Home জাতীয় আসামি চেনে না বাদীকে, বাদী চেনে না আসামিকে
নভেম্বর ২৪, ২০২৪

আসামি চেনে না বাদীকে, বাদী চেনে না আসামিকে

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ১০০ দিনে যে কয়েকটি ঘটনা আলোচনার শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে, এর অন্যতম ‘ঢালাও মামলা’। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশ জুড়ে এ পর্যন্ত হওয়া ঢালাও মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনা সম্পর্কে আসামিদের সিংহভাগ কিছুই জানেন না। বাদী চেনেন না আসামিকে, আসামিরাও চেনেন না বাদীকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বাদী নিজেও ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এমনও অভিযোগ উঠেছে, শত শত মানুষকে আসামি করে মামলা দিতে বাদীকে বাধ্য করা হয়েছে, কখনো দেখানো হয়েছে টাকার প্রলোভনও।

পূর্বশত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা এবং চাঁদাবাজি ও হয়রানি করতে অনেককে আসামি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। মামলায় কাদের আসামি করা হবে, সেক্ষেত্রে বাদীর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; নিয়ন্ত্রণ থাকে অন্যদের হাতে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীসহ সরকারবিরোধীদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলা দিত পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতারা। এখন দেখা যাচ্ছে, হত্যা মামলায় ঢালাওভাবে আসামি করা হচ্ছে ‘ইচ্ছেমতো’।

সরকার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, এসব মামলায় নিরীহ কাউকে যেন হয়রানি না করা হয়, প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পাওয়া না গেলে কাউকে যেন গ্রেফতার করা না হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অনেককেই এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে বা এখনো করা হচ্ছে। আবার ঘটনার সঙ্গে দূরতম সম্পৃক্ততা না থাকলেও আসামি হয়ে নিরপরাধ অনেকে গ্রেফতারের ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম গতকাল শনিবার বলেছেন, ‘৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দায়ের হওয়া মামলাগুলো যথাযথভাবে তদন্ত করতে হবে। কোনো নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা যাবে না, কোনো পুলিশ সদস্যকেও অযথা ভিকটিমাইজ করা হবে না। নিরীহ কারো নামে মামলা হলেও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’

অভিযোগ উঠেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলা করার আগেই টার্গেটকৃত ব্যক্তির কাছে চাঁদা হওয়া হয়েছে। চাঁদা না দিলে মামলায় আসামি করা হয়েছে, আর চাঁদা দিলে আসামি করা হয়নি। আবার মামলার পর আসামির তালিকা থেকে নাম কাটাতেও লাখ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে, কিংবা এখনো নেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোথাও আবার মামলা দেওয়ার পাশাপাশি অনেকের বাড়ি, জমি, প্লট, দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও দখল করে নেওয়া হয়েছে। লুট করা হয়েছে মালামাল। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। যার প্রতিষ্ঠান লুট বা বেদখল করা হয়েছে, উলটো আবার তার বিরুদ্ধেই মামলা দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এর সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম ইতিমধ্যে একাধিকবার বলেছেন, ঢালাও মামলা দিয়ে বাণিজ্য করার বহু অভিযোগ তারা পেয়েছেন। মামলা দিয়ে বাণিজ্য করা যাবে না বলেও তিনি সতর্ক করেন।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) গত ১৯ নভেম্বর চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বলেছেন, ‘আগে ভুয়া মামলা করত পুলিশ। এখন করছে পাবলিক (জনগণ)। বেশির ভাগ মামলা ভুয়া। আগে পুলিশের করা ভুয়া মামলায় ১০টা নাম আর ৫০টা বেনামি আসামি থাকত। এখন পাবলিক (জনগণ) দিচ্ছে ১০টা নাম, ৫০টা ভুয়া নাম। মামলাগুলো পুলিশ, র‍্যাব কিংবা আনসার দেয়নি। জনগণই দিচ্ছে। তদন্তে কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেই ব্যবস্থা নিচ্ছি আমরা।’

রাজধানীর শ্যামপুর-কদমতলী এলাকার এক ভুক্তভোগী ইত্তেফাককে জানান, ৫ আগস্ট বিকাল থেকেই ঐ এলাকায় লাল মসজিদের সামনে থাকা তার কদমতলী স্টিল মিল ও ওয়্যার হাউজ ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্টিল মিলে থাকা ১০০ টন রড ও লোহালক্কড়ও লুট করে নিয়ে যায়। যার বাজারমূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। সেখানে থাকা বৈদ্যুতিক মোটর ও বিভিন্ন পার্টসও নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ভুক্তভোগীর অভিযোগ, শ্যামপুরে থাকা তার দোতলা বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। তার আরেকটি ৯ তলা ভবন ও জুতার কারখানাও জ্বালিয়ে দিয়ে লুটপাট করা হয়েছে। এতে বৈদ্যুতিক সাব স্টেশন পুড়ে যায়। অফিসে থাকা ৯টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র (এসি), ২০টি কম্পিউটার, চেয়ার-টেবিল, খাট সবই খুলে নিয়ে গেছে।

এই ভুক্তভোগীর অভিযোগ, ব্যবসা, কারখানা, বাড়িঘর সব হারিয়ে তিনি এখন নিঃস্ব। দুর্বৃত্তরা শুধু তাকে পথেই বসাননি, তিনিসহ তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলাও করেছে। সব হারিয়ে গ্রেফতার আতঙ্কে এই ব্যবসায়ী এখন ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পরপরই ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও লুটপাটের মাধ্যমে শ্যামপুর-কদমতলী এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন স্থানীয় বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন আহম্মেদের ছেলে তানভির আহম্মেদ রবিন। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যারা এলাকায় বিভিন্ন স্পটে মাদক ব্যবসা করতেন এবং নিয়মিত চাঁদা তুলতেন তাদের অনেককে সঙ্গী করেছেন রবিন। অর্থের উৎস ও চাঁদার প্রবাহ ঠিক রাখতে তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের পদধারীদের কাছে টেনেছেন। স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটিতেও আওয়ামী লীগের লোকদের বহাল রেখেছেন। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালও দখলে নিয়েছেন। এমনকি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত স্থানীয় এক ছাত্রদল নেতার বাড়িও দখল করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রবিনের সহযোগী স্থানীয় শ্রমিকদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ আলম জোরপূর্বক একাধিক প্লট দখল করে নিয়েছেন। যার ভিডিওচিত্র ঘুরছে এলাকাবাসীর কাছে। এসব নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্থানীয় নেতারা ফেসবুকে একাধিক স্ট্যাটাস দিয়েছেন। চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের স্থানীয় এক সমাবেশেও এলাকায় দখল-চাঁদাবাজির এসব অভিযোগের কথা উঠে আসে। অভিযোগ সম্পর্কে জানতে রবিনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

এক মামলায় ৫৩ সাবেক সচিব আসামি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে করা এক মামলায় ৫৩ জন সাবেক সচিবকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, সাবেক ওই সচিবেরা ‘ভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট’। সাবেক এই সচিবদের ‘ফ্যাসিবাদের সহযোগী, রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা’ হিসেবে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পদ থেকে সম্প্রতি অবসরে যাওয়া মো. মাহবুব হোসেনও।

গত ২৯ অক্টোবর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে মামলাটি করেছেন ছাত্রদলের সাবেক নেতা ও সরকারি তিতুমীর কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস মোহাম্মদ জামাল হোসেন খান (রিপন)। তার করা এই মামলায় মোট ১৯৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন মামলায় বিচ্ছিন্নভাবে সাবেক কয়েক জন সচিবকে আসামি করা হয়েছে। তবে একটি মামলায় একসঙ্গে ৫৩ জন সাবেক সচিবকে আসামি করার ঘটনা এটিই প্রথম।

মামলার এজাহারে বাদী রিপন উল্লেখ করেন, তার মেয়ে সামিয়া খান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ বনশ্রী শাখার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে যোগ দিতে সামিয়া আফতাবনগরে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যায়। সেখানে ছাত্র-জনতা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিল। ছাত্র-জনতার মিছিল চলার সময় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করতে থাকে। এ সময় সামিয়া গুলিবিদ্ধ হয়। তার পায়ে এখনো তিনটি গুলি রয়েছে।

বাদীর অভিযোগ, ঘটনার প্রায় তিন মাস পর তিনি প্রথমে বাড্ডা থানায় মামলা করতে যান। থানা থেকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর তিনি সিএমএম আদালতে মামলা করেন। আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) এ মামলা তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। এই মামলার এজাহারে উল্লেখ করা আসামিদের নাম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের নেতা ও বিগত সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের পাশাপাশি বনশ্রী-আফতাবনগর এলাকার ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের নামও রয়েছে। আসামির তালিকায় নাম থাকা কয়েকজন ইত্তেফাককে জানান, তারা বাদীকে চেনেন না, ঘটনা সম্পর্কেও কিছুই জানেন না। বাদী রিপন ইত্তেফাককে বলেন, ভুক্তভোগী হিসেবে তিনি মামলাটি করেছেন।

খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা, ছয় বছর পর মামলা
ছয় বছর আগে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার অভিযোগে ৬৫ জনকে আসামি করে সম্প্রতি রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মামলা করেছেন বাংলাদেশ পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান মো. বাবুল সরদার চাখারী। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে। আসামির তালিকায় জাপার শীর্ষ নেতারা ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও রয়েছেন। এই মামলা নিয়েও বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে চাখারীর বিরুদ্ধে। পরে চাঁদাবাজির অভিযোগে এক ভুক্তভোগীর করা মামলায় সেই চাখারী নিজেই এখন কারাগারে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম কয়েক দিন আগে সংবাদ ব্রিফিংয়ে ঢালাও মামলা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, মামলা দেওয়া ভুক্তভোগীর অধিকার। তবে যার বিরুদ্ধে কোনো এভিডেন্স নাই তার বিরুদ্ধে যাতে মামলা দেওয়া না হয়। পুলিশকে অর্ডার দেওয়া হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে কোনো এভিডেন্স নাই, দ্রুত তাদের নাম যেন বাতিল করা হয়।

ঢালাও মামলায় নিরপরাধ লোকজনকে আসামি করার বিষয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গত ১৯ নভেম্বর নিজ মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, হয়রানিমূলক মামলা ঠেকাতে ডিসি, এসপি, জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে জেলা পর্যায়ে কোনো কমিটি করা যায় কি না, সেই চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এই কমিটি মামলার প্রাথমিক তথ্যবিবরণী (এফআইআর) করার আগে যাচাই করে দেবে। তিনি বলেন, ‘যারা হয়রানিমূলক, মিথ্যা ও বাণিজ্যমূলক মামলা করছেন, কাউকে কাউকে নাকি হুমকিও দেওয়া হচ্ছে যে টাকা না দিলে মামলা করা হবে। আপনারা (হয়রানিমূলক মামলাকারী) মনে রাখেন, আমি যদি এই মন্ত্রণালয়ে থাকি, আপনাদের কীভাবে শাস্তি দেওয়া যায়, সেটির আইন খুঁজে বের করব।

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *