Home জাতীয় কেন ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে বাংলাদেশের ওপর নজর রাখতে বললেন মন্ত্রী রাজনাথ সিং?
সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪

কেন ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে বাংলাদেশের ওপর নজর রাখতে বললেন মন্ত্রী রাজনাথ সিং?

সম্প্রতি ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং দেশটির সামরিক বাহিনীর শীর্ষ স্থানীয় কমান্ডারদের বাংলাদেশে চলমান পরিস্থিতির দিকে নজর রাখতে বলেছেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর এ নিয়ে বাংলাদেশেও এক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

ভারতের সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে ওই বক্তব্যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি রাজনাথ সিং সশস্ত্র বাহিনীকে ভবিষ্যৎ যুদ্ধ মোকাবিলার জন্য তৈরি থাকতে বলেছেন।

এদিকে প্রতিবেশী দেশটির গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রীর এমন বক্তব্যকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না বাংলাদেশের কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এই ধরনের বক্তব্য বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘রাজনাথ সিং উচ্চ পর্যায়ের একটি সভা থেকে এই ঘোষণা দিয়েছেন। যে কারণে বাংলাদেশের এটি নিয়ে অবশ্যই উদ্বেগের কারণ রয়েছে।’

তবে ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মত হচ্ছে, এই ধরনের নির্দেশনা খুব সাধারণ একটি বিষয়। বাংলাদেশের এ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার খুব বেশি কারণ নেই।

ভারতের সাউথ এশিয়া ইন্সটিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের রিসার্চ ফেলো স্ম্রুতি পট্টানায়েক বলেন, ‘আমার মনে হয় রাজনাথ সিং জেনেরিক টার্মে এই কথাটি বলেছেন। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধ করবে এই সম্ভাবনা আমি কখনো দেখি না।’

রাজনাথ সিং কী বলেছিলেন?

ভারতের সংবাদ মাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) ভারতের উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌতে তিন বাহিনীর শীর্ষ কমান্ডারদের যৌথ সম্মেলনে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘ভারত শান্তিপ্রিয় দেশ। শান্তি রক্ষার জন্য ভারতের সশস্ত্র বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’

এই বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি উদাহরণ হিসেবে টানেন রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরায়েল-হামাসের মধ্যে চলমান সংঘাতের কথা।

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘বৈশ্বিক অস্থির পরিস্থিতিতেও নজিরবিহীনভাবে শান্তি বজায় রেখে এগিয়ে চলছে ভারত। তারপরও কিছু চ্যালেঞ্জ বাড়ছে, এ নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’

ভারতের টেলিগ্রাফ পত্রিকার খবর জানাচ্ছে রাজনাথ সিং বলেছেন, ‘আমাদের বর্তমান অবস্থার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে; আমাদের চারপাশে কী ঘটছে, তার ওপর নজর দিতে হবে এবং ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই তা করতে হবে। এর জন্য আমাদের শক্তিশালী ও সুদৃঢ় নিরাপত্তা ঐক্য থাকতে হবে। আমাদের একটি অব্যর্থ প্রতিরোধ শক্তি থাকতে হবে।’

টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব সীমান্ত পরিস্থিতির ওপরও নজর রাখতে বলেছেন রাজনাথ সিং।

ইসরায়েল-হামাস কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গ কেন?

রাজনাথ সিং তার বক্তব্যে, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে বলতে গিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও হামাস-ইসরায়েল প্রসঙ্গ টেনেছেন।

আর এ নিয়েই আপত্তি বাংলাদেশের কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক বিশ্লেষক হুমায়ূন কবির বলেন, ‘হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে গাজাতে যে যুদ্ধ চলছে এবং ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে, সেটার প্রেক্ষাপটের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট কোনওভাবে তুলনীয় বলে মনে হয় না।’

একই রকমভাবে বলছিলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল-হামাস আর রাশিয়া-ইউক্রেনের সঙ্গে মিলিয়ে দুটি বিষয়কে এক করে দেখার সুযোগ একেবারেই নাই। এত গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে এ ধরনের উক্তি আসা একেবারেই সমীচীন হয়নি।’

বাংলাদেশ ভারতের ভৌগলিক অবস্থান ও প্রতিবেশী এই দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সাময়িক অস্থিরতার সঙ্গে বিশ্বের অন্য দেশের যুদ্ধের সঙ্গে মেলানোর কোনও সুযোগ নেই।

ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষক স্ম্রুতি পট্টানায়েক বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন পরিস্থিতি আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হচ্ছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি যে ভারতকে একটা যুদ্ধ করার জন্য লিড করবে এই সম্ভাবনা আমি কখনোই দেখি না।’

ভারতের এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলছেন, বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন পক্ষ পরিস্থিতিকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে। তবে এসব বক্তব্যকে কঠিনভাবে না দেখাই ভাল।

rajnat sভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং।

বাংলাদেশের জন্য কতটা উদ্বেগের?

দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার খবর বলছে, ভারতের চারপাশে বর্তমানে কী ঘটছে, তার ওপর নজর রাখতে সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। এ জন্য শক্তিশালী ও সুদৃঢ় নিরাপত্তা ঐক্য থাকতে এবং অব্যর্থ প্রতিরোধ শক্তি রাখতে সেনাবাহিনীর প্রতিও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

এই বক্তব্যকে সহজভাবে দেখার সুযোগ আছে বলে মনে করেন না বাংলাদেশের কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এই ধরণের বক্তব্য বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘ওই সভায় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীসহ তিন বাহিনীর প্রধান, সিনিয়র কমান্ডার ও প্রতিরক্ষা সচিব উপস্থিত ছিলেন। এত গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে এ ধরনের উক্তিকে স্বাভাবিকভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই।’

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে তাও মাত্র এক মাস হলো। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই বক্তব্য এমন সময় দিয়েছেন যখন ক্ষমতা ছেড়ে সে দেশে আশ্রয় নিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমন অবস্থায় ভারতের পক্ষ থেকে আসা এই বক্তব্যের প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক বলে মনে করছেন বাংলাদেশের কূটনীতিক বিশ্লেষকরা।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বলেন, ‘এখন সংবেদনশীল সময় পার করছে বাংলাদেশ। এই সময় যখন এমন একটি বক্তব্য আসে তা এদেশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে ও জনমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’

বাংলাদেশের ভূমিকা কী হবে?

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে উন্নত হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসা বাণিজ্যিক সম্পর্কও বেড়েছে বহুগুণ। তবে, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধিতা বেড়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। বিশেষত, গত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর এই আরও প্রবল হতে শুরু করেছে।

কেন না, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের অনেকেই মনে করেন গত তিনটি মেয়াদে বাংলাদেশে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। আর প্রতিবারই তা পেরেছে ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থনের কারণে। গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। তবে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থন অন্য যে কোনও দলের চাইতে বেশি। যে কারণে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে ভারতেই আশ্রয় নিয়েছেন।

এরপর বাংলাদেশে জরুরি ও চিকিৎসা ছাড়া ভিসা কার্যক্রম বন্ধ করেছে ভারত। দুই দেশের মধ্যে যাত্রীবাহী রেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। এমন সময় ভারতের পক্ষ থেকে এই বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশে আলোচনা শুরুর পর প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ এখন কী করবে তা নিয়ে।

জবাবে ভারতের বিশ্লেষকরা বলেছে, ভারতীয় মন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্যে দুই দেশের মধ্যে তেমন কোনও প্রভাব ফেলবে না।

কারণ হিসেবে সে দেশটির নিরাপত্তা বিশ্লেষক স্ম্রুতি পট্টানায়েক বলেন, ‘বাংলাদেশের তিনদিকে ভারতের সীমানা। দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট বর্ডার ম্যানেজমেন্ট, নিরাপত্তা চুক্তিসহ নানা চুক্তি রয়েছে। এমন অবস্থায় এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক থাকতেই হবে। সেটা ভাল থাকুক আর খারাপ থাকুক।’

এ অবস্থায় বাংলাদেশের কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ইস্যু নিয়ে দ্রুতই ভারতের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের কূটনীতির যে রাস্তাগুলো আছে, সেই পথে ওই বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাওয়া প্রয়োজন।’

কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রভাবশালী মন্ত্রী রাজনাথ সিং যে বক্তব্য দিয়েছে সেটি কোনও অভ্যন্তরীণ বা বিচ্ছিন্ন বিষয় হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। বিশেষ করে বর্তমানে যখন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে খানিকটা টানাপড়েন রয়েছে, তখন আরো উত্তেজনা তৈরি হওয়ার আগে আলোচনার মাধ্যমে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত।

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *