‘স্বৈরশাসকরা প্রবাসে বসে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন’
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেলাল মহিউদ্দীন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির মন্টক্লেয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কর্মরত। তার একটি লেখা আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে পোস্ট করেছেন। যেখানে কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিবাজ শাসক, স্বৈরাচার সরকাররা কীভাবে ফিরে আসতে চায় তানিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
লেখাটি পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো:
১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের ২০২৪ সালের মতোই একটি গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছিল ফিলিপাইনে। কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিবাজ শাসক ফার্দিনান্দ মার্কোস সপরিবারে পালিয়ে গেলেন হাওয়াই। ফার্স্ট লেডি ইমেলদা ছিলেন সবিশেষ ঘৃণিত চরিত্র। মার্কোসের পতনের কালে ইমেলদা বিশ্ব সংবাদের শিরোনাম হয়েছিল ফ্যান্সি-হিল ফেটিশিজমের কারণে। তার সংগ্রহের কয়েক হাজার জোড়া বিশ্বসেরা ব্র্যান্ডের দামি জুতা অনেক ম্যাগাজিনের শিরোনাম হয়েছিল।
মার্কোস পরিবারের বিরুদ্ধে গণরোষ ও গণঘৃণার প্রাবল্য দেখে ধরে নেওয়া হয়েছিল পরিবারটি আর কস্মিনকালেও ফিলিপাইনের রাজনীতিতে ফিরতে পারবে না। এখন বাংলাদেশে যেরকম অনেকেই ভাবেন আওয়ামী লীগ একসময় মুসলিম লীগ হয়ে যাবে। ভাবনাটি ভুল। ফিলিপাইনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বংবং মার্কোস ফার্দিনান্দ-ইমেলদার দ্বিতীয় সন্তান। মার্কিন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এখনো বহাল রয়েছে বংবং-ইমেলদার বিরুদ্ধে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ৩৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ না করার কারণে এই পরোয়ানা।
আলফ্রেড ম্যাক্অয়ের সম্পাদনায় ২০০৯ সালে একটি বই বেরোয়। বইটির নাম অ্যান অ্যানার্কি অব ফ্যামিলিজ: স্টেট অ্যান্ড ফ্যামিলিজ ইন দ্য ফিলিপিন্স। বইটি পাঠ করতে গিয়ে পাঠকের মনে হতে পারে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সম্ভবত ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোসের কীর্তিকেও ছাড়িয়ে নতুন রেকর্ড গড়ে যেতে চেয়েছিলেন। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে ‘টাকায় কথা কয়’ এবং ‘টাকাই দ্বিতীয় খোদা’।
ফার্দিনান্দ-ইমেলদার বিদেশে পাচার করা কয়েক বিলিয়ন ডলার ১৯৮৭ সাল থেকেই কাজে লাগতে শুরু করল। মূলত টাকার জোরেই চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজনীতিতে ফিরলেন ইমেলদা। ২০১৯ সাল পর্যন্ত চারবার পার্লামেন্ট কাঁপানো নির্বাচিত সংসদ সদস্যও থাকলেন।
দুর্নীতির কামাই রাজনীতিতে ইমেলদার আসন পোক্ত করল আরো চারটি উপায়ে। এক, দেশে এসে বিচারের মুখোমুখি হতে পারা। দুই, ফের রাজনীতিতে ফেরার আইনি বৈধতা জোগাড় করা। তিন, আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনীতে রেখে যাওয়া দুর্নীতিবাজ সুবিধাভোগীদের পুনঃসংগঠিত করতে পারা। চার, ঘুষ-উৎকোচ দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকদের কিনে ফেলতে পারা।
১৯৯১ সালে হাইতির স্বৈরশাসক জাঁ ব্রার্ট্রান্ড আরিস্টিডও দেশব্যাপী গণঘৃণা ও জনবিদ্রোহের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। মাত্র তিন বছর পর ১৯৯৪ সালে আবার তিনি স্বদেশে ফেরেন। ক্ষমতাও ফিরে পান। তার ফিরে আসতে পারাও ঘটেছে ওপরের চারটি কারণে। মার্কোসদের মতোই তিনি বিদেশে জমান দুর্নীতির কামাই। আরেকটি ক্রীড়নক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদ।
আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগও একই পথে এগোচ্ছে। সম্প্রতি ‘স্ট্রিক গ্লোবাল ডিপ্লোম্যাসি’ নামে সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ দিয়েছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। উদ্দেশ্য যেভাবেই হোক যুক্তরাষ্ট্রের মন গলানো।
সমর্থিত-অসমর্থিত সব সূত্রে এটা সবার জানা, আওয়ামী লীগ ষোলো বছরে দেশের বাইরে ১৫০ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। একটি পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একজন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানালেন, ‘দুই হাতে টাকা বানাতে বলতেন শেখ হাসিনা।’ শেখ হাসিনার এক গৃহভৃত্যের বরাতে জানা গেল, তিনি তার জন্মদিনে টাকা ছাড়া অন্য কোনো উপহারই নিতেন না। প্রতিদিনই দলীয় নেতা-কর্মীদের অর্থ ও দেশীয় সম্পদ আত্মসাতের ঘটনা চাউর হচ্ছে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সম্পদের ফিরিস্তি এতটাই অচিন্তনীয় ও অশ্রুতপূর্ব যে পড়তে পড়তে বা শুনতে শুনতেই শরীরে ক্লান্তি-অবসাদ নেমে আসে। পাঠক-শ্রোতার চোখে ঘুম নেমে আসে, কিন্তু সম্পদবিবরণীর তালিকা-বর্ণন শেষ হয় না। প্রায়ই ভাবতে বাধ্য হই, তাঁদের একেকটি দিন কি চব্বিশ ঘণ্টায়, নাকি দুই শ চল্লিশ ঘণ্টায়? এত অল্প সময়ে এত বিত্ত-সম্পদ চুরি-ডাকাতি, দখল-আত্মসাৎ, খুনখারাবি কীভাবে সম্ভব?
টাকায় বাঘের চোখও মেলে। বিদেশে গড়া মাফিয়া অর্থনীতি ব্যবহার করে ইমেলদার পদ্ধতিতেই আওয়ামী লীগ দেশের রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টা করতে পারে। পানামার নরিয়েগা জেলে বসেই এবং পেরুর ফুজিমোরি নির্বাসনে থেকেই পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার প্রায় কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। আরব বসন্তের প্রথম উৎখাতের শিকার তিউনিসিয়ার বেন আলী সৌদি আরবে নির্বাসনে থেকেই দেশের রাজনীতিতে ফেরার প্রায় সব আয়োজনই করে ফেলেছিলেন।
সবারই সাঙ্গপাঙ্গ-সহযোগীদের মাফিয়া অর্থনীতি দারুণ কাজে লেগেছে। শেষ পর্যন্ত শেষোক্তরা ব্যক্তিগত সাফল্য না পেলেও তাদের রাজনীতি ও সমর্থন বাড়িয়ে তুলতে পেরেছেন। অন্যদিকে, ২০১৯ সালে উৎখাত হওয়া সুদানের ওমর আল বশির অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেলেন না। কারণ, তিনি দুর্নীতির কামাই ও বিদেশে ধনসম্পদ পাচার বিচারে অন্যদের ধারেকাছেও নন। ইমেলদার ফেরা আরো সহজ হয়েছিল ১৯৮৯ সালে ফার্দিনান্দের মৃত্যুতে। মৃত্যুটি ফিলিপাইনিদের মাঝে একধরনের ‘আহারেউহুরে’ সহানুভূতি তৈরি করে।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগ অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে একটি দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছে। পোস্টটির ভাষ্য—প্রয়োজনে দলটি আরেকটি যুদ্ধ করবে। ‘প্রয়োজনে’ মানে ‘সম্ভাবনা’ বা ‘দরকার’। দলটি কি বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে? কেন করবে? যুদ্ধের হুংকারটি কি অন্য গণতান্ত্রিক দলগুলোর বিরুদ্ধে? সংস্কার চলছে। নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। সেনাপ্রধানের আঠারো মাসের মধ্যে নির্বাচন ঘোষণাকে সজীব ওয়াজেদ জয় স্বাগতও জানিয়েছেন। দেশের ভেতরের নেতা–নেত্রীরা ধারণা দিয়েছেন, দলটি নির্বাচন করবে। নির্বাচনের জন্য দল গোছানোর কথা। তাহলে যুদ্ধ ঘোষণা কেন? কারণ কি এটিই যে প্রবাসে বসেই দল গুছিয়ে ফেলতে বা গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে বসতে যা কিছু টাকাকড়ি দরকার, তার চাইতে অনেক বেশিই দলটির ভান্ডারে আছে?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই টিপ্পনী কেটেছে ‘দলটি ভারতের হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।’ ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীরা লিখছেন—যুদ্ধ ঘোষণার কী আছে! নানা ফ্রন্টে নানা কৌশলে দলটি প্রতিদিনই তো তাদের যুদ্ধ চালাচ্ছে। কখনো পাহাড়, কখনো সংখ্যালঘু; কখনো আনসার বিদ্রোহ, শ্রমিক আন্দোলন, মব জাস্টিস, খুনখারাবি, অন্তর্ঘাত, অপতথ্য ও গুজব উৎপাদন—সব ফ্রন্টেই তো একাগ্র যুদ্ধে মেতে রয়েছে দলটি! তাহলে এটি কি আরো বড়সড় একটি গৃহযুদ্ধের ঘোষণা।
ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে আমলে নেব না। কিন্তু দুনিয়াজোড়া পতিত স্বৈরাচার কী করেছে বা করতে পারে বিষয়ক ওপরের উদাহরণগুলো থেকে কিছু শিক্ষা অবশ্যই নেব। প্রথম শিক্ষাটি হবে—দলটির যুদ্ধ ঘোষণা ও হঠাৎ গর্জে ওঠা অবস্থানকে হালকাভাবে নিলে বাংলাদেশকে বিপদে পড়তে হবে। অনেক দেশেই স্বৈরশাসক-সৃষ্ট মাফিয়ারা প্রবাসে বসে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকেই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে।
উদাহরণ মেক্সিকো, কলম্বিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, উগান্ডা, সুদান, জিম্বাবুয়ে ও নাইজেরিয়া। এসব দেশেও জনগণ ভেবেছিল, পতিত লুটেরাদের দলগত উত্থান আর কখনোই সম্ভব হবে না। পাকিস্তানেও দুর্নীতিগ্রস্ত পতিত সরকারই ফের ক্ষমতায় ফিরেছে। ভারতের রাজনীতির এক বড় অংশও নিয়ন্ত্রিত হয় দুবাইয়ে থাকা ভারতীয় আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়াদের দ্বারা।
অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনীতি-সংস্কারের কর্মসূচি কী কী আমরা নিশ্চিত নই। তবে বাংলাদেশকে যে কোনো রাজনৈতিক সংঘাত–সহিংসতা থেকে দূরে রাখার প্রয়োজনে মূল লক্ষ্য হওয়া দরকার রাজনীতি থেকে মাফিয়াতন্ত্রের সমূল উৎপাটনের ব্যবস্থা রাখা।’