গার্মেন্টকর্মী এক্সিম ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক
প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রাখতে এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নিজের গার্মেন্টের কর্মীকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। সাতজন উদ্যোক্তা পরিচালকের বিপরীতে চারজন ভুয়া পরিচালক নিয়োগ দেন তিনি। এরা নজরুল ইসলাম মজুমদারের মালিকানাধীন নাসা গ্রুপের গার্মেন্টে চাকরি করতেন।
২০১৯-২০২১ সাল পর্যন্ত টানা তিন বছর পর্ষদে ছিলেন তারা। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) ২০২২ সালে আবারও নবায়নের আবেদন করেন। তবে ওই সময়ে বিএসইসির তদন্তে ভয়াবহ জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। এরপর চিঠি দিয়ে ক্ষমা চান তিনি। ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ করবেন না বলে অঙ্গীকার করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন জালিয়াতি। তবে নজরুল ইসলাম মজুমদার প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি কমিশন। উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন থেকে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যানের পদ ধরে রেখেছেন তিনি।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম রোববার যুগান্তরকে বলেন, স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার একটি গাইডলাইন রয়েছে। এই গাইড মেনে নিয়োগ দেয় কমিশন। তবে এক্সিম ব্যাংকের বিষয়টি সম্পর্কে এই মুহূর্তে আমার স্মরণে আসছে না। ভবিষ্যতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকবে কমিশন।
বিদ্যমান করপোরেট গভর্নেন্স কোড অনুসারে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে ২০ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক থাকা বাধ্যতামূলক। এই পরিচালকরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ হয় এবং পর্ষদে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ কিংবা আইন পরিপন্থি কোনো সিদ্ধান্ত হলে তার প্রতিবাদ করেন। ব্যাংকের পর্ষদে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করছেন এমন অভিজ্ঞ ব্যক্তি, বড় কোনো আইনজীবী অথবা সাবেক খ্যাতিমান কোনো ব্যাংকারকে রাখা হয়।
এরা পর্ষদ ও তাদের পরিবারের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত থাকতে পারবে না। কিন্তু নজরুল ইসলাম মজুমদারের মালিকানাধীন এক্সিম ব্যাংকে চারজন গার্মেন্টস কর্মীকে স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন রঞ্জন চৌধুরী, খোন্দকার মোহাম্মদ সাইফুল আলম এবং মোহাম্মদ সেকান্দার খান। এছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল সিরাজুল ইসলামকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসাবে নিয়োগ নেওয়া হয়েছিল, যার ব্যাংকিংয়ের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এ ধরনের নিয়োগ দেওয়ার মানে হলো পর্ষদে বড় ঋণ অনুমোদন, কেনাকাটাসহ চাইলে যে কোনো সিদ্ধান্ত পাশ করতে পারবেন। দেশের ব্যাংক খাত ও শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এটি অনেক বড় জালিয়াতি। বিষয়টি বিএসইসির তদন্তে ধরা পড়ে। এরপর চিঠি দিয়ে ক্ষমা চান নজরুল ইসলাম মজুমদার। পাশাপাশি চারজন বাদ দিয়ে নতুন দুজন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। এরা হলেন মো. নাজমুল সালেহীন এবং মিয়া মোহাম্মদ কাওসার আলম।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের করপোরেট গভর্নেন্স কোড ২০১৮ (সংশোধিত) অনুসারে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত পর্ষদে ২০ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি চারজনে একজন স্বতন্ত্র পরিচালক থাকা বাধ্যতামূলক। ওই কোডের ১(২) এবং ১(৩) নং শর্তে স্বতন্ত্র পরিচালকের সংজ্ঞা, আনুপাতিক সংখ্যা, সংশিষ্ট প্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত যোগ্যতা-অযোগ্যতা, শিক্ষাগত যোগ্যতাবিষয়ক পূর্বশর্ত বর্ণনা করা হয়েছে। কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে ১০ বছরের পূর্বঅভিজ্ঞতা শর্ত হিসাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ১(৩)(ঘ) শর্তে কমিশনের অনুমোদন লাগে।
কোডের শর্তে বলা হয়েছে, যিনি স্বতন্ত্র পরিচালক হবেন, তিনি কোম্পানির উদ্যোক্তা হতে পারবেন না। এছাড়া তিনি ওই কোম্পানির উদ্যোক্তা, পরিচালক, স্বতন্ত্র পরিচালক, শেয়ারহোল্ডার, সহযোগী প্রতিষ্ঠান, সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান, মূল কোম্পানি, যারা ওই প্রতিষ্ঠানের ১ শতাংশ বা তার বেশি শেয়ার রয়েছে, এদের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত থাকতে পারবেন না। এছাড়াও পরিবারের কোনো সদস্যের ১ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকলে তিনি বিবেচিত হবেন না।
এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য হিসাবে স্বামী/স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, মা, বাবা, ভাই, বোন, জামাতা এবং পুত্রবধূ বিবেচিত হবেন। স্বতন্ত্র পরিচালক হিসাবে পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ দেবে। তবে বার্ষিক সাধারণ সভায় সাধারণ সদস্যদের অনুমতি লাগবে। স্বতন্ত্র পরিচালককে আর্থিক আইন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার শর্ত এবং করপোরেট আইনের শর্ত পূরণ করতে হবে। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ব্যবসায় তিনি যেন অর্থপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন।
তিনি ১০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের অতালিকাভুক্ত কোম্পানিতে ছিলেন বা আছেন অথবা তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে ছিলেন অথবা জাতীয় আন্তর্জাতিক কোনো চেম্বার বা অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য বা অভিজ্ঞতা রয়েছে।
এছাড়া করপোরেট প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান আর্থিক কর্মকর্তাসহ সমমর্যাদায় থাকতে হবে। কিন্তু আলোচ্য চারজন ব্যক্তির কোনো কিছুই নেই। যা পুরোপুরি আইনের লংঘন। এ ব্যাপারে রোববার সন্ধ্যায় নজরুল ইসলাম মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো সাড়া দেননি।