরিফাই করতে গিয়ে নানা ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন।
ঢাকার বাসিন্দা সুমাইয়া জাহিদ পাসপোর্টের আবেদনে তার স্থায়ী ঠিকানা ছিল ঢাকার বাইরে আরেক জেলায়।
পুলিশ ভেরিফিকশনে তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের কাউকে না পেয়ে এই ঠিকানার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। নানা হয়রানির পর এক পর্যায়ে মোটা অংকের টাকা ঘুস দিয়ে বিষয়টি সুরাহা করেছেন মিজ জাহিদ।
অনেকেই বলছেন, পাসপোর্টের জন্য ভেরিফিকেশন করতে গেলে পুলিশকে পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা দেওয়া একটা অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ কাগজে কলমে এ ধরনের টাকা দেওয়ার কোনো বিধান নেই।
আবেদনকারীর তথ্যের সচ্ছতা নিশ্চিত করতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে নানা ধরনের ভোগান্তি, পক্ষপাতমূলক আচরণ ও ঘুস নেওয়ার অভিযোগ এই পদ্ধতিকে কলুষিত করেছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
তবে পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতি পুরোপুরি বন্ধ করার সুপারিশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
অনেকেই যেমন মনে করছেন, এই প্রথা হয়রানি ও দুর্নীতি বন্ধ করবে আবার ভেরিফিকেশন সম্পূর্ণ বন্ধ করলে তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাবে না, যা নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে বলেও মত আছে।
কমিশন যা বলছে
গত ১৯ নভেম্বর পুলিশ সংস্কার কমিশন চাকরি ও পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাই বন্ধ করার সুপারিশ করবে বলে জানিয়েছে।
কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন বলেছেন, ‘ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি ও দুর্নীতি বন্ধ হওয়া জরুরি। প্রার্থীর বা তার পরিবারের রাজনৈতিক পরিচিতি বিচার করা অযৌক্তিক।’
সবশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতি পুরোপুরি তুলে দেওয়ার সুপারিশের কথা জানিয়েছে।
কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সুপারিশ করেছি চাকরি কিংবা অন্য যেকোনো সেবার ক্ষেত্রে পুলিশের ভেরিফিকেশন আর বাধ্যতামূলক থাকছে না। এটি কোথাও আর থাকবে না।’
এ সুপারিশের কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘নাগরিক হিসেবে পাসপোর্ট পাওয়া সবার অধিকার। উন্নত দেশে যেমন পাসপোর্ট পোস্টের মাধ্যমে সরাসরি আবেদনকারীর ঠিকানায় পৌঁছে যায়। এখানেও তাই করতে হবে।’
ভেরিফিকেশন প্রয়োজন আছে
তবে পুলিশ ভেরিফিকেশন পুরোপুরি তুলে দেওয়ার সুপারিশ অযৌক্তিক বলে মত দিয়েছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা। তার মতে, নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য এর প্রয়োজন আছে।
তিনি বলেন, ‘আপনি যাকে প্রজাতন্ত্রের চাকরি দেবেন বা যাকে পাসপোর্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ নথি দেবেন তার ব্যাকগ্রাউন্ড জানা ভীষণ জরুরি। এক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। এটি তুলে দেওয়া কোনো চিন্তাপ্রসূত সুপারিশ বলে আমি মনে করি না। কারণ কোনো অধিকার নিরঙ্কুশ না। আপনি ভালো হওয়া স্বাপেক্ষে অধিকার পাবেন।’
ভেরিফিকেশনের নামে আবেদনকারীদের সাথে যে হয়রানি হচ্ছে, দুর্নীতি হচ্ছে এবং দীর্ঘ সময় পাসপোর্ট প্রাপ্তি বা নিয়োগ ঝুলে আছে এই সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা যায় সেদিকে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
হুদা বলেন, ‘সমস্যা হলো এখানে দুর্নীতি ঢুকে গেছে, হয়রানি হচ্ছে, প্রক্রিয়া ধীর হয়ে গিয়েছে। এটা প্রশাসন বা রাজনৈতিক পর্যায়ের গলদ, সিস্টেমের গলদ না। এখন মাথা ব্যথা থাকলে মাথা তো কেটে ফেলা তো সমাধান না।’
নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ভ্যারিফিকেশন সম্পন্ন করতে পারলে এবং দুর্নীতির ব্যাপারে জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি হলে এ ধরনের হয়রানি অনেকটাই দূর করা সম্ভব বলে জানান তিনি।
ভেরিফিকেশন তৈরি হয়েছে হয়রানির জন্য
পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়রানি ও দুর্নীতির প্রতীক হয়ে ওঠায় এই পদ্ধতি বন্ধ করার সুপারিশ উপযুক্ত হয়েছে বলে মনে করেন সাবেক সচিক আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান।
তিনি বলেন, পুলিশ ভেরিফিকেশন উপনিবেশ আমলে তৈরি হয়েছিল মানুষকে হয়রানি করার জন্য। বাংলাদেশে ভেরিফিকেশনের নামে যেভাবে দুর্নীতি এবং বাপ দাদার রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করা হয়, তা অন্যায় অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক।
বিকল্প উপায়
আবেদনকারীর দেওয়া তথ্য যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। বিশেষ করে কোনো ব্যক্তির নামে ফৌজদারি মামলা আছে কি না, তার আচরণ কেমন সেটা জানা দরকার আছে বলে তারা মনে করেন।
এক্ষেত্রে তারা বিকল্প উপায় বিশেষ করে প্রযুক্তি নির্ভর যাচাই ব্যবস্থা চালু করার কথা বলেছেন যেন প্রার্থীরা হয়রানি থেকে মুক্তি পায় এবং দুর্নীতির পথও বন্ধ হয়।
সাবেক সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বিকল্প উপায় হিসেবে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার বা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান থেকে চরিত্র সনদ সংগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
এসব সনদে বলা থাকে, কমিশনার বা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ওই ব্যক্তিকে চেনেন এবং নিশ্চিত করেছেন তার চরিত্র ভালো এবং তিনি কোনো অপরাধমূলক বা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত নন।
তবে এই চরিত্র সনদ ঘুস দিয়ে বা নানা পরিচয়ের সূত্র ধরে সংগ্রহের অভিযোগ আছে। সেখানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি বলে তিনি জানান।
খান বলেন, পুলিশের ডাটাবেসে যদি সব নাগরিকের অপরাধের তথ্য, মামলার তথ্য নথিভুক্ত থাকে তাহলে সহজেই তাহলে সহজেই তার বৃত্তান্ত জানা যাবে। এক্ষেত্রে হয়রানির কোনো সুযোগ থাকবে না।
এছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ডাটাবেসের মাধ্যমে প্রার্থীর পরিচয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডাটাবেস থেকে শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য যাচাই করা যেতে পারে।
তবে এই ডিজিটাল ডাটাবেস সফল বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় তথ্যভাণ্ডারকে আরও শক্তিশালী, নির্ভুল ও নিরাপদ করা জরুরি বলে মত দিয়েছেন সাবেক এই সচিব, যাতে নাগরিকদের তথ্যের কোনো অপব্যবহার না হয়।
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান, অতিরিক্ত আইজি মো. গোলাম রসুলের মতে, এতো বছর ধরে যে পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছে তার মাধ্যমে দুই একটি ছাড়া স্বচ্ছতা নিশ্চিতের কাজ ভালোভাবেই হয়েছে।
রসুল বলেন, বাইরের দেশে সাধারণত একটি কনফার্মিং ক্লজ থাকে যেখানে জানতে চাওয়া হয় আপনার কোনো অপরাধ সংশ্লিষ্টতা আছে কি না। যদি সেখানে আবেদনকারী ‘না’ লেখেন এবং পরবর্তীতে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয় তখন তার নিয়োগ বা আবেদন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে এই কনফার্মিং ক্লজ থাকলেও তা সেভাবে স্বীকৃত না। যে কারণে শত বছরের পুরোনো এই পুলিশ ভেরিফিকশন পদ্ধতিটি থেকে গেছে। তবে এই পদ্ধতি বাতিলের পক্ষে-বিপক্ষে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।