Home রাজনীতি তারেকের ‘একলা চলো’ নীতি বাস্তবে কাজে লাগছে না
জুন ২০, ২০২৪

তারেকের ‘একলা চলো’ নীতি বাস্তবে কাজে লাগছে না

বিএনপিতে আকস্মিক রদবদলের কারণ কী হতে পারে, তা স্পষ্ট নয় দলটির নেতা-কর্মীদের কাছে। যদিও দল পুনর্গঠনের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আট বছর ধরে কাউন্সিল করতে পারছে না দলটি। আবার মামলা, জেল ও সাজার ভার সামলাতে লম্বা সময় ধরে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করছেন দলের নেতা–কর্মীরা। এমন পটভূমিতে কাউন্সিল না করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দলে ভাঙাগড়ায় বিএনপির ভেতরে-বাইরে চলছে নানা আলোচনা। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদেরও অনেকে এ নিয়ে বিব্রত।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাঁর একক ক্ষমতায় এই রদবদল করেছেন। তিনি কি ‘একলা চলো’ নীতি নিয়ে এগোতে চাইছেন, নিজের মতো করে দল গোছাতে চাইছেন? এসব প্রশ্ন রয়েছে দলের ভেতরে। কারণ, হঠাৎ করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যে প্রক্রিয়ায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে রদবদল করা হয়েছে, সে ব্যাপারে আগাম ধারণা ছিল না নীতিনির্ধারকদের। এভাবে ‘চিরকুট’ দিয়ে পরিবর্তন বা শীর্ষ নেতৃত্বের একলা চলো নীতি দলের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রশ্নে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে বা কতটা এগিয়ে নেবে বিএনপিকে, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে দলটির নেতাদের কারও কারও।

তৃণমূল থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, এ নিয়ে দলের বড় অংশে অসন্তুষ্টি রয়েছে। কিন্তু দলের কেউ শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার সাহস দেখাবেন, সেই সুযোগ ও পরিস্থিতি নেই।

সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতার দায়ে ১৩ জুন মধ্যরাতে বিএনপির ঢাকার দুটিসহ (উত্তর ও দক্ষিণ), চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগর কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। একই সময় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকার চার আঞ্চলিক কমিটি এবং যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটিও বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এরই মধ্যে গত শনিবার কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের ২৬০ সদস্যের (আংশিক পূর্ণাঙ্গ) কমিটি ঘোষণা করা হয়।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের কমিটি ২০২১ সালেও ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তখন হাবিব উন নবী খান ও আবদুল কাউয়ুমকে সরিয়ে উত্তরের আহ্বায়ক করা হয়েছিল আমান উল্লাহ আমানকে। আর দক্ষিণের আহ্বায়ক করা হয় আবদুস সালামকে। সেই চেষ্টাও বাস্তবে কাজে লাগেনি বলে মনে করেন নেতাদের অনেকে।

এবার বড় রদবদল করা হয় বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ ও জাতীয় নির্বাহী কমিটিতেও। ৪৪টি পদে রদবদল করা হয়। এতে বেশ কয়েকজন পদোন্নতি পেয়েছেন। দুই সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ ও আবদুস সালাম আজাদকে যুগ্ম মহাসচিব করা হয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন আসাদুজ্জামান রিপন। প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন যুগ্ম মহাসচিব।

দলের দায়িত্বশীল পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। তাঁদের মধ্যে মাহবুবউদ্দিন খোকন, মজিবুর রহমান সরোয়ার, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও হারুন অর রশিদ। যুগ্ম মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে তাঁদের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়েছে রুহুল কুদ্দুস তালুকদারকে।

বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দলীয় প্রধানকে পরামর্শ দেওয়া ছাড়া উপদেষ্টাদের সাংগঠনিক তেমন কোনো কাজ নেই। কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে নতুন যুক্ত হয়েছেন অনেকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটিও পুনর্গঠন করা হয়েছে। কারও দায়িত্বশীল পদ হারানো, কারও পদোন্নতি বা নতুন পদ পাওয়া—এসবের পেছনে তারেক রহমানের সন্তুষ্টি–অসন্তুষ্টির বিষয় ছিল বলে দলটির নেতাদের কেউ কেউ বলছেন।

এসব রদবদলের ঘোষণা আসে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। তবে তিনি বলেন, গঠনতন্ত্র ছাড়াও ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে শীর্ষ নেতার হাতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে রদবদলের ক্ষমতা বা এখতিয়ার দেওয়া হয়। এখানে একলা চলার বিষয় নেই। দল পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে শীর্ষ নেতৃত্ব এখতিয়ার অনুযায়ীই এসব পরিবর্তন এনেছেন।

কিন্তু রদবদলের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেওয়ায় দল পুনর্গঠনের এই যুক্তি দলের নেতা-কর্মীদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, একক ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন তারেক রহমান। দলের গঠনতন্ত্রে তাঁকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হলেও এককভাবে এর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা বা প্রয়োগ করা কার্যকর কোনো ফল দেবে না।

মামলা-মোকদ্দমার পরও সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে সারা দেশের বিএনপি নেতা-কর্মীরা সক্রিয় হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারের প্রতি ক্ষোভও ছিল। কিন্তু বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও জোটের সেই আন্দোলন ব্যর্থ হয়। তাদের আন্দোলন ও ভোট বর্জনের মুখেও গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে পেরেছে সরকার।

আন্দোলনে ব্যর্থতার পর বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে আবার হতাশার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে বিএনপির ইউনিয়নকর্মী থেকে শুরু করে মহাসচিব পর্যন্ত এমন কোনো নেতা নেই, যাঁর বিরুদ্ধে মামলা নেই। বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৫৫ হাজার ১০০। আসামির সংখ্যা ৫০ লাখের ওপরে। দলটির মামলার তথ্য ও সংরক্ষণ শাখা এ হিসাব দিয়ে জানিয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে গত ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব মামলা হয়েছে।

দলটি আরও জানিয়েছে, গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সহিংসতার পর থেকে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন পর্যন্ত মির্জা ফখরুলসহ দলের ২৫ হাজারের বেশি নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। নির্বাচনের পর তাঁদের বেশির ভাগই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তবে যানবাহনে অগ্নিসংযোগসহ সহিংসতার বিভিন্ন অভিযোগে অনেক মামলায় বিচারপ্রক্রিয়াও এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে ঢাকাতেই বিভিন্ন আদালতে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের প্রায় ১ হাজার ৮০০ নেতা-কর্মীর কারাদণ্ড হয়। তাঁদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন অন্তত ৩১ জন। তাঁদের অনেকে পরে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

মামলার চাপে জর্জরিত নেতা–কর্মীদের সক্রিয় করা এবং আন্দোলনে ব্যর্থতার হতাশা কাটিয়ে ওঠা এখন বিএনপির নেতৃত্বের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, সরকারের দমননীতি, মামলাসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনেক দিন ধরেই তাঁদের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে পুনর্গঠনের তাগিদ ছিল। সেই তাগিদ থেকেই তারেক রহমান তাঁর ক্ষমতাবলে কমিটিতে রদবদল এনেছেন। আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে নতুন করে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরুর চিন্তা থেকেও এই পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে।

রদবদলের পর কাউন্সিল নিয়ে বিএনপিতে এখন দুই ধরনের আলোচনা রয়েছে। কোনো কোনো নেতা মনে করছেন, দলের স্থায়ী কমিটিসহ আরও কিছু পর্যায়ে রদবদলের পর সীমিত পরিসরে ‘নিয়ন্ত্রিত’ কাউন্সিল করা হতে পারে। আবার দলের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করেন, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠনের মাধ্যমে এই বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে শিগগিরই কাউন্সিল করার সম্ভাবনা নেই।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন তারেক রহমান। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাজা ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছিল। তখন থেকে ছয় মাস পরপর ৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছে সরকার। বয়স ও অসুস্থতার কারণে খালেদা জিয়া রাজনীতিতে কার্যত সক্রিয় নেই।

ফলে তারেক রহমানের হাতেই এখন দলের পুরো নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু ২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি দেশ ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি দেন। ২০০৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মামলায় তাঁর সাজা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। তিনি দেশে ফিরছেন না, লন্ডন থেকেই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ নিয়েও অনেক সমালোচনা রয়েছে।

দলের দুই শীর্ষ নেতাকে এমন পরিস্থিতিতে রেখে কাউন্সিল করা হলে তা আরও সংকট বাড়াতে পারে বলে নেতাদের অনেকে মনে করেন। তাঁরা বলছেন, সক্রিয় হতে না পারলেও খালেদা জিয়াকে দলের চেয়ারপারসনের পদ থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানই থাকবেন। আর কাউন্সিল করা হলে তাঁদের দুজনের কেউই সশরীর অংশ নিতে পারবেন না। সেটি আরও সমস্যা তৈরি করবে। এতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সমালোচনার সুযোগ পাবে। ফলে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব কাউন্সিল করার ব্যাপারে আগ্রহী নন বলে দলটির ওই নেতাদের ধারণা।

এ ছাড়া সারা দেশ থেকে কয়েক হাজার প্রতিনিধি ঢাকায় এনে কাউন্সিল করার মতো অনুকূল পরিস্থিতি নেই বলেও বিএনপির নেতাদের অনেকে মনে করেন। তাঁদের ধারণা, কাউন্সিল করার মতো বড় আয়োজনে সরকার অনুমতি না-ও দিতে পারে। ফলে উদ্যোগ নেওয়ার পর অনুমতি পাওয়া না গেলে সেই পরিস্থিতি নেতা-কর্মীদের হতাশা বাড়াবে। তবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও তাঁদের কাউন্সিল করার চিন্তা রয়েছে। আর দলে অপ্রয়োজনীয় কোনো রদবদল হয়নি বলে তিনি মনে করেন।

তবে দলের ভেতরে আলোচনা যা-ই হোক না কেন, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব কোন পথে হাঁটতে চাইছেন বা কী কৌশল নিচ্ছেন, দলটির নেতা-কর্মীরা এখন সেটা বোঝার অপেক্ষায় রয়েছেন।

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *