Home সারাদেশ রাজধানীতে নাজেহাল মানুষ, টান রুজিতে
Oktober ২৯, ২০২৩

রাজধানীতে নাজেহাল মানুষ, টান রুজিতে

অন্য রকম সকাল, হালকা কুয়াশা। নেই হাঁকডাক। মাঝিশূন্য নৌকা ঘাটে বাঁধা। গতকাল শনিবার সকালের এ চিত্র বুড়িগঙ্গার তীরে খেয়াঘাটগুলোর। পার হতে আগানগর থানার ঘাটে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় সিদ্দিকুর রহমান। মিটফোর্ডের বংশীবাজারে তৈজসপত্রের দোকানের এ বিক্রয়কর্মী বলেন, সকাল ৭টা থেকে নৌকার অপেক্ষায়। কিন্তু পুলিশের বাধায় চলছে না নৌকা। আগানগর ব্রিজঘাট এলাকায় নৌকার জন্য সকাল ৭টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষায় ছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের নার্স নাহিদা আক্তার। নৌকা না পেয়ে তিনি বাসায় ফিরে যান।

ফার্মগেটে বোনের বাসায় জরুরি কিছু কাগজপত্র পৌঁছে দিতে বাসা থেকে বের হন তাজুল ইসলাম। কিন্তু সদরঘাট বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখেন, গাড়ি নেই। পরে ৪০০ টাকায় মোটরসাইকেল ভাড়া করেন তিনি।

ছুটির দিনেও রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকা তেমন ফাঁকা থাকে না। অনেকে মাসিক-সাপ্তাহিক বাজারের জন্য এখানে আসেন। তবে গতকাল এলাকাটি ছিল তুলনামূলক ফাঁকা। রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে ‘কী না কী হয়’ ভাবনা থেকে ক্রেতারা কারওয়ান বাজারে আসেননি বলে ধারণা দোকানিদের। মুদি দোকানি আজমত হোসেন বলেন, অন্য দিন দুপুর পর্যন্ত ২০ হাজার টাকার ওপরে বিক্রি হয়। শনিবার দুই হাজার টাকারও হয়নি।

 

সকাল ১০টা। রাজধানীর সাতমসজিদ রোডের জিগাতলা থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ঘুরে গুনে গুনে বাস দেখা গেল তিনটি। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে রমজান পরিবহনের কর্মী মো. রুবেল বলেন, ‘শাহবাগের পর তো যাওন যাইব না। রাস্তায় নাইমা লাভ নাই।’ এতে উপার্জনের টান পড়বে কিনা– জানতে চাইলে বলেন, ‘এগুলা বইলাও লাভ নাই।’ এখানে কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী তৌহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য সব বন্ধ হলেও আমাদের অফিসে যেতেই হবে। এ জন্য বাড়তি টাকা খরচ করে কাকরাইলে কর্মস্থলে যাচ্ছি। এই টাকা তো কেউ দেবে না।’

রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত নিউমার্কেটের ভিন্ন চেহারা দেখা গেল গতকাল। ফুটপাতের অধিকাংশ দোকান বন্ধ। মানুষেরও চলাচল কম। দোকানপাট বন্ধ ছিল মতিঝিল, পুরানা পল্টন, নয়াপল্টন, আরামবাগ, বায়তুল মোকাররম, ফকিরাপুলসহ দলগুলোর সমাবেশের আশপাশের অনেক এলাকায়।

বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় ঢুকতেও মানুষকে পোহাতে হয়েছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। আমিনবাজার পুলিশ পয়েন্ট থেকে হেঁটে শত শত মানুষ কর্মস্থলে আসেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেও গণপরিবহন না থাকায় অনেকের ভরসার যান হয়ে ওঠে দুই পা। ফেনী থেকে বাসে ঢাকা এসেছিলেন মোহাম্মদ আলম ও নুরুল হুদা। তবে যাত্রাবাড়ীর মাদ্রাসা বোর্ড এলাকায় আসার পর তাদের গাড়ি পুলিশি তল্লাশিতে পড়ে। নুরুল হুদা বলেন, ‘আমি প্রবাসী। চিকিৎসক দেখানোর জন্য ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিই। কিন্তু কুমিল্লা থেকে ঢাকা পর্যন্ত অন্তত পাঁচ জায়গায় পুলিশ গাড়ি তল্লাশি করেছে। ব্যাগ খুলতে খুলতে আমি হয়রান। আমার মোবাইল ফোনও ঘেঁটে দেখে তারা। এখন তো গাড়ি থেকেই নামিয়ে দিল। এত পথ কীভাবে হেঁটে যাব? এ হয়রানি ভালো লাগছে না।’

নারায়ণগঞ্জের শিবু মার্কেটে ছোট বোনের বাড়ি এসেছিলেন গৃহিণী সাবিনা আক্তার। বেড়ানো শেষে গতকাল সকালে গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরের উদ্দেশে বোনের বাসা থেকে বের হন তিনি। কিন্তু বাস না পেয়ে ৯ মাসের কোলের সন্তান সাব্বিরকে নিয়ে শিবু মার্কেট থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে সাইনবোর্ড আসেন তিনি। হাতে ব্যাগ, কোলে সন্তান নিয়ে এক ঘণ্টার বেশি ঠায় দাঁড়িয়েও উঠতে পারেননি কোনো গাড়িতে।

মহাসড়কে অন্য দিনের তুলনায় গতকাল গণপরিবহন কম চলেছে। বিভিন্ন জেলা থেকে দূরপাল্লার বাসও আসেনি। সকাল থেকে এমন দুর্ভোগের মধ্যেই উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানীর রাজনীতির মাঠ। দফায় দফায় সংঘর্ষে বাড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ঘটনাস্থলের আশপাশে সাধারণ মানুষ জীবন বাঁচাতে ছোটেন। এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে দুপুরের পরপরই আসে হরতালের ঘোষণা, যা অনেক বছর দেখেনি রাজধানীবাসী। ঘোষণার রেশ না কাটতেই সেই চিরচেনা দৃশ্য। বাসে আগুন, ভাঙচুর; সন্ধ্যা থেকে যানবাহনের অভাবে ঘরে ফেরা মানুষের দুর্ভোগ। শহরজুড়ে রাতভর চাপা উৎকণ্ঠা। যেনতেনভাবে বাড়ি ফিরতে পারলেই যেন সবাই ফেলতে পারবে স্বস্তির নিঃশ্বাস।

তবে হঠাৎ হরতালের ঘোষণায় বিপাকে পড়েন দূরপাল্লার যাত্রীরা। কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ যাবেন মুজিবুর রহমান; এক ঘণ্টা ধরে আটকে আছেন যাত্রাবাড়ী থানার সামনে। কিন্তু গাড়িতে উঠতে পারছেন না। তিনি কিছুটা ক্ষোভ নিয়েই বললেন, জনদুর্ভোগ হয় এমন কোনো কর্মসূচি দেওয়া উচিত নয় দলগুলোর।

করোনা-পরবর্তী বিপর্যস্ত জীবন, টালমাটাল অর্থনীতি, নিত্যপণ্যের আগুন দাম– এ পরিস্থিতিতে জীবিকার প্রয়োজনে একান্ত বাধ্য হয়ে পথে নামা রাজধানীর কর্মজীবী মানুষের জন্য আবারও হরতালের ঘোষণা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে উঠবে বলে মনে করেন অনেকে। ঢাকায় প্রায় তিন দশক রিকশা চালান ময়মনসিংহের আজিজুর রহমান। অনেক ঘটনার সাক্ষী। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়লে প্রথমেই তাঁর মাথায় আসে রুটি-রুজির চিন্তা। ঢাকায় সংঘাত-সহিংসতা হলে নিজে নিরাপদ থাকতে পারবেন কিনা, সে দুশ্চিন্তাও তাড়া করছে। হতাশ কণ্ঠে আজিজুর বলেন, ‘রাস্তায় নামবাইম, একটা অ্যাক্সিডেন্ট অইতে পারে, মারামারি লাগলে সমস্যা অইতে পারে। সমাবেশ মানেই তো সবাই রাস্তাঘাট বন্ধ কইরা দিব।’

মোহাম্মদপুরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের এক পক্ষের হরতাল এবং অন্য পক্ষের তা যদি প্রতিরোধ করা মৌলিক অধিকার হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের নির্বিঘ্নে চলাফেরার অধিকার কেন লঙ্ঘন করা হচ্ছে?’ সাধারণ মানুষ দুই দলের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে চান না। তাদের চাওয়া– সংকট থাকবে, এক জায়গায় বসে তার সমাধানও বের করতে হবে দুই দলকে। সাধারণ মানুষকে যেন আর দুর্ভোগ পোহাতে না হয়।

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *