যে কারণে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে ডিমের দাম দ্বিগুণ
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষকে দ্বিগুণ দামে ডিম কিনতে হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে একটি ডিম কিনতে হয়েছে ১০ টাকার বেশি দামে। তা এখন বেড়ে হয়েছে প্রতি পিস ১৫ টাকা। আর ভারতে একটি ডিমের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭ থেকে সাড়ে ৭ টাকা।
এদিকে বাংলাদেশে বন্যার কারণ দেখিয়ে ক্ষুদ্র খামারিরা জানান, ডিমের চাহিদা বাড়লেও দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যায় পোল্ট্রি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে দৈনিক প্রায় ৫০ লাখ ডিমের উৎপাদন কমে গেছে। এর ফলে ডিমের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
তারা বলেন, একটি ডিমের দাম ১১ টাকা ৮৭ পয়সা বেঁধে দেয় কৃষি বিপণন অধিদফতর। কিন্তু তাতেও বাজার নিয়ন্ত্রণে না এসে উল্টো দাম আরো বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতিতে সরকার সাড়ে ৪ কোটি পিস ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ফার্মের প্রতি ডজন ডিমের জন্য দোকানভেদে এখনও ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা গুণতে হচ্ছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতি পিস ডিমের দাম ১৩ শতাংশ এবং এক বছরে ২০ দশমিক ৪১ শতাংশ বেড়েছে।
ভারতের চেয়ে দাম বেশি যে কারণে
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, ডিম ও মুরগির উৎপাদনে ৭৫ শতাংশ খরচ খাবারের। ভারত ও বাংলাদেশে এই খরচের পার্থক্য অনেক বেশি জানিয়ে সংগঠনের নেতারা বলেন, খাবারের দাম কমালেই কেবল ডিম ও মুরগির দাম কমানো সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ভারতে প্রতি কেজি ফিডের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৬ টাকা, আর আমাদের দেশে দাম ৬০ টাকা, প্রায় দ্বিগুণ। ভারতে বাচ্চার দাম ২৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ টাকা, আমাদের দেশে বর্তমানে ৮০ টাকা। কখনও কখনও ১২০ টাকা পর্যন্ত দাম উঠে যায়।
ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে মুরগির ওষুধের দামও তিনগুণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ভারতে ৮২ টাকা, বাংলাদেশে তা কেন ১৭০ টাকা হবে। এর প্রধান কারণ, পোল্ট্রি খাদ্যের দাম। পোল্ট্রি খাদ্যশিল্পে ‘সিন্ডিকেট’ রয়েছে।
সাধারণত, ডিম উৎপাদনের জন্য খামারিদের একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা কিনে লালন–পালন করতে হয়। গত জুনের প্রথম সপ্তাহে ভারতে একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দাম ছিল প্রতিটি ৩৫ থেকে ৫৬ টাকা। পাকিস্তানে ছিল ২১ থেকে ৪২ টাকা। বাংলাদেশে মুরগির বাচ্চার দাম ৭৪ থেকে ৮০ টাকা।
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতে প্রতি ডজন ডিমের দাম ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১ থেকে ৯৬ টাকা। পাকিস্তানে ছিল ৭৩ থেকে ১১৮ টাকা। বাংলাদেশে ওই সময় ডিম বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকায়।
পোল্ট্রি খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে খামারে মুরগি পালন করা হয়। ট্যারিফ কমিশনের সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রতি কেজি মুরগির খাবারের (লেয়ার গ্রোয়ার) দাম ছিল ৫৭ থেকে ৫৯ টাকা। ভারতে ছিল ৩৭–৪৮ টাকা। পাকিস্তানে ছিল ৩৯ থেকে ৪১ টাকা। বাংলাদেশে গড় দাম ভারতের চেয়ে ৩৭ ও পাকিস্তানের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেশি।
এছাড়া পোল্ট্রি খাদ্যের মূল উপকরণ ভুট্টা, সয়াবিন ইত্যাদি ভারত ও পাকিস্তান অনেকটাই উৎপাদন করে। বাংলাদেশকে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যয় বেশি। আমদানিতে জাহাজ ভাড়া ও অগ্রিম আয়কর বাবদ ব্যয়ও আছে।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুরগির ডিম উৎপাদন খরচের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ যায় পোল্ট্রি খাদ্যের দামের পেছনে।
অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ডিমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। হাতবদল ও চাঁদাবাজির জন্য ডিমের দাম বেড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
শুক্রবার (১১ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে ডিম দিবসের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, সিন্ডিকেটের কারণেই ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে। ডিমের দাম বাড়ার মূল কারণ সিন্ডিকেট।
চাঁদাবাজির কারণে ডিমের দাম বাড়ছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, বছরের আশ্বিন-কার্তিক মাসে সবজির সরবরাহ কমে যাওয়ায় ডিমের চাহিদা বাড়ে। ডিম সাধারণ খামারি থেকে কয়েক দফা হাত বদল হয়ে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছায়। এ কারণেই ডিমের দাম বেড়ে যায়। এজন্য উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সরাসরি কীভাবে ডিম পৌঁছানো যায়, সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা চলছে।
তিনি বলেন, বন্যার কারণে দেশের অনেক খামার নষ্ট হয়েছে। এসব খামার উৎপাদনে যেতে কিছুটা সময় লাগছে। সব মিলিয়ে সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে। এদিকে পোল্ট্রি মালিকরা বলছেন, মুরগির বাচ্চা ও খাবারের দাম নিয়েও ‘কারসাজি’ চলছে। সেই দিকে সরকারের মনোযোগ দেওয়া উচিত।
ব্যবসায়ীদের অনেকে বলছেন, বৃষ্টি ও বন্যায় মুরগির খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে কারণে সরবরাহে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় ডিমের দাম বেড়েছে। এছাড়া ডিম উৎপাদনের খরচ বেড়েছে।
ডিম ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিমের দাম বৃদ্ধির আরেকটি কারণ খাবার ও বাচ্চার দাম বেড়ে যাওয়ায় অসংখ্য খামার বন্ধ রয়েছে। এছাড়া দেশের একটি বড় অংশে পাহাড়ি ঢলজনিত কারণে বন্যায় খামার ভেসে গেছে এবং আবহাওয়াজনিত কারণে উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল বলেন, বন্যায় মোট ডিমের অন্তত ৩০ শতাংশ উৎপাদন কমেছে। আর ব্রয়লারে যেমন এক দেড় মাসেও সংকট কাটানো যায়, কিন্তু লেয়ার বাচ্চা দেওয়া শুরু করে পাঁচ-ছয় মাস পর। লেয়ারের বাচ্চা কিনতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বাচ্চা পেতে ছয় মাস আগে অর্ডার দিয়ে পেছনে-পেছনে ঘুরতে হয়। ফিডেরও দাম বেশি। এসব কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, সাম্প্রতিক বন্যায় হাজার হাজার খামার একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে পানির জমে থাকার কারণে কম দামে দ্রুত মুরগি বিক্রি করে দিয়েছেন। কারও কারও মুরগি মরে যাওয়ার কারণে পুঁজি হারিয়েছেন। সব মিলেই ডিমের উৎপাদন কমে গেছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে ডিমের খামার রয়েছে ১৩ হাজার। গত দুই বছরে ৬ হাজারের মতো খামার বন্ধ হয়েছে।
ব্রিডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক বন্যার কারণে ডিমের উৎপাদন কমেছে। একসময়ে বাজারে সবকিছুর দাম বেশি হওয়ার ক্রেতাদের মধ্যে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে ডিমে।
ডিমের উৎপাদন খরচ আসলে কত?
বাংলাদেশ অ্যানিম্যাল অ্যাগ্রিকালচার সোসাইটির (বিএএএস) তথ্য অনুযায়ী, দুই বছর আগে খামারে মুরগির একটি ডিম উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১০ টাকা ৪৪ পয়সা।
২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত উৎপাদন ও বাজারের দামের তথ্য বিশ্লেষণ করে সংগঠনটি বলছে, ২০২২ সালে একটি ডিম উৎপাদনে খাবারের (ফিড) খরচই প্রায় ৮০ শতাংশ। ২০১৩ সালে প্রতি কেজি ফিডের দাম ছিল ১৫ টাকা, ২০২২ সালে সেটি ৫৮ টাকায় দাঁড়ায়। পাশাপাশি বাচ্চা ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও পরিবহনে বাড়তি ব্যয় বেড়েছে।
সাধারণত একটি ডিম উৎপাদনে প্রতিটি মুরগি ১২০ গ্রাম খাবার খায়। গড়ে প্রতি কেজি ফিডের দাম ২০২২ সালের ৫৮ টাকা হিসাবে শুধু ফিডে খরচ ছিল ৬ টাকা ৯৬ পয়সা। তবে শতভাগ মুরগি ডিম দেয় না, দেয় ৮০ শতাংশ। ফলে গড়ে একটি ডিমে ফিডের খরচ ৮ টাকা ৭০ পয়সা। বাকি ২০ শতাংশ খরচ ওষুধ, বাচ্চা কেনা, অবকাঠামো, খামারের খরচ, লেবার খরচ ছাড়াও অন্যান্য খরচ আছে। সে হিসাবে লাগে আরও ১ টাকা ৭৪ পয়সা। ফলে মোট খরচ ১০ টাকা ৪৪ পয়সা।
একটি একদিনের বাচ্চা কেনার পর সেটি পাঁচ মাস খাবার খায়। এরপর গড়ে ২৪ মাস ডিম দেয়। এরপর ক্রমান্বয়ে এর ডিম দেওয়ার ক্ষমতা কমে আসে। তখন সেগুলো খামারিরা বাজারে বিক্রি করে দেন মাংসের মুরগি হিসেবে।
মুরগির খাবারের প্রধান উপকরণ ভুট্টা ও সয়াবিন। বিএএএস’র তথ্য বলছে, ২০২২ সালে দেশে এক কেজি ভুট্টার দাম ছিল ৪০ টাকা; যা ২০১৩ সালে ১৮ টাকা ছিল। একইভাবে সয়াবিনের দাম ২০ টাকা থেকে বেড়ে হয় ৭০ টাকা। এছাড়া একই সময়ে চালের কুড়ার দাম ৪০০ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি ৮ টাকা থেকে ৩২ টাকায় উঠেছে।
ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে মুরগির খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত ২২টি উপকরণের মধ্যে ১৯টির দাম বেড়েছে। এর মধ্যে ১৫টি উপকরণের মূল্য দ্বিগুণ হয়েছে। এছাড়া ডলারের দাম ৯৪ টাকা থেকে ১২০ টাকা হয়েছে।