যে কারণে পোশাক কারখানায় অস্থিরতা
স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ‘ঝুট ব্যবসার’ কারণে অস্থির হয়ে ওঠেছে গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভারে তৈরি পোশাক কারখানার পরিবেশ। তারা কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিক অসন্তোষকে কাজে লাগিয়েছেন৷ এমন অভিযোগ করেছেন পোশাক শ্রমিক নেতারা৷
তবে মালিকরা বলছেন, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে তৃতীয়পক্ষ এখানে সক্রিয়৷
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সোমবার রাত থেকেই সেনাবাহিনীসহ যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করে৷ মঙ্গলবারও কিছু পোশাক কারখানা বন্ধ থাকলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে বলে জানিয়েছেন শিল্প পুলিশ ও শ্রমিক নেতারা৷
শ্রমিক নেতারা মঙ্গলবার শিল্প উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ বৈঠক শেষে তারা পোশাক শ্রমিকদের শান্ত থেকে কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷
অন্যদিকে শিল্প মালিকরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে শিল্পের নিরাপত্তা চেয়েছেন৷
বাংলাদেশ পোশাক শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মোহাম্মদ তৌহিদুর রহমান বলেন, কিছু পোশাক কারখানায় অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা আছে৷ সেটা নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ছিলে৷ কয়েকটি কারখানায় বেতন বকেয়া, হাজিরা, বোনাস, টিফিন ভাতা ও শ্রমিক ছাঁটাই নিয়ে অন্তোষ ছিলো৷ এটা নিয়ে কয়েকদিন ধরে কিছুটা শ্রমিক অসন্তোষ ছিলো৷ কিন্তু সোমবার যে ৫০টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যায় তা নিরাপত্তার কারণে৷ বহিরাগতরা বিভিন্ন পোশাক কারখানায় হামলা চালালে ওই কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়৷
তিনি বলেন, সরকার পরিবর্তনের পরও ঝুট ব্যবসার আধিপত্য ধরে রাখতে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা বহিরাগতদের দিয়ে পোশাক কারখানায় হামলা চালায়৷ পোশাক কারাখানার ওয়েসটেজ এই ঝুট ব্যবসায় আছে কোটি কোটি টাকা৷ আর এই ব্যবসা রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাই নিয়ন্ত্রণ করেন৷
কয়েক দিন আগে থেকে পোশাক কারখানা এলাকায় অস্থিরতা শুরু হলেও ১ সেপ্টেম্বর প্রথম ১০টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, ওই দিন কয়েকটি কারখানায় হামলা হয়৷ ২ সেপ্টেম্বর পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে৷ হামলার কারণে ৫০টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়৷ মঙ্গলবারও ১০টির মতো কারখানা বন্ধ ছিল৷ তারা নিরাপত্তার কারণে কারখানা খোলেনি৷
এ পরিস্থিতির শুরু হয় বিভিন্ন সময় ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে৷ তারা চাকরিচ্যুতদের কাজে ফিরিয়ে নেওয়া এবং পোশাক কারখানায় কমপক্ষে ৫০ ভাগ পুরুষ নিয়োগের দাবিতে কয়েক দিন আগে আন্দোলন শুরু করেন৷ বাংলাদেশে পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের প্রায় ৮০ ভাগ নারী৷
‘বেকার আন্দোলন’ নামের ওই সংগঠনের নেতা শাহীন আহমেদ বলেন, পোশাক কারখানায় যারা হামলা করেছে তারা আমাদের কেউ নয়৷ আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছিলাম৷ যারা হামলা করেছে তারা বহিরাগত৷ তাদের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে৷
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফেডারেশনের সভাপতি সরোয়ার হোসেন বলেন, কারা ক্ষমতায় এলো আর কারা ক্ষমতা ছাড়ল সেটা আমাদের বিষয় নয়৷ আমরা শ্রমিকরা শিল্প উৎপাদন ঠিক রাখতে চাই৷ আমাদের শ্রমিকদের কিছু দাবি-দাওয়া আছে, সেগুলো আমরা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আদায় করতে চাই৷ কিন্তু এখন যারা পোশাক কারখানায় হামলা করেছে তারা কোনো শ্রমিক নয়৷ কোনো একটি গোষ্ঠী এই খাতকে অস্থিতিশীল করতে এই হামলা চালিয়েছে। আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচিও দেইনি৷ কোনো কোনো পোশাক কারখানায় অভ্যন্তরীণ কর্মসূচি ছিল৷ তারই সুযোগ নিয়েছে হামলাকারীরা৷
গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভারে দেড় হাজারের বেশি পোশাক কারখানা আছে৷ একটি কারখানার শ্রমিকরা বাইরে এলেই এক-দেড় হাজার শ্রমিকের বিক্ষোভে পরিণত হয়৷
মোহাম্মদ তৌহিদুর রহমান বলেন, কোনো কারখানার শ্রমিকরা বাইরে আসেনি৷ তারপরও হামলা কারা করল সেটা তদন্ত হওয়া দরকার৷
তিনি বলেন, শিল্প উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন শ্রমিকদের যে যৌক্তিক দাবি আছে তা ধীরে ধীরে পূরণ করা হবে৷ তাদের সময় দিতে হবে৷ আর এর সঙ্গে ২০২৩ সালে ২০ হাজার শ্রমিককে আসামি করে যে ৪৩টি মামলা হয়েছে, তা প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করেছি৷
আশুলিয়া এলাকায় মঙ্গলবারও কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন৷ তারা কিছুক্ষণের জন্য সড়ক অবরোধ করেন৷
আশুলিয়া শিল্প পুলিশের এসপি মোহাম্মদ সারোয়ার আলম জানান, মঙ্গলবার তিন-চারটি কারখানায় কিছুটা ঝামেলা ছিলো৷ আগের দিন বন্ধ করে দেওয়া ওই কারাখানাগুলো মঙ্গলবারও না খোলায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন৷ রাস্তার পাশের পোশাক কারখানার শ্রমিকরা সড়কও অবেরোধ করেন৷ তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে৷
তিনি বলেন, সোমবার রাত থেকেই পুলিশ ও সেনা সদস্যরা যৌথ অভিযান শুরু করেছে৷ এখনো কারখানার নিরাপত্তায় টহল অব্যাহত আছে৷
এদিকে মঙ্গলবার গাজীপুরে চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে বেশ কয়েকটি স্থানে পোশাক শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেছেন৷ সকালে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা গাজীপুর মহানগরীর ভোগরা বাইপাস, ছয়দানা, হাজির পুকুর, মালেকের বাড়ি, সাইনবোর্ড এলাকায় বিক্ষোভ করেন৷ শ্রমিক বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে শ্রমিকদের ইট-পাটকেলে শিল্প পুলিশের এএসপি মোশরাফ হোসেনসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন৷
গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত এসপি ইমরান হোসেন বলেন, সকাল থেকেই গাজীপুরের বেশ কয়েকটি স্থানে বিভিন্ন পোশাক কারখানার চাকরিচ্যুত শ্রমিকেরা চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে বিক্ষোভ করেন৷ একপর্যায়ে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে যানবাহন চলাচলে বাধা দেন৷ খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন৷ এতে পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন৷
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, পোশাক কারখানায় সমস্যা কিছু না কিছু সবসময়ই থাকে৷ আমরা সেটা অভ্যন্তরীণভাবে সমাধান করি; কিন্তু এবার যা ঘটেছে তা অপ্রত্যাশিত৷ আমরা মনে করি এর সঙ্গে শ্রমিকরা জড়িত নয়৷ তৃতীয় কোনো পক্ষ যারা অস্থিতিশীল পরিবেশ করতে চায় তারা এটা করেছে৷ তাদের চিহ্নিত করতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি৷
তিনি জানান, সরকার ব্যবস্থা নেওয়ার পর মঙ্গলবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে৷ মঙ্গলবার অল্প কয়েকটি কারখানায় সমস্যা হয়েছে৷ বিভিন্ন সময় চাকরিচ্যুতরা এ সমস্যা করছে। আসলে হায়ার অ্যান্ড ফায়ার একটা স্বাভাবিক ঘটনা৷ বেতন নিয়ে কোনো সমস্যা নাই৷