আওয়ামী লীগের ফিরে আসা
প্রায় ষোলো বছর ধরে বাংলাদেশে টানা শাসনকে হাসিনার মস্ত কৃতিত্ব বলে প্রচার করা হতো। সমস্ত ভিন্নমত ও বিরোধীদেরকে কূটকৌশল ও নিষ্ঠুর পন্থায় পায়ের তলায় পিষে ফেলাকে বলা হতো হাসিনার রাজনৈতিক সাফল্য। জাতীয় স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে চীন, রাশিয়াসহ গুটিকয়েক শক্তিশালী অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে বাংলাদেশে ব্যবসা ও প্রকল্প করতে দিয়ে এবং ভারতের সব ধরণের চাহিদা পূরণ করে তাদের সঙ্গে দহরম মহরম বজায় রাখাকে দক্ষ কূটনীতি বলে বাহবা দিতো হাসিনার মোসাহেব দল।
দেশের ইতিহাসের নজিরহীন ছাত্রগণঅভ্যুত্থানে হাসিনার পতন এবং তার দোসরদের প্রায় সবাইকে অসহায় অবস্থায় ফেলে ইন্ডিয়ায় পালিয়ে যাবার পর আগেকার সব কীর্তিগাথা পুরোপুরি উলটে গেছে। এর আগে হাসিনার যে-সব কাণ্ডকীর্তিকে তার কৃতিত্ব হিসেবে দেখানো হতো মূলতঃ সেগুলোই যে এই বিপর্যয়ের প্রধান প্রধান কারণ ছিল তা সবার সামনে পরিস্কার হয়ে যায়।
সত্যিকারের কোনো গণতান্ত্রিক বা রাজনৈতিক পন্থায় হাসিনা ক্ষমতায় আসেননি। তার ক্ষমতারোহনের ইতিহাস চক্র-চক্রান্ত, নাশকতা, অন্তর্ঘাত ও যোগসাজসেরই ইতিবৃত্ত। দেশের মানুষকে ঘৃণা-বিদ্বেষের বিষে জর্জরিত ও বিভাজিত করে সংঘাত বাধিয়ে তাদের রক্তে সিক্ত পথে তিনি এগিয়েছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের নামে তার সর্বশেষ নৈরাজ্য লগি-বৈঠার তাণ্ডবে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল। এর পরিণতিতে এক-এগারোর কিম্ভূতকিমাকার অগণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তিত হয়। তখনকার সেনাকর্তৃত্বের সঙ্গে গুপ্ত যোগসাজস তাকে ক্ষমতাসীন করে এক নির্বাচনি মহড়ার মাধ্যমে।
অরাজনৈতিক পন্থায় ক্ষমতাসীন হবার কারণে আওয়ামী লীগের নয়, শুধুমাত্র হাসিনার করায়ত্ত হয় রাষ্ট্রক্ষমতা। পুরোপুরি মানসিক সুস্থতাহীন ‘রং হেডেড’ হাসিনা এই ক্ষমতাকে কারো সঙ্গে ভাগাভাগি না করে নিজে পুরো ডিক্টেটর হয়ে বসেন এবং একব্যক্তির এই কর্তৃত্ববাদকে নিজের কৃতিত্ব বলে ধরে নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে তা’ উপভোগ করতে থাকেন। তিনি রাজনীতি ধ্বংস করে দেন। আদর্শবাদিতাকে বিসর্জন দেন। দলকে তার স্তাবক ও অনুগত ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীতে পরিণত করেন। প্রশাসন, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী, এমনকি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে পর্যন্ত তার জবাবদিহিশূণ্য ও জনসম্মতিহীন ক্ষমতার পাহারাদার হিসেবে অপব্যবহার করতে থাকেন। রাষ্ট্রের সব প্রথা-প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেন এবং বিচারবিভাগকে তার ইচ্ছাপূরণের দাস ও মিডিয়াকে তার তাঁবেদারে পরিণত করেন। জাতীয় ইতিহাসকে বিকৃত করে ফরমায়েসি এক নতুন ভার্সন তিনি চালু করেন। স্বাধীনতার চেতনার নামে মুক্তিযুদ্ধের সব মূল্যবোধ তিনি পদদলিত করেন।
বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়ে তার ব্যয় অনেকগুণ বাড়িয়ে অবাধ লুটপাটের মাধ্যমে হাসিনা বৈদেশিক ঋণের বিশাল বোঝা চাপিয়ে দেন দেশবাসীর ওপর। বিদ্যুতে স্বয়ম্ভর হবার নামে কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টের মাধ্যমে অবাধ লুণ্ঠনে ফোকলা করে ফেলেন জাতীয় অর্থনীতি।
নির্বাচনপদ্ধতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে, জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে প্রশাসন ও পুলিশ মারফত বারবার নিজেকে এবং তার দোসরদের নির্বাচিত বলে ঘোষণা করাতে থাকেন। শিক্ষা ও নীতি-নৈতিকতা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দুর্নীতি, লুটপাট ও অশ্লীল ভোগবাদিতায় দেশ সয়লাব করেন। মাদকের অবাধ অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করে নীলনেশায় ডুবিয়ে দেন তরুণসমাজের এক বড় অংশকে।
হাসিনা ও তার দোসরেরা মিলে বাংলাদেশের অর্থ-সম্পদ লুটে বিদেশে পাচারের মাধ্যমে দেশের যা ক্ষতি করেছেন তা’ হয়তো পুষিয়ে নেয়া যাবে কিন্ত তিনি সব নিয়ম-কানুন, পদ্ধতি এবং রাষ্ট্রীয় প্রথা-প্রতিষ্ঠান যেভাবে বিনাশ করেছেন এবং নৈতিকতাকে যেভাবে ধ্বংস করেছেন তা একটি সামাজিক বিপ্লব ছাড়া ‘রিসেট’ করা সম্ভব নয়।
অনেক কায়ক্লেশে উঠে আসা এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হাসিনা ক্ষমতায় এসে ধনিক, বণিক, লুটেরা ও অলিগার্কদের সরকারে পরিণত হন। তার পতনের পর ‘গরিবের ব্যাংকার’ মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি হাসিনা রেজিমের ভুয়া তথ্য-উপাত্তভিত্তিক উন্নয়নের মেকি চিত্রকে পালটে দিয়ে দারিদ্রমোচনের মাধ্যমে দরিদ্রবান্ধব পদক্ষেপে প্রকৃত ও টেকসই উন্নয়নের দিকে দেশকে নিয়ে যেতে পারবেন কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে।
হাসিনা রেজিমের মহাদুঃশাসন ও নজিরছাড়া অপকাণ্ডের অজস্র ক্ষতচিহ্ন মুছে দিতে যে ‘বিগ পুশ’ দরকার জনাব ইউনূসের সরকারকে তেমন বিপ্লবী চরিত্রের বলে মনে হয় না। তারা আরেকটু ধীর গতিতে রয়ে সয়ে সংস্কারের পথে এগোতে চান। এ পথে হাসিনা রেজিমের রেখে যাওয়া সুবিধাভোগী ও ফ্যাসিবাদের দোসরেরা পদে পদে বাধার প্রাচীর তুলছে এবং তুলতেই থাকবে। অপসারণ ও যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করা ছাড়া এদেরকে নিষ্ক্রিয় করা যাবে না।
যতোই দাপাদাপি করুক, হাসিনার যে-কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই এবং তার পুনরুত্থানের যে আর কোনো সম্ভাবনাই নেই সেটা পুরোপুরি অনুধাবন করতে পতিত ফ্যাসিবাদীদের আরেকটু সময় লাগবে। গণহত্যার ঘৃণ্য রেকর্ডধারীদের জন্য মানবাধিকারের বর্ম যে কোনো রক্ষাকবচ হবে না, সেটা না বুঝে তারা সংঘবদ্ধভাবে যে অপপ্রচার ও গুজব রটনায় নেমেছে তা নিষ্ফল না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে এপথ থেকে নিবৃত্ত করাও যাবে না।
তবে একসময় তাদের বিকারগ্রস্ত চিত্তের ঝড় থামবে এবং আরো কঠিন মাটির স্পর্শ তাদেরকে বাস্তববাদী হতে সাহায্য করবে। তখন তারা হাসিনা এবং তার রেজিমের সব অপরাধীদের বর্জন করবে। ওদের কৃতকর্মের দায়ভার না নিয়ে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি চাইবে। চক্রান্ত, অপপ্রচার ও নাশকতার পথ ছেড়ে তারা রাজনীতিতে ফিরবে এবং রাজনীতিকে শুদ্ধ ও দলকে পুনর্গঠিত করবে। তাদের মধ্যে অনুশোচনা আসবে, তারা অনুতপ্ত হবে এবং ভুল স্বীকার করে জনগণের কাছে ক্ষমা চাইবে। সীমান্তের বাইরে তারা প্রভুর বদলে বন্ধুর সন্ধান করতে শিখবে।
আমি এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই। জাতীয় গৌরব এই প্রতিষ্ঠানকে হাসিনার যামানায় পদস্থ কতিপয় কর্তাব্যক্তি ব্যক্তিগত লালসায় ফ্যাসিবাদের আজ্ঞাবহ করে ফেলেছিল। জুলাই বিপ্লবের চূড়ান্ত পর্বে সশস্ত্রবাহিনী জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তাদের সেই গ্লানি মুছে স্বমহিমায় পুনরাবির্ভূত হয়েছে। সব জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে সেই পথ অনুসরণ করতে হবে এবং আওয়ামী লীগকেও ফ্যাসিস্ট ধারাকে বর্জন করে দেশ ও জনগণের পক্ষে অবিচল অবস্থান নিতে হবে।
ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটানো জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশে যে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে তাতে চক্রান্ত, অপপ্রচার ও নাশকতার পুরনো রাজনীতি যে আর কখনোই কল্কে পাবে না সেটা বুঝতে হবে। মুজিব পরিবারের ব্যাখ্যান এবং মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ান আর তাদের জয়ের শিখণ্ডি হবে না। বাংলাদেশভিত্তিক দেশপ্রেমিক রাজনীতিকে গ্রহণ করে মূলধারায় ফেরার চেষ্টা না-করা পর্যন্ত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক অঙ্গনে আর পা ফেলতে পারবে না। অতীতের দুঃস্বপ্ন হিসেবে তাদেরকে ইতিহাসচারী হয়েই থাকতে হবে।