মিল্টন সমাদ্দারের হাতে লোকটির ভাগ্যে কী ঘটেছিল
মানবিক মুখোশের আড়ালে থাকা চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের চেয়ারম্যান ভয়ংকর প্রতারক মিল্টন সমাদ্দারের আরও একটি অপকর্মের কাহিনী ফাঁস করেছেন রাজধানীর মিরপুরের দারুস সালাম থানার বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ-সভাপতি রনি মল্লিক।
শনিবার (২৭ এপ্রিল) রাত সাড়ে ১১টায় নিজের ফেসবুক পেইজে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে মো. মোতালেব নামে এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ করেন।
অভিযোগ জানিয়ে রনি মল্লিকের দেওয়া ফেসবুক স্ট্যটাসটি কালবেলার পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
রনি মল্লিক লিখেছেন, ‘একজন প্রতারক মিল্টন সমাদ্দর ও আমার বাস্তব ঘটনা। মিল্টন এর পক্ষ নিয়ে যারা কথা বলছেন তাদের জন্য এই লেখা। দয়া করে পড়বেন। মিল্টন এর সাথে আমার কোনো পূর্ব পরিচয় নাই, ওর সাথে আমার কোনো শত্রুতাও নাই। আমিও সবার মত মিল্টন এর আশ্রমে দান করতাম। মূল ঘটনায় আসি।’
‘২০২১ সালের ৩রা মার্চ, রাত প্রায় সাড়ে এগারোটায় বান্ধবী আয়শার মাধ্যমে সংবাদ পাই যে একজন অন্ধ বৃদ্ধ লোক মিরপুর ১ নম্বর উত্তর বিশিলের রাস্তায় পরে আছে। উনি অন্ধ হওয়ায় কোনো দিকে যেতে পারছে না। উনি যেখানে আছে সেখানেই প্রসব পায়খানা করে দিচ্ছে। পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কারণে পার্শ্ববর্তী বাড়ির মালিকরা ওনাকে সেখান থেকে সরিয়ে দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এই অবস্থায় আমার বান্ধবী আয়শা ওনার পাশে দাঁড়ায়। আয়শা ওনার জন্য বাসা থেকে কাপড় ও খাবার আনায়, আমি মানবিক কাজ করি বিধায় আমাকে খবর দেয়।’
‘আমি সংবাদ পাওয়ার পরেই আমার ছোট দুই ভাই সামির, সিয়াম, ও ভাগিনা তামিমকে নিয়ে ঘটনাস্থলে রওনা হই। ৪ মার্চ রাত প্রায় সোয়া বারোটার দিকে বিশিলে পৌঁছাই। পৌঁছে বান্ধবীর দেওয়া তথ্যের সত্যতা পাই। তখন সেখানে অনেক এলাকাবাসীও উপস্থিত ছিলেন। সকলের পরামর্শ নিয়ে আমি ৯৯৯ এ কল করে সহযোগিতা চাই। ৯৯৯ এর মাধ্যমে আমরা দারুস সালাম থানার সাথে যোগাযোগ করি। থানা থেকে ইয়াহিয়া নামে একজন এসআই বা এএসআই এর মাধ্যমে একটা টিম ঘটনা স্থলে পাঠায়। পুলিশের সাথে পরামর্শ করে আমি রনি মল্লিক রাত ২টায় দারুস সালাম থানায় একটা জিডি করে বৃদ্ধ লোকের অভিভাবকত্ব নিই। এরপর রাত আড়াইটায় দারুস সালাম থানার পুলিশের গাড়িতে করেই আমরা মিল্টন এর কল্যাণপুর এর আশ্রমে যাই। প্রথমে ওরা বৃদ্ধ লোককে গ্রহণ করতে চায়নি, পরে যখন আমাদের সাথে পুলিশ এবং থানার জিডি দেখে তখন ওনাকে গ্রহণ করে। এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। ঝামেলা বাধে পরের দিন।’
রনি স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন, ‘পরের দিন বান্ধবী আয়শা আমাকে কল করে জানায় যে বৃদ্ধ লোকটি মিল্টন এর আশ্রমে নাই, ওনার পরিবার খুঁজে পেয়েছে, সাভারে ওনার পরিবার এর কাছে হস্তান্তর করেছে। এই সংবাদ পেয়েই আমাদের মনে খটকা লাগে। এতদিন একটা লোকের পরিবার পাওয়া গেল না, অথচ আমরা দিয়ে আসার ১০ ঘণ্টার মধ্যে ওনার পরিবারকে পেয়ে গেল? ওনার পরিবার পাওয়া নিয়েও আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। আমি যেহেতু থানায় জিডি করে ওনার অভিভাবক হয়েছিলাম সেহেতু আমাকে জানিয়ে ওনার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা উচিত ছিল। বিষয়টা আমাদের ভাবায়। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিই স্বশরীরে গিয়ে খোঁজ নিব। যেমন ভাবা তেমন কাজ, আমি আমার বন্ধু সাইফুল দাদু, তাজুল, বান্ধবী আয়শা, ও ওর স্বামী সোহেল ভাই সন্ধ্যায় মিল্টন এর আশ্রমে যাই সেই বৃদ্ধ লোকের অবস্থান জানতে।’
‘আমরা যাওয়ার পরে মিল্টন সেখানে ছিল না, আশ্রমের লোকেরা আমাদের বসতে বলে মিল্টনকে খবর দেয়। আনুমানিক ৫ মিনিট পরেই মিল্টন ও ওর বউ ডাইনি অফিস রুমে প্রবেশ করে।’
মো. মোতালেবকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে এমন সন্দেহ প্রকাশ করে রনি অভিযোগ, ‘বান্ধবী আয়শা শুধু জিজ্ঞাসা করেছে যে, আমাদের না জানিয়ে ওই লোককে কোথায় পাঠিয়েছেন? এটা বলার সাথে সাথেই মিল্টন ও ওর বউ আয়শাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি দেয় এবং গায়ে হাত তুলতে থাকে। এটা দেখে বান্ধবীর জামাই সোহেল ভাই আয়শাকে রক্ষা করতে যায়, সেই অবস্থায় মিল্টন এর কর্মচারীরা সোহেল ভাইকে আক্রমণ করে। তখন আমি, বন্ধু সাইফুল ও তাজুল, আয়শা ও সোহেল ভাইকে রক্ষা করতে যাই। তখন আশ্রমের আরো কর্মচারী আমাদের তিন বন্ধুর উপর আক্রমণ করে আমাদের সরিয়ে নিয়ে যায় এবং আয়শা ও ওর স্বামীকে বেধড়ক মারধর করে। আমাদের প্রায় দুই ঘণ্টা আটকে রেখে সাদা কাগজে সই নিয়ে ছেড়ে দেয়। আমরা সেই বৃদ্ধ লোকের আর কোনো সংবাদ পাই নাই। আমার বিশ্বাস মিল্টন ওই লোককে বিক্রি করে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আশ্রম থেকে বের হয়েই সেই পুলিশ ইয়াহিয়ার সাথে যোগাযোগ করে ঘটনার বিস্তারিত বলে পুলিশি সহযোগিতা চাই। কিন্তু ইয়াহিয়া আমাদের নিরুৎসাহিত করে, বলে মিল্টন এর অনেক ক্ষমতা, ওর সাথে না লাগার জন্য। আয়শা ও ওর স্বামী শারীরিক হেনস্থা হওয়ার পরে এটা নিয়ে আর আগাতে চায়নি। আমিও আর কিছু করিনি।’
রনি মল্লিক আরও বলেন, ‘আমার বান্ধবী আয়শা আজ স্বর্গবাসী। এই অবস্থায় যদি আমি মিল্টন এর অন্যায় এর প্রতিবাদ না করি তাহলে আয়শার আত্মা কষ্ট পাবে, আমাকে অভিশাপ দিবে।’
মিল্টন সমাদ্দারের পাশে দাঁড়ানো লোকজনের উদ্দেশে সবশেষে রনি মল্লিক বলেন, ‘সত্যিকারের মিল্টন একটা জানোয়ার, অমানুষ, হিংস্র পশু। যারা এই জানোয়ার এর পক্ষে কথা বলছেন তারা দয়া করে সত্যিটা জানার চেষ্টা করুন।’