আব্বা বাহিনীর নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি আওয়ামী লীগ নেতারাও
বুড়িগঙ্গার ওপারে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ‘আব্বা বাহিনী’র নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও। বাহিনীটির হাতে ‘নির্যাতনের শিকার’ আরও ৫০ জনের নাম জানা গেছে, তাঁদের মধ্যে অন্তত ১০ জন রয়েছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ও সক্রিয় কর্মী।
নির্যাতনের শিকার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের একজনের সঙ্গে সম্প্রতি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চর মীরেরবাগে একটি জায়গায় কথা হয়। তাঁর বয়স ষাটোর্ধ্ব। নাম ও পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চর মীরেরবাগে অবাধে মাদক কেনাবেচা করেন আব্বা বাহিনীর সদস্যরা। কেউ বাধা দিলেই চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। মাদক সেবনে বাধা দেওয়ায় তাঁকে ও তাঁর ছেলেকে কয়েক মাস আগে আব্বা বাহিনীর সদস্যরা পিটিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের ওই নেতা বলেন, ‘আমি ৪০ বছর ধরে আওয়ামী লীগ করি। মারধরের শিকার হয়ে কারও কাছে বিচার দিতেও যেতে পারিনি। বিচার দিতে গেলে এলাকায়ই থাকতে পারব না।’
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে কারা কারা আব্বা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাঁদের খোঁজ করছিলাম তিন মাস ধরে। স্থানীয় সূত্রে খোঁজ পেয়ে নির্যাতনের শিকার ওই আওয়ামী লীগ নেতার কাছে যাওয়ার পর তিনি কথা বলতেই রাজি হননি। আব্বা বাহিনীর সদস্যরা বুঝতে পারেন, এমন কোনো তথ্য (নাম, দলের পদ, এলাকা) প্রকাশ না করার অঙ্গীকারের পর তিনি দেখা করতে রাজি হন।
‘আব্বা বাহিনী’র নিয়ন্ত্রক আফতাবের জামিন স্থগিত, আত্মসমর্পণের নির্দেশ
চর মীরেরবাগের একটি জায়গায় এসে উল্লিখিত আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, সন্ধ্যার দিকে অনেক মানুষের সামনেই তাঁকে পেটানো শুরু করেন আব্বা বাহিনীর সদস্যরা। খবর পেয়ে তাঁর ছেলে (২৩) ছুটে আসেন। তাঁকেও মারধর করেন আব্বা বাহিনীর লোকেরা। ভয়ে তিনি মামলা করেননি।
চাঁদার টাকা ‘ভাগাভাগি’কে কেন্দ্র করে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের এই আব্বা বাহিনীর সদস্যরা গত ৯ জানুয়ারি রাতে তাঁদেরই সঙ্গী সাইফুল ইসলাম ওরফে রাসেলকে নির্যাতন কেন্দ্রে (টর্চার সেল) নির্যাতন চালান। পরদিন রাসেলের মৃত্যু হয়। ঘটনার পর রাসেলের বাবা তোফাজ্জল হাওলাদারের করা মামলায় পুলিশ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে ১০ জন আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেন, নির্যাতনে অংশ নিয়েছিলেন ৩০ জন।
আব্বা বাহিনীর ‘মাঠের নেতা’ ও অন্যতম নিয়ন্ত্রক আফতাব উদ্দিন ওরফে রাব্বি উচ্চ আদালত থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পেয়েছিলেন। তবে গত ২১ এপ্রিল আফতাবের জামিন স্থগিত করে তাঁকে সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। কেরানীগঞ্জের স্থানীয় সূত্রের দাবি, আফতাব আত্মসমর্পণ করেননি। তিনি এলাকা ছেড়েছেন।
নির্যাতনের শিকার ওই আওয়ামী লীগ নেতা প্রথম আলোকে আরও বলেন, আব্বা বাহিনীর আফতাবসহ ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর এলাকার মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছিল। তিন মাসের ব্যবধানেই আফতাব উদ্দিন ও তাঁর তিন সহযোগী জামিনে মুক্তি পান। এরপর এলাকায় থাকা তাঁদের সহযোগীরা সক্রিয় হয়েছেন, মহড়া দিচ্ছেন।
বাড়িতে ‘লুটপাট’
স্থানীয় সূত্রে খবর পাওয়া যায়, আব্বা বাহিনীর সদস্যদের হাতে লুটপাটের শিকার হয়েছিল দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক আখতার হোসেন ও অজুফা বেগম দম্পতির বাড়ি। ঘটনাটি মাস দশেক আগের।
অজুফা বেগমকে পাওয়া যায় শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চর খেজুরবাগ এলাকায়। সেখানেই তিনি পরিবারসহ থাকেন। নাম প্রকাশের অনুমতি দিয়ে ওই নারী বলেন, চর মীরেরবাগে তাঁর বাড়িটি ভাড়া দেওয়া। সেখানে একটি কক্ষ দখল করে মাদক সেবন করতেন আব্বা বাহিনীর কয়েক সদস্য। ভাড়াটেদের অভিযোগের পর তিনি আব্বা বাহিনীর সদস্যদের নিষেধ করেন।
আমি ৪০ বছর ধরে আওয়ামী লীগ করি। মারধরের শিকার হয়ে কারও কাছে বিচার দিতেও যেতে পারিনি।
অজুফা বেগম বলেন, এর জেরে বাড়িটিতে হামলা করে লুটপাট চালান আব্বা বাহিনীর সদস্যরা। মারধর করা হয় ঘটনাস্থলে থাকা তাঁর স্বামী ও ছেলেকে। তাঁর দাবি, ঘটনাটি নিয়ে তিনি পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেছিল, তবে মামলা নেয়নি। আবার শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনের কাছে বিচার দিলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি।
অজুফার দাবি সঠিক কি না, তা জানতে স্থানীয় কয়েক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তাঁর মধ্যে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হামলার ঘটনা সত্য। পুলিশ আসার পর আব্বা বাহিনীর সদস্যরা চলে গিয়েছিলেন।
নির্যাতনের আরও ঘটনা
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের একটি এলাকায় বসবাস করেন দুই ভাই। কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তাঁরা। এই দুই ভাইও আব্বা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
পবিত্র ঈদুল ফিতরের কয়েক দিন আগে মুঠোফোনে অনুরোধ করলে উল্লিখিত দুই ভাই চর খেজুরবাগে এসে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা বলেন, আব্বা বাহিনীর নেতাদের চাপে তাঁরা নিয়মিত রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে যেতেন। একদিন যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এ কারণে টর্চার সেলে নিয়ে তাঁদের মারধর করা হয়। এক ভাই বলছিলেন, ‘টর্চার সেলে নিয়ে আমাদের হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। এরপর লাঠি দিয়ে পায়ে পেটানো হয়।’
আধঘণ্টার মতো পেটানোর পর তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয় জানিয়ে আরেক ভাই বলেন, তাঁরা এ ঘটনার প্রতিকার চেয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনের কাছে গিয়েছিলেন। তবে কোনো প্রতিকার পাননি। তিনি আরও বলেন, তাঁরা মারধরের শিকার হওয়ার পর মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও অন্যান্য নথিও দেখান তিনি।
আওয়ামী লীগের যে ১০ জন স্থানীয় নেতা-কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাঁদের সবার সঙ্গেই কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের মধে৵ ছয়জন ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। বাকিরা বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হননি। তবে ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন। একজন বলেন, চাঁদার টাকা দিতে না পারায় আব্বা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে কুপিয়ে জখম করেছিলেন। আরেকজন দাবি করেন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে তাঁকে কুপিয়ে জখম করা হয়। ঘটনায় মামলা হয়েছিল। পরে আপস করতে বাধ্য হন।
চেয়ারম্যান যা বললেন
আব্বা বাহিনীকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে, যিনি শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। আব্বা বাহিনীর নেতা আফতাবের চাচা তিনি।
ইকবাল হোসেন গত ২৪ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, আফতাব উদ্দিন তাঁর আপন ভাতিজা নন। আফতাবের কর্মকাণ্ডের দায়দায়িত্ব তাঁর এবং তাঁর পরিবারের। তিনি আরও বলেন, মাদক ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তাঁর (ইকবাল হোসেন) নাম করে চাঁদা তোলার অভিযোগ সঠিক নয়। আফতাবের পরিবারের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
অবশ্য রাসেল হত্যার ঘটনায় আফতাব আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, তাঁর বাবা বাছের উদ্দিন শুভাঢ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁর চাচা ইকবাল হোসেন শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আরেক চাচা সাকুর হোসেন জিনজিরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তিনি নিজে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (গ্রেপ্তারের পর বহিষ্কৃত)। এসব কারণে তাঁরা এলাকায় প্রভাবশালী।
আব্বা বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা অভিযোগ করছেন, রাসেলকে নির্যাতনের ভিডিও চিত্র ছড়িয়ে পড়ার পর চাপে পড়ে পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ১০ আসামির জবানবন্দীতে রাসেলকে নির্যাতনকারী ৩০ জনের নাম এলেও তাঁরা ধরা পড়েননি।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) আসাদুজ্জামান গত ৮ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, রাসেল হত্যার পর এর সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ ব্যক্তিকেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এই বাহিনীর বিষয়ে আসা অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। এর আগে কেউ যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাঁরা যদি অভিযোগ দেন, তাহলে সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
‘এ দেশে বিচার নেই’
রাসেল হত্যা মামলার প্রধান আসামি আফতাফ জামিন পাওয়ার পর পালিয়ে গেছেন বলে আশঙ্কা করে রাসেলের স্ত্রী মৌসুমী আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, এ দেশে বিচার নেই। যদি বিচার থাকত, তাহলে প্রধান আসামি জামিনে বের হয়ে মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি দিতে পারতেন না। তিনি বলেন, হত্যায় জড়িত অনেকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পুলিশ তাঁদের ধরছে না।