কেন জনপ্রিয়তা পেল রোমান্টিক সিনেমাটি
গত মাসে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকটি সিনেমা ও সিরিজ মুক্তি পেয়েছে। এর মধ্যে যে কয়টি কনটেন্ট আলোচিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম শিহাব শাহীনের ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ সিনেমা নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে। চরকিতে মুক্তি পাওয়া ওয়েব ফিল্মটিতে এমন কী রসদ আসে, যা পছন্দ করেছেন দর্শকেরা?
বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ, চরকির ফেসবুক, ইউটিউবের চ্যানেলে মন্তব্য, দেশি-বিদেশি সমালোচকদের আলোচনা বিশ্লেষণ করলে সিরিজটি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কয়েকটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়।
সহজ গল্প। বাড়তি নাটকীয়তা তৈরির চেষ্টা নেই, এখানে গল্পকে গল্পের মতো করে এগিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে—বেশির ভাগ দর্শকই ওয়েব ফিল্মটি নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন। আরমান নামের এক দর্শকের মনে হয়েছে, বাস্তবঘেঁষা গল্প হওয়ার কারণে সিনেমাটি তাঁর ভালো লেগেছে। ভালোবাসা, অভিমান, চাপা কষ্ট, বিরহ—সব মিলিয়ে এই সিনেমার আবেগের সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পেরেছে অনেকে। সিনেমাটিতে সংলাপহীন ৩ মিনিটের একটি দৃশ্য আছে, সেটিও উঠে এসেছে আলোচনায়।
রাজকুমার রিহাদ নামের এক দর্শক যেমন লিখেছেন, ‘দুজন মানুষ, সম্পূর্ণ চুপ, হয়তো একরাশ অভিমান, হয়তো চাপা কষ্ট…৩ মিনিটের একটা সংলাপহীন দৃশ্য দিয়ে দর্শকের মন কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’ বেশির ভাগ দেশি কনটেন্ট ঢাকা শহরের প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়। কিন্তু এ ওয়েব ফিল্মটি তৈরি হয়েছে রাজশাহীর প্রেক্ষাপটে। স্থানীয় ভাষার ব্যবহার, নদীর পারকে প্রায় চরিত্রের মতো ব্যবহার করা সিনেমাটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
চিত্রনাট্যকার ও সমালোচক মেহেদি হাসান মুন সিনেমাটি নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কিছু কিছু কাজ দেখলে থমকে যেতে হয়। মনে হয় যেন জীবন থেকে এক টুকরো গল্প নিয়ে কেউ পর্দায় ছড়িয়ে দিয়েছে। ওই চরিত্রটা মনে হয় আমিই–বা খুব পরিচিত কেউ। “কাছের মানুষ দূরে থুইয়া” তেমনই একটা ফিল্ম। নিখুঁত একটা সিনেমা। নিখুঁত ওই অর্থে যে গল্প বলতে চেয়েছে এই সিনেমা, সেটিই বলতে পেরেছে।’
বাংলা কনটেন্টে আগে অন্যতম বড় সমস্যা ছিল সংলাপ, কয়েক বছর ধরে সংলাপে উন্নতি লক্ষ করার মতো। ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়াতে’ও সে ছাপ স্পষ্ট। আলাদাভাবে কোনো নায়কোচিত সংলাপ নেই কিন্তু পুরো সিনেমার সংলাপই দারুণ পরিমিত।
বিশেষ করে মূল দুই পাত্র-পাত্রীর প্রেমে পড়া আর দূরত্বের সময়ে বলা সংলাপগুলো ছুঁয়ে গেছে অনেক দর্শককে।
দূরবর্তী সম্পর্কের গল্পে ফারিণ–প্রীতম
এ ছাড়া আলাদা করে বলতে হয় অভিনয়ের কথা। তাসনিয়া ফারিণের অভিনয় নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। শারমিন চরিত্রে পর্দায় রোমান্টিক দৃশ্য হোক বা অসহায়ত্বের—তিনি নিজের সেরাটা উজাড় করে দিয়েছেন। তবে ফিল্মটির সবচেয়ে বড় চমক প্রীতম হাসান। এখন তাঁর পরিচয় লিখতে দিতে গিয়ে কেবল গায়ক লেখা মুশকিল হয়ে যাবে। ফারহান চরিত্রে তাঁর অভিনয় এতটা সাবলীল যে তিনি মূলত গায়ক, এটা ফিল্মটি দেখার সময় মনেই থাকে না।
‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’র জনপ্রিয়তার পেছনে এসব কারণ ছাড়া আরও একটা কারণ জানালেন ফিল্মটির অভিনেত্রী তাসনিয়া ফারিণ। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সিনেমার সহলেখক একজন নারী। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ফারিণ বলেন, ‘আমির এর আগেও তাঁর লেখায় কাজ করেছি। ওনার লেখায় মেয়েদের মনস্তত্ত্ব দারুণভাবে উঠে আসে—এটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগবে। পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লিখলে এটা পাওয়া যায় না। ফলে চিত্রনাট্য দেখে পর্দায় নিজের চরিত্র সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাই, শিহাব ভাইকে (নির্মাতা শিহাব শাহীন) একবারও জিজ্ঞেস করতে হয়নি “শারমিন” এটা কেন করছে, এটা কেন ভাবছে। এটা খুবই শক্তিশালী চরিত্র ছিল।’
নির্মাতা শিহাব শাহীন মনে করেন, সিনেমাটিতে যে লং ডিসট্যান্স সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে, সেটার সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছেন দর্শকেরা। গতকাল দুপুরে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওয়েব ফিল্মটি মুক্তির পর দেশ-বিদেশ থেকে অনেক দর্শকের প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন। কেউ নিজের জীবনের সঙ্গে সিনেমার মিলের কথা বলেছেন, কেউ আবার আবেগাপ্লুত হয়ে ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েছেন। এই নির্মাতা বলেন, ‘সিনেমাটিতে মানুষ নিজের স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখতে পেয়েছে। সিনেমাটির বার্তা ছিল, সম্পর্কে যত দূরত্বই তৈরি হোক, একটা আলিঙ্গন সব ভুলিয়ে দেয়। এটা দর্শককে ছুঁয়ে গেছে। কারণ, প্রায় প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন একটা মুহূর্ত এসেছে, যখন ছেলেটি মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়েছে, বিচ্ছেদ ঘনিয়ে আসছে; মনে মনে ভাবছে সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু বলতেও পারছে না…। এই মুহূর্তে শারমিন আর ফারহানকে দেখে দর্শকের নিজের কথা মনে পড়েছে।’
নারী লেখক যুক্ত হওয়ায় সিনেমাটি যে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে—ফারিণের এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত শিহাব শাহীনও। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নারী হিসেবে পর্দায় নারী চরিত্র উপস্থাপনের ব্যাপারে সে সব সময়ই সচেতন থাকে। কিছু নিয়ে আমার মধ্যে দ্বিধা তৈরি হলে সে যখন কিছু বলে, তখন ভরসা পাই। মনে হয়, একজন নারী নিজেই যেহেতু বলেছেন, সেহেতু ঠিকই আছে। যেমন সিনেমায় ফারহান খ্যাপানোর জন্য শারমিনকে “এলাচি বেগম” বলে ডাকে। এটা আমি হয়তো দিতাম না—মেয়েরা কী ভাববে! কিন্তু সে যখন দিল আমি আপত্তি করলাম না।’