Home অপরাধ চট্টগ্রাম ও আশপাশে সন্ত্রাসীদের বড় ‘প্রশ্রয়দাতা’ ছিলেন আওয়ামী গডফাদার আ জ ম নাছির
Oktober ২৬, ২০২৪

চট্টগ্রাম ও আশপাশে সন্ত্রাসীদের বড় ‘প্রশ্রয়দাতা’ ছিলেন আওয়ামী গডফাদার আ জ ম নাছির

শুধু চট্টগ্রাম নয়, আশপাশের জেলায়ও তাঁর সমান দাপট। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনের কোনো কমিটি তাঁর ইশারা ছাড়া হয়নি। বিভিন্ন কলেজ, ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে তাঁর আশ্রয়–প্রশ্রয়ে দাপিয়ে বেড়ায় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। ক্ষমতার দাপটে নিজেও বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসা–বাণিজ্যে ডালপালা মেলেছেন।

তিনি হলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। বলা হয়, ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী তাঁর শিষ্য। ২০১৫ সালে মেয়র পদে নাছিরের ‘একতরফা’ নির্বাচন সফল করতে এই শিষ্য চট্টগ্রামে মাস্তান পাঠিয়েছিলেন।

অপ্রতিরোধ্য ছিলেন আওয়ামী গডফাদার শাজাহান খান :

চট্টগ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্ররাজনীতির বড় নিয়ন্ত্রক আশির দশকের ছাত্রলীগের নেতৃত্বদানকারী আ জ ম নাছির উদ্দীন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ১১টি উপপক্ষের মধ্যে ৯টি তাঁর নিয়ন্ত্রণে। ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ, খুন, চাঁদাবাজি, হলের কক্ষ দখল, কর্মকর্তাদের মারধর, যৌন হয়রানি, ভাঙচুর ও শিক্ষক-ঠিকাদারদের হুমকির পেছনে ছিল নাছিরপন্থীদের আধিপত্য।

শেষ পাঁচ বছরে ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১৬৮ বার। এ ছাড়া সিআরবির জোড়া খুন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যায় নাছিরপন্থীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ছিল। তাদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দিতেন আ জ ম নাছির।

বড় দলের শীর্ষ নেতা হলেও ছোটখাটো সংগঠনের পদও ছাড়তে রাজি ছিলেন না তিনি। দল পরিচালনা এবং তৃণমূল কমিটি গঠন নিয়ে দলের ভেতরেও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ রয়েছে। আবার মেয়র থাকাকালে প্রকৌশলীকে থাপ্পড় মারা, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ৫ শতাংশ ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ তুলে সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর আমলে আগাম ৩৩ কোটি টাকা নিয়ে কাজ ফেলে ঠিকাদারের পলায়নের ঘটনাও ঘটে। সড়কবাতির কাজেও হয় অনিয়ম। বলা হয়, ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী তাঁর শিষ্য। ২০১৫ সালে মেয়র পদে নাছিরের ‘একতরফা’ নির্বাচন সফল করতে এই শিষ্য চট্টগ্রামে মাস্তান পাঠিয়েছিলেন।

গত এক দশকের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ ছিল ছাত্রলীগের ১১টি উপপক্ষের হাতে। ছাত্রলীগের দুটি পক্ষের নিয়ন্ত্রণ ছিল সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর। বাকিগুলো নাছিরের নিয়ন্ত্রণে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ক্যাম্পাস ছাড়েন ছাত্রলীগের এসব উপপক্ষের নেতা–কর্মীরা। ভিন্নমত দিলেই শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। ১৬৮ বার মারামারির ছাড়াও নিয়োগে প্রভাব বিস্তার, উপাচার্যের কার্যালয় ভাঙচুর, শাটল ট্রেনের চালককে অপহরণের ঘটনাও ঘটেছে অন্তত ৪০ বার।

জয়পুরহাটে খাদেম হতে চেয়ে ‘পীর’ হয়ে উঠেছিলেন আওয়ামী গডফাদার স্বপন :

অভিযোগ রয়েছে, আ জ নাছির উদ্দীনের সুপারিশেই অছাত্র হয়েও কমিটিতে পদ পেতেন তাঁর অনুসারীরা। এর মধ্যে অন্যতম শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক রাজু মুন্সি। চট্টগ্রামের সিআরবির জোড়া খুন মামলার আসামি রাজু মুন্সি চাঁদাবাজি, মারামারি ও কখনো শিক্ষককে মারার হুমকির মাধ্যমে আলোচনায় থেকেছেন। এ ছাড়া এককভাবে আবাসিক হল নিয়ন্ত্রণ করেছেন আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সায়েদুল ইসলাম, শামসুজ্জামান সম্রাট, সহসভাপতি প্রদীপ চক্রবর্তী, মইনুল ইসলাম, আবু বক্কর তোহা আর নাট্য ও বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক সাজ্জাদ আনম।

আবার মেয়র থাকাকালে প্রকৌশলীকে থাপ্পড় মারা, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ৫ শতাংশ ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ তুলে সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর আমলে আগাম ৩৩ কোটি টাকা নিয়ে কাজ ফেলে ঠিকাদারের পলায়নের ঘটনাও ঘটে। সড়কবাতির কাজেও হয় অনিয়ম।

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে শুরু করে ঠিকাদার—সবাই অতিষ্ঠ ছিলেন। অতিষ্ঠ হয়ে নির্মাণকাজও বন্ধ করতে হয়েছে ঠিকাদারদের। একাধিকবার মামলা ও অভিযোগ করে পরিত্রাণ মেলেনি। গত বছর ৯ এপ্রিল ছাত্রলীগের তিন নেতার বিচারের দাবিতে কর্মবিরতি পালন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি মোফাজ্জল হায়দার ইবনে হোসাইন ও সাদেক হোসেন আ জ ম নাছির অনুসারী।

এ ছাড়া একই বছর চাঁদা না দেওয়ায় প্রধান প্রকৌশলীকে মারধরের ঘটনায় অভিযুক্ত রাজু মুন্সির বিচার দাবি করে কর্মবিরতি পালন করেন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। একই বছর ৭ সেপ্টেম্বর চাঁদা না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এই ভাঙচুরে ৩ কোটি ২৯ লাখ টাকার ক্ষতি হয় বলে জানায় প্রশাসন। এ ঘটনায় করা মামলায় ছাত্রলীগের ১২ নেতা–কর্মীর ছয়জনই ছিলেন নাছিরের অনুসারী।

আওয়ামী গডফাদার কাদের মির্জার কথায় চলত সব, অসহায় ছিল প্রশাসন :

এ ছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক) ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘদিন ধরে নাছিরের হাতে। পাঁচ বছর ধরে এখানে ছাত্রলীগের আরেকটি পক্ষ সক্রিয় হয়। ওই পক্ষ নিজেদের মহিবুল হাসান চৌধুরীর বলয়ভুক্ত হিসেবে পরিচয় দিত। দুই পক্ষের মধ্যে কয়েকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় চমেকে। একইভাবে চট্টগ্রাম আইন কলেজ এবং সরকারি কমার্স কলেজের ছাত্ররাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করতেন নাছির উদ্দীন। আ জ ম নাছির উদ্দীনের অস্ত্রধারীদের মধ্যে সাইফুল আলম ওরফে লিমন, আলমগীর টিপু, ইকবাল টিপু, মো. ফিরোজ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর এসরারুল হক, আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের অন্যতম। জুলাই–আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মাঠে ছিলেন ফিরোজ ও এসরারুল।

অস্ত্রবাজিতে নাছিরের অনুসারীরা :

আ জ ম নাছির উদ্দীনের অস্ত্রধারীদের মধ্যে সাইফুল আলম ওরফে লিমন, আলমগীর টিপু, ইকবাল টিপু, মো. ফিরোজ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর এসরারুল হক, আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের অন্যতম। জুলাই–আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মাঠে ছিলেন ফিরোজ ও এসরারুল।

১৬ জুলাই মুরাদপুরে ফিরোজ এবং ৪ আগস্ট চান্দগাঁও থানা এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর এই দুজন গুলি ছোড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফিরোজের অস্ত্রহাতে ছবিও পত্রিকায় এসেছে। সংঘর্ষের ঘটনায় হওয়া অন্তত পাঁচটি মামলায় এই দুজনকে আসামি করা হয়েছে।

আওয়ামী গডফাদার তাহেরের ‘সাম্রাজ্যে’র নতুন অধিপতি ছিলেন ছেলে টিপু :

নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (গণমাধ্যম) কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, ফিরোজ, এসরারুল হকসহ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। একইভাবে চট্টগ্রাম আইন কলেজ এবং সরকারি কমার্স কলেজের ছাত্ররাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করতেন নাছির উদ্দীন।

ফিরোজ একসময় ছাত্রশিবিরের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবং ২০১৩ সালের জুলাই মাসে অস্ত্রসহ দুবার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল। ২০১৪-১৫ সালের দিকে তিনি নিজেকে যুবলীগ নেতা হিসেবে নগরের বায়েজিদ এলাকায় বিলবোর্ড টানান। বিলবোর্ডে আ জ ম নাছির ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা দিদারুল আলমের ছবি ছিল। ফিরোজ এখনো নাছিরের বলয়ভুক্ত।

এসরারুল হকও আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। তিনি চান্দগাঁও ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তাঁর বিরুদ্ধে আগে থেকেই অস্ত্রবাজির অভিযোগ রয়েছে। তিনি এলাকায় একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের নেতৃত্ব দেন। তিনি কিশোর গ্যাং লিডার হিসেবেও পুলিশের তালিকায় রয়েছেন।

২০১৩ সালের জুনে সংঘটিত সিআরবির জোড়া খুন মামলার আসামি সাইফুল আলম ওরফে লিমন। নিউমার্কেট এলাকায় গত ৪ আগস্ট আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ঘটনায়ও আসামি এই লিমন। এ ছাড়া নাছিরপন্থী ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন ও উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের নিছার আহমেদ ওরফে মঞ্জুকেও এই মামলায় আসামি করা হয়।

এ ছাড়া নাছির অনুসারী কাউন্সিলরদের মধ্যে উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের জহুরুল হক জসিমের বিরুদ্ধে এলাকায় পাহাড় কাটা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। নাছিরের প্রশ্রয়ে জসিম ছিলেন বেপরোয়া। তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত পাঁচটি মামলা রয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের গাড়ি লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে মারার অভিযোগে একটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

বিতর্কিত ভোটে মেয়র এবং অনিয়ম :

২০১৫ সালে তৎকালীন মেয়র মনজুর আলমকে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে হারিয়ে প্রথমবার মেয়রের চেয়ারে বসেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। ফেনীতে নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী নির্বাচনে আধিপত্য বিস্তার ও ভোট চুরির জন্য দলে দলে সন্ত্রাসী পাঠিয়েছিলেন। ফলে দুপুর ১২টার মধ্যে মনজুর আলম নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

পাঁচ বছর মেয়র থাকাকালে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে নাছিরের বিরুদ্ধে। এ কারণে ২০২০ সালে দ্বিতীয়বার আর মনোনয়ন পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। মেয়র থাকাকালে আ জ ম নাছির উদ্দীনের বিরুদ্ধে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের এক প্রকৌশলীকে নগর ভবনে থাপ্পড় মারার অভিযোগ ওঠে। পোর্ট কানেকটিং (পিসি) সড়ক সম্প্রসারণের একটি জায়গা নিয়ে সিটি করপোরেশন ও গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটে।

কাজ শেষ করার আগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৩৩ কোটি টাকা দেওয়ার অভিযোগও ছিল মেয়রের বিরুদ্ধে। ‘টাকা নেই’ অজুহাতে কাজ বন্ধ রেখেছিলেন ঠিকাদার। ‘দরদ’ দেখিয়ে ঠিকাদারকে অন্য প্রকল্প থেকে আট কোটি টাকা দিয়ে দেয় সিটি করপোরেশন। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম নগরের গুরুত্বপূর্ণ দুটি উন্নয়ন প্রকল্পে ঠিকাদারদের এ সুবিধা দেওয়া হয়। টাকা নিয়ে মাঝপথে কাজ ফেলে চলে গেছেন ঠিকাদারেরা। প্রকল্প দুটি হচ্ছে পোর্ট কানেকটিং (পিসি) সড়কের উন্নয়ন এবং মহেশ খালের পাশে বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণ।

৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের দুটি অংশের কাজ পেয়েছিল মেসার্স রানা বিল্ডার্স ও মেসার্স রানা বিল্ডার্স-ছালেহ আহম্মদ নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্প কাজের যাবতীয় কাজ করত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘ছালেহ আহম্মদ’। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার পীরযাত্রাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাকির হোসেন।

এই কাজের জন্য ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের কুমিল্লা শাখা থেকে ঋণ নেয় দুটি প্রতিষ্ঠান। শর্ত ছিল প্রতিষ্ঠান দুটির প্রাপ্য টাকার চেক ঠিকাদারদের পরিবর্তে ব্যাংকের প্রতিনিধিকে দেওয়ার; কিন্তু সিটি করপোরেশন নিজেই এই শর্ত ভঙ্গ করে ২৫ কোটি টাকার ১৪টি চেক সরাসরি ঠিকাদারকে তুলে দিয়েছে।

স্বেচ্ছাচারিতা :

২০১৩ সালে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন আ জ ম নাছির উদ্দীন। একই কমিটির সভাপতি ছিলেন তৎকালীন মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ২০১৭ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর থেকে দলের একক নিয়ন্ত্রণ যায় নাছিরের হাতে। তখন মহিউদ্দিনপন্থীদের বিপরীতে দলে নিজের বলয় প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এ নিয়ে বিরোধ চাঙা হয়ে ওঠে। সব৴শেষ এ বছরের ২০ জুন থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বর্ধিত সভায় যুগ্ম সম্পাদক ও সদ্য বিদায়ী মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে প্রকাশ্যে বিতণ্ডায় জড়ান নাছির।

ওই সময় রেজাউল করিম অভিযোগ করেছিলেন, দলের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে নাছির নিজের ইচ্ছেমতো স্বেচ্ছাচারী মনোভাব নিয়ে নাছির নগরের ওয়ার্ড, থানা ও ইউনিট কমিটি গঠন করেছেন। এসব কমিটিতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয়নি।

চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার (সিজেকেএস) সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আ জ ম নাছির উদ্দীন এক যুগের বেশি সময় নেতৃত্ব দেন। ২০১১ সালে তিনি প্রথম তখনকার সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমানকে হারিয়ে কর্তৃত্ব নেন। এরপর আরও তিন দফায় একই পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ঝামেলা এড়াতে তাঁর বিরুদ্ধে কেউ প্রার্থী হননি।

চট্টগ্রাম কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির পদ নিতে জালিয়াতিতে অংশ নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে নাছিরের বিরুদ্ধে। পরপর তিনবার এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন। এরপর ওই পদে তাঁর বড় ভাই সাইফুদ্দিনকে সভাপতি করা হয়। প্রায় সাড়ে চার হাজার সদস্যের এই সমিতিতে থাকাকালে এলাকার জায়গা বেচাকেনা, অংকুর সোসাইটি স্কুলে ভর্তিবাণিজ্যসহ নানা সুবিধা পাওয়া যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

আ জ ম নাছির চট্টগ্রাম ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের সভাপতি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক হিসেবেও রয়েছেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরও তিনি পদ ছাড়েননি।

ছাত্র–জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর আ জ ম নাছির উদ্দীন আত্মগোপনে চলে যান। তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য ফোনে যোগাযোগ করা হলেও পাওয়া যায়নি। সব সময় ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা, তাঁর অনুসারী ছাত্রদের মারামারি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো নাছির উদ্দীনের নামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে ছিল।

নাছিরের রাজনীতিতে উত্থান :

আশির দশকের শুরুতে আ জ ম নাছির উদ্দীন আওয়ামী রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৭৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হন। একই সময়ে নগর ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ ও ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৮৩ ও ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। একসময় তিনি নগরের ছাত্ররাজনীতিতে একটি গ্রুপ তৈরি করেন। এরপর ধীরে ধীরে তা আওয়ামী রাজনীতিতে ছড়িয়ে দেন।

নাছির উদ্দীন পরপর দুবার নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। নভেম্বর ২০১৩ সালে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হন। সেই কমিটি এখনো বহাল রয়েছে।

আ জ ম নাছির উদ্দীনের কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, সব সময় ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা, তাঁর অনুসারী ছাত্রদের মারামারি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো নাছির উদ্দীনের নামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে ছিল। ছাত্রদের সুনাগরিক ও সুরাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে না তুলে তাঁদের দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার দায় এড়াতে পারেন না তিনি। এ কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছাত্রদের পড়ালেখার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়েছে। একজন রাজনীতিবিদের কাছ থেকে এটা কাম্য নয়।

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *