আয়না,যদি আবিস্কার না হতো,আমরা একে অপরের আয়না হতাম।।
তাইফুর রহমান, লেখক ও সমাজকর্মী :
মায়ের চোখের আয়নার রাজপুত্রেরও অশ্রুসিক্ত নির্বাক চাহনির প্রতিবিম্ব কিভাবে অনুভব করতাম আমরা।
“আয়নায় মুখ দেখেছো?” একটি প্রচলিত প্রবাদ।রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে অন্তত আমরা অনেকেই একবার আয়নায় নিজের সাজ দেখে তবেই ঘর থেকে বের হই।সেই আয়নাকে আমার দেখা হয়নি অনেক দিন।
একদিন সকালে জয়নাল চাচার দোকানে বসে কিছু খাচ্ছিলাম, মাথায় সত্যিই খুব দুশ্চিন্তার মেঘ ছিলো।বয়স্ক বৃদ্ধদের সাথে মাঝে মাঝে বসেই তাদের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু অনুভব করা শিখতে চাওয়ার অভ্যাসটা অনেক পুরনো।চাচার ব্যস্ততা না থাকলে তিনি সব সময়ই বসে আমার সাথে দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে কথাবার্তা বলেন,খোজখবর নেন।
কিছুদিন আগেই জয়নাল চাচার হাতটা মচকে গেলে দুদিন দোকানে আসেননি,তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম চাচা কোথায় আছেন,সুস্থ আছেন কিনা।তখন শুনলাম হাতে ব্যাথা পেয়েছেন,পরে দেখলাম হাত ব্যান্ডেজ করা।তবুও তিনি দোকানে এসেছেন,ঘরে লোকজনের সমাগম নেই।এমন যায়গায় তার মন বসে না তাই দোকানে এসেছেন,মালিক হিসেবে বসে আছেন,লোকজনের যাথে নানান আলাপ করছেন।
চাচা এসে আমার সামনাসামনি বসলেন,আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন কেমন আছি।স্বভাবতই তাকে উত্তর দিলাম ভালো আছি,কিন্তু কোনোভাবেই তিনি বিশ্বাস করতে চাইছেন না যে ভালো আছি।চাচা বললেন আমি তো মিথ্যা বলি না কখোনো,আজকেরটা কি সত্যি?
আমি তাকে উলটো প্রশ্ন করলাম,আপনার কি মনে হয় কেমন আছি আমি?ততক্ষণে আমি ভাবছিলাম,আমি ভালো নেই সেটা তিনি কি করে বুঝলেন?
জয়নাল চাচার সরল উত্তর আমাকে অশ্রুসিক্ত করেছিলো তখনই, মানুষ এভাবেও আমাকে দেখে?ভিতরের ঝড়-তুফান কিভাবেই বা তিনি ধরে ফেললেন?
“শরীর, চেহারা কোনোটাই আগের মতো নাই,কোনো সমস্যা চলছে?”
আসলে এর সঠিক উত্তর আমার কাছে ছিলো না।তিনিই বলছিলেন মুখটা শুকিয়ে গেছে,শরীরটাও পরে যাচ্ছে,চোখেমুখে স্পষ্ট ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তার ছাপ নাকি বোঝা যাচ্ছে।তিনি হয়তো অনুভব করেছিলেন সত্যিই ভিতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, অন্তরটা দাড়াতে পারছে কোনোভাবেই।ভেঙেচুরে তুফানে পরে যাচ্ছে লুটিয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে।দুশ্চিন্তা আর হতাশার সাগরে ডুবে মরতে বসেছি আমি,কখন যেনো ডুবে হারিয়ে যাই।ভিতরের কর্কশ চিৎকারের শব্দ মনে হয় বাইরে থেকেও শোনা যায়।
চাচা এরপর নিজের একটা গল্প শোনাচ্ছিলেন,যদিও ততক্ষণে আমার খাবার বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম, গলা আটকে বন্ধ হয়ে আটকে যাচ্ছিলো।পানির লোকগুলোও যেন পাহাড় গিলছি মনে হচ্ছে।ভাবছিলাম কতদিন আয়না দেখা হয়না,নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না।
তার যৌবনের গল্প শোনালেন,আমিও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে শুনছিলাম বুড়ো বয়সেও সে তার মা আর স্ত্রীর প্রশংসা করছে মনে হয় সেও শিশু।এক সময় নাকি তার চড়ম অসুস্থতার দিন গেছে, সব বিক্রি করে দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন।সেই দিনগুলোতে, যখন কেবলই বিয়ে করেছেন তখন সেই মহিয়সী নারীকে অতটা মূল্যায়ন করেন নি,যদিও সে অত্যন্ত লজ্জাবতী ছিলো।এই বার্ধক্যে তিনি অনুভব করছেন,আসলেই তার স্ত্রী তাকে সারাটা জীবন নাকি পরিশ্রম করে কোনো অভিযোগ ছাড়াই সব সয়ে গেলেন।আর সেই সব দুর্দিনের তুফান পাড়ি দিয়ে এসেছেন শুধু মায়ের দোয়ায়।কথাগুলো বলার সময় অনুভব করলাম তিনিও ভিতর থেকেই কথাগুলো খুব অশ্রুভেজা বাক্যেই বলছেন।চাচা আমাকেও শান্তনা দিলেন,নিজেকেও বুঝালেন।
আসলে পৃথিবীতে যদি আয়না আবিস্কার না হতো তাহলে আমরা নিজেরাই হয়তো নিজেদের একে অপরের আয়না হতাম।আর মায়ের চোখের আয়নায় নিজেকে সবাই রাজপুত্র ভাবতাম।কারণ ছোটবেলা থেকেই কালো ছেলেটাকেও মা তার রাজপুত্র হিসেবে এতটা মায়ায় বাধেন যে সেও নিজের বাহ্যিক রঙের কথা মাথায়ও আনে না,সেও নিজেকে ধবধবে ফর্সা সোনায় মোড়ানো রাজপুত্রই ভাবে।
বেচে থাকুক সমাজের এই উপকারী আয়নাগুলো,আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকুক,অনুভব করুক,অশ্রুসিক্ত হোক।এই তো জীবন, এখানেই শুরু এখানেই শেষ।আমরাও এই লোকগুলোকে ভালোবাসতে শিখি।