Home অপরাধ জেনেভা ক্যাম্প যেন অপরাধের স্বর্গরাজ্য
নভেম্বর ১৪, ২০২৪

জেনেভা ক্যাম্প যেন অপরাধের স্বর্গরাজ্য

আটকে পড়া পাকিস্তানিদের আবাসস্থল মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। মাদক বিক্রি, অস্ত্রের ঝনঝনানি, খুন-ছিনতাইসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যা ঘটছে না এখানে। ক্যাম্পে অর্ধলক্ষাধিক মানুষের বসবাস। তাদের মধ্যে ১১ হাজারের বেশি মানুষ ভোটার হয়েছেন। পেয়েছেন জাতীয় পরিচয়পত্রও। তবে তাদের অনেকেই নিজেদের এখনো আটকে পড়া পাকিস্তানিই মনে করেন। যাদের অনেকের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ লক্ষ করা যায়। এজন্য রাজনৈতিকভাবেও তাদের ব্যবহার করা হয়। প্রভাবশালীদের মদদে কেউ কেউ ক্ষমতার আধিপত্যও খাটান ক্যাম্পে। অশিক্ষা আর দারিদ্র্যকে পুঁজি করে এ ক্যাম্পের লোকজনকে মাদক বিক্রিসহ নানা অপরাধে যুক্ত করছে এই চিহ্নিত অপরাধীরা।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রীতিমতো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে জেনেভা ক্যাম্পের অপরাধীরা। ৫ আগস্ট এবং পরবর্তী সময়ে মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা থেকে লুট করা অস্ত্র দিয়ে গোলাগুলিতে জড়িয়েছে ক্যাম্পের একাধিক গ্রুপ। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ৭ জন নিহত আর কয়েক শ নারী-পুরুষ আহত হয়েছেন। এ ক্যাম্পে প্রায় দেড় হাজার অপরাধী মাদকসহ বিভিন্ন আপরাধ সিন্ডিকেটে জড়িত। ক্যাম্পে সশস্ত্র অপরাধীর সংখ্যা তিন শতাধিক।

জেনেভা ক্যাম্পে ৫ ঘণ্টা : বেলা সাড়ে ১১টা। জেনেভা ক্যাম্পের সামনের গেটে মোটরসাইকেল নিয়ে এসে থামলেন দুজন। তাদের একজন মোবাইল ফোনে কল করলেন। এর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ২০-২২ বছর বয়সি এক যুবক এসে তাদের ক্যাম্পের ভেতরে নিয়ে গেলেন। ১২টার দিকে ওই দুই যুবক ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যান। ক্যাম্পের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ওই দুই যুবক ঢাকা উদ্যান এলাকায় মাদকের ব্যবসা করেন। প্রায়ই জেনেভা ক্যাম্প থেকে এসে ইয়াবা ও গাঁজা নিয়ে যান।

দুপুর সোয়া ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত জেনেভা ক্যাম্পের এ-ব্লক ও বি-ব্লক ঘুরে মাদক বিক্রির নানা চিত্র দেখা গেছে। ক্যাম্পের এ-ব্লকের একটি গলিপথে দাঁড়িয়ে মাদক বিক্রি করছেন দুই যুবক ও তিন তরুণী। কথা বলে জানা যায়, তাদের কাছে ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ সব ধরনের মাদক আছে। কেউ বসে সেবন করতে চাইলে সেই ব্যবস্থাও করে দেন তারা। ক্যাম্পের এ-ব্লক, বি-ব্লকের অন্তত চারটি গলিতে মাদক ব্যবসা দিনরাত চলে। এ এলাকার মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রক পিচ্চি রাজা। তিনি ক্যাম্পে অবস্থান করেই মাদক ব্যবসা পরিচালনা করছেন। সূত্র জানায়, সোমবার রাতে পিচ্চি রাজা নেশাগ্রস্ত হয়ে চাপাতি নিয়ে ক্যাম্পের অন্তত ২০টি ঘরে হামলা চালিয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, ‘এ’ ও ‘বি’ ব্লকে রহস্যজনক কারণে পুলিশ অভিযান চালায় না। যে কারণে পিচ্চি রাজা, তার শ্বশুর খুরশিদ দেদার মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছেন এখানে।

বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ৪ ও ৭ নম্বর সেক্টরে ঘুরে দেখা যায় মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের আনাগোনা। ৭ নম্বর সেক্টরের একটি গলিতে দেখা যায় উচ্চৈঃস্বরে গান বাজছে। আশপাশে তরুণ-তরুণীদের ভিড়। মূলত এর আড়ালে বিক্রি হচ্ছে মাদক। ক্রেতারা আসছে, কিনে আবার চলে যাচ্ছে। নেই কোনো বাধা কিংবা ভয়ডর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্যাম্পের এক বাসিন্দা যুগান্তরকে জানান, ৯টি সেক্টরের সবকটিতেই চলে মাদক বাণিজ্য। অস্ত্রও পাওয়া যায় এখানকার কারও কারও কাছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক তরুণী যুগান্তরকে জানান, তিনি কমিশনে ইয়াবা বিক্রি করেন। এক পিস বিক্রি করলে পান ৫০ টাকা। তবে তিনি কার কাছ থেকে মাদক আনেন, তা জানাতে চাননি।

স্থানীয় বাসিন্দা কালু যুগান্তরকে জানান, একসময় ক্যাম্পের মাদক ও অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ছিল ইশতিয়াক ও পঁচিশের হাতে। ইশতিয়াক ভারতে করোনায় মারা যান, আর পঁচিশ নিহত হন ক্রসফায়ারে। এরপর থেকে বুনিয়া সোহেল ও চুয়া সেলিম গ্রুপের দুই ডজন মাদক ও অস্ত্র কারবারি ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে মারামারি-গোলাগুলি করে ক্যাম্পকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলে। বোমা ও গুলির আঘাতে নিহত হন অন্তত সাতজন। আর আহত হন নারী-শিশুসহ শতাধিক মানুষ।

সূত্র জানিয়েছে, চুয়া সেলিমের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ক্যাম্পের দুই, চার ও আট নম্বর সেক্টরে মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে জড়িত উলটা সালাম, সনু, সোহেল কসাই (গ্রেফতার), গাল কাটা মনু, কালা ইমরান, আরমান, আকরাম, গেইল হীরা, শান্ত, পিচ্চি রাজা, ফাট্টা আবিদ, পিস্তল নাঈম, শাহজাদা, ক্যালকাটা মনু, ইরফান, জিন্দা রনি ও কামাল। তাদের কেউ কেউ অস্ত্র চালনায় বেশ পারদর্শী।

অন্যদিকে বুনিয়া সোহেলের একক আধিপত্য সাত নম্বর ক্যাম্পে। বুনিয়া সোহেল গ্রেফতার হওয়ার পরও সক্রিয় রয়েছে তার সহচররা। তার হয়ে কাজ করছে কালো, আকরাম, বেজি নাদিম, টুনটুন, রানা, রাজন ওরফে কালু, কলিম জাম্বু, মোহাম্মদ আলী, আহম্মদ আলী ও আরিফ। বুনিয়া সোহেল সম্প্রতি গ্রেফতার হলেও তার অনুসারীরা তৎপর রয়েছে।

ক্যাম্পে ফেনসিডিলের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে পাকিস্তানি রাজু, হেরোইন বুনিয়া সোহেল, ইয়াবা চুয়া সেলিম আর গাঁজার ব্যবসা পরিচালনা করে টুনটুনের লোকজন। টুনটুন বুনিয়া সোহেলের ভাই।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ক্যাম্পে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সংগঠন স্ট্যান্ডেড পিপলস জেনারেল রিহ্যাবিলিটেশন কমিটি এসপিজিআরসিকে মাসোয়ারা দিয়ে চলে ক্যাম্পের মাদকের বাণিজ্য। তবে এ বিষয়ে এসপিজিআরসির আহ্বায়ক এম শওকত আলী মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, মাদক ব্যবসার আধিপত্যকে কেন্দ্র করে বিগত সময়ে সহিংসতা হচ্ছিল। ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। তবে মাদক বিক্রি এখনো বন্ধ হয়নি। এসপিজিআরসির ব্যাপারে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, যারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, তারাই এমন অভিযোগ করছেন।

এসপিজেআরসির যুগ্ম আহ্বায়ক ইকবাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ক্যাম্পের পরিস্থিতি আগের চেয়ে শান্ত। তবে মাদক ব্যবসা এখনো থামেনি।

সম্প্রতি যৌথ অভিযানে শতাধিক অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে বিস্ফোরক, আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র। গ্রেফতার করা হয়েছে বোমা ও দেশীয় অস্ত্র তৈরির কারিগরদের। ফলে ক্যাম্পে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরেছে।

ক্যাম্পে যাদের মানবেতর জীবনযাপন : মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসতঘরগুলো খুপরি বা গোডাউনের মতো। কিছু ঘর আবার দুই থেকে চারতলা। পাকা বাড়িগুলো ওপরে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। শিক্ষাবঞ্চিত ক্যাম্পের লোকজনের কেউ জরির কাজ, কেউ চুলকাটা, লেদ মেশিনের পার্টস তৈরি, কসাইগিরি, ইলেকট্রিকের কাজসহ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়ে জীবিকানির্বাহ করছেন। জেনেভা ক্যাম্পের প্রতিটি ঘর যেন একেকটি কুটিরশিল্প কারখানা। ছোট ছোট শিশু থেকে সত্তর-আশি বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও কাজ করেন। শিশুদের বিনোদন ভিডিও গেম ও ঘুড়ি ওড়ানো। বড়দের বিনোদন ক্যারম ও লুডু খেলা। নারীদের বিনোদন স্যাটেলাইট চ্যানেল। প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে দুর্বিষহ জীবনের আলাদা আলাদা গল্প।

জেনেভা ক্যাম্প ৯টি সেক্টর আর ৩০টি সরু গলিতে বিভক্ত। ঘিঞ্জি পরিবেশে এখানে বসবাসরত বাসিন্দাদের সংখ্যা ৫০ হাজারের কিছু বেশি। ক্যাম্পের গলিগুলো এতটাই সরু যে হাঁটতে গেলে গায়ে গা লাগে মানুষের। গলির ভেতরে আঁকাবাঁকা একাধিক সরু গলি। ৮ ফুট বাই ৮ ফুটের সাড়ে ৩ হাজার কক্ষ। দিনের বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকে না। গ্যাস না থাকায় কেরোসিন বা লাকড়ি দিয়ে রান্নাবান্না চলে ঘরের ভেতর। এ ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের জীবনে প্রাইভেসি বলে কোনো শব্দ নেই। খুপরি ঘরগুলোয় একেকটি পরিবারের রান্না, থাকা এবং ৮/১০ জনের রাত্রিযাপন। এরই মধ্যে থাকছে ছেলে, ছেলের বউ, মেয়েসহ জামাইও। টয়লেট-স্বল্পতার কারণে প্রতিদিন সকালে পুরুষ ও নারীদের লাইন ধরে যেতে হয় ৩০০ গজ দূরের পাবলিক টয়লেটে। ব্যবহার করতে হয় গণগোসলখানা। অনেক মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত এই বিহারি জনগোষ্ঠী। তাদের চেহারায়ও দেখা যায় অসুস্থতার স্পষ্ট ছাপ।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ রুহুল কবির খান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, শুধু মাদকমুক্ত নয়, যে কোনো ধরনের অপরাধ দমনের জন্য সেখানে পুলিশের দুটি ক্যাম্প স্থাপন করেছি। নিয়মিত অভিযানও চালানো হচ্ছে। অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে।

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *