কী যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতেন সাদিয়া
সাদিয়াকে কখনো কেউ গোমড়া মুখে দেখেনি। সব সময় হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত থাকতেন। সবার সঙ্গে মিশতেন। কথা বলতেন। খুব কম সময়ে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যাওয়া এই শ্যুটারের মনের গভীরে কী যন্ত্রণা ছিল, সেটা কেউ জানত না। সেই অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়েই মঙ্গলবার স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে পরলোকের বাসিন্দা হয়েছেন সাদিয়া সুলতানা। রেখে গেছেন গভীর শোকাতুর বাবা-মা, স্বামী আর ফুটফুটে দুটি ছেলে-জায়েদ বিন ইসলাম আর জায়েন বিন ইসলামকে। গত দুদিন ধরে ঘরের আনাচকানাচে মাকে খুঁজে ফিরছে এই দুই অবোধ শিশু।
২০১০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে সোনা জিতে আলোচনায় আসেন সাদিয়া। একই বছর জিতেছিলেন কমনওয়েলথ শ্যুটিংয়ের সোনা। ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে সেবার দলগত ইভেন্টে শারমিন রত্নার সঙ্গে মিলে জেতেন সোনার পদক। নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। এরপর সাফল্য আসে আরো একবার। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ গেমসেও সোনাজয়ী ছিলেন তিনি। এর পরই হঠাৎ অন্তরালে চলে যান সাদিয়া।
মাঠে-ময়দানের নিয়মিত মুখ সাদিয়া কেন লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেলেন, তা জানতে চাওয়া হয় তার বাবা সৈয়দ সারোয়ার আলমের কাছে। চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রশাসনিক কর্মকর্তা সারোয়ার আলম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানালেন, ‘আমার মেয়েটা বড় অভিমানী ছিল। খুব কম সময়ে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল সে। ১৪টি দেশ ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিল। চট্টগ্রামের জন্য, দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছিল। কিন্তু দেশ তাকে প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। কম যোগ্যতা নিয়ে কেউ কেউ জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেলেও সাদিয়ার ভাগ্যে এই সম্মান জোটেনি।’ এদিকে সিজেকেএস সূত্র জানায়, অসুস্থ হওয়ার পর চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাছ থেকে কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা পাননি দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনা এই শ্যুটার। সাদিয়াকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেও পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে জেলা ক্রীড়া সংস্থা। এই অবহেলাকে মেনে নিতে পারেননি সাদিয়া।
সারোয়ার আলম জানান, ‘আমরা রক্ষণশীল পরিবারের সদস্য হলেও সন্তানদেরকে গোঁড়ামিমুক্ত রাখার চেষ্টা করেছি। তাদেরকে পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা করতে উৎসাহ দিয়েছি। আমার মেয়েটা রাতে ঘুমানোর আগে নিয়মিত কোরান পড়ত।’ ২০১৭ সালে বিয়ের মাত্র এক মাস পর তার জীবনে ঘটেছিল বড় এক ট্র্যাজেডি। বাড়িতে গ্যাসের চুলা থেকে তার শরীরে আগুন ধরে। তারপর দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু আর তেমন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি সাদিয়া। অশ্রুভেজা চোখে সারোয়ার আলম বলেন, ‘অনেকে বলেন, আমার মেয়েটা নাকি দাম্পত্য জীবনে অসুখী ছিল। এই কথাটা ডাহা মিথ্যা। দুই ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে সে ভালো ছিল। উৎসাহ দেওয়ার জন্য আমি সব সময় মেয়েকে বলতাম, মা তোকে নিয়মিত খেলা চালিয়ে যেতে হবে। তুই চলে গেলে শ্যুটিংয়ের বাতি নিভে যাবে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আমার মেয়েটা সত্যি সত্যি চলে গেল।’