প্রার্থী ‘মনোনয়ন’ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের এমপিরা!
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ঠিক চার মাসের মাথায় প্রথম ধাপে আগামী ৮ মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ১৫২টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনকে দেশে-বিদেশে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে দল মনোনীত প্রার্থীদের পাশাপাশি দলীয় নেতাদেরও প্রার্থী হতে পারাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। প্রায় একই কৌশলে এবার উপজেলা নির্বাচনকেও অংশগ্রহণমূলক দেখাতে চায় আওয়ামী লীগ।
এজন্য এবার উপজেলা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলটি দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে, দলীয় সেই সিদ্ধান্তকে ‘কৌশলী আমলে’ নিয়ে আওয়ামী লীগের এমপি এবং ‘দলীয়-স্বতন্ত্র’ এমপিদের বেশিরভাগই নিজ নির্বাচনি এলাকার উপজেলাসমূহে পছন্দের লোককে চেয়ারম্যান ও ভাইস- চেয়ারম্যান পদে ‘মনোনয়ন’ দিচ্ছেন।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা পরিষদের জন্য আওয়ামী লীগের ‘দলীয় প্রার্থী’ হিসেবে দু’জনের নাম ঘোষণা করেছেন স্থানীয় এমপি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান। মঙ্গলবার স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রের ইয়ুথ ইন চত্বরে কুয়াকাটা পৌরসভা ও পৌর আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান বলেন, ‘আগামী উপজেলা নির্বাচনে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা দল থেকে, আওয়ামী লীগ থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে আওয়ামী লীগের বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক ত্যাগী নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব তালুকদারকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। এছাড়া ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মো. ইউসুফ আলীকে দল থেকে মনোনীত করেছি।’ এই ঘোষণা দিয়ে তিনি উপস্থিত সবার সামনে ওই দু’জনকে পরিচয় করিয়ে দেন।
জানা গেছে, ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমানের মতো আওয়ামী লীগের সরাসরি দলীয় ও ‘দলীয়-স্বতন্ত্র’ এমপিদের অনেকেই নিজ-নিজ উপজেলায় পছন্দের লোককে নিজের প্রার্থী হিসেবে ‘মনোনয়ন’ দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনটিকেও দেশে-বিদেশে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে চায় ক্ষমতাসীনেরা। দলীয়ভাবে মনোনয়ন না দেওয়ার আওয়ামী লীগের অবস্থানের পেছনে বিএনপিসহ বিরোধীদের ভোটে আনাও অন্যতম লক্ষ্য। তবে, বিএনপি এই উপজেলা নির্বাচনকে দলের জন্য আওয়ামী লীগের পাতা ‘ফাঁদ’ মনে করছে। তাদের মতে, সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলে তাতে সরকার ফলাও করে প্রচার করতে পারবে যে- বিএনপি বুঝতে পেরেছে সংসদ নির্বাচনে না যাওয়া তাদের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। একইসঙ্গে ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন নিয়ে চলমান বিতর্কও চাপা পড়ে যাবে বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা।
জানা গেছে, বিএনপি দলীয়ভাবে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলেও এই নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী দলটির তৃণমূলের নেতাদের কেউ কেউ। তারা এখন তাকিয়ে আছেন দলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। জানা গেছে, সোমবার অনুষ্ঠিত বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এনিয়ে আলোচনা হয়েছে, তবে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য অভিমত দিয়ে বলেছেন, তৃণমূলের কেউ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে দল কেন্দ্রীয়ভাবে উৎসাহিত করবে না, আবার সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রেও ‘বেখয়াল’ থাকার কৌশল নেবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনেই যাবে না। তাদের অধীনে কোনো নির্বাচন হয় না, নির্বাচনের নামে নাটক হয়। তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আমাদের কোনো ভাবনা নেই। আমাদের মূল মনোযোগ দেশের মানুষের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দিকে। সেই লক্ষ্য অর্জনে আমরা দলকে সংগঠিত করে জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলনে রয়েছি।
আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে প্রার্থী না দেওয়ার এবং বিএনপি দলগতভাবে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বর্তমান সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টি (জাপা) এরইমধ্যে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, দলটি দলীয়ভাবেই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন হারানো জামায়াতের দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। তবে, জামায়াতের কোনো কোনো তৃলমূল নেতা স্বতন্ত্রভাবে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হবেন। এব্যাপারে দলের কেন্দ্রীয়ভাবে ‘নিরব সায়’ রয়েছে। এছাড়া, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মিত্র দলগুলোর কারও এই উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ নেই।
জাপা গতবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে মাত্র তিনটি উপজেলায় সফল হয়েছিল। এবারও জাপার প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক ‘লাঙ্গল’ মার্কায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানিয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা জিএম কাদের। গত ৯ ফেব্রুয়ারি রংপুর শহরে নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমরা দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নেব। প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।’
জানা গেছে, প্রথম ধাপে যে ১৫২টি উপজেলায় নির্বাচন হতে যাচ্ছে সেগুলোর মধ্যে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলা পরিষদও রয়েছে। তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই এই উপজেলায় আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের কোনো তৎপরতা নেই। তবে, স্থানীয় জামায়াতের এক নেতা এরইমধ্যে মাঠে নেমেছেন। তফসিল ঘোষণার একদিন আগে থেকেই জামায়াতে ইসলামীর দিনাজপুর দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলার নায়েবে আমির মুহাদ্দিস এনামুল হক নির্বাচনি তৎপরতা শুরু করেছেন।
উপজেলা নির্বাচন ঘনিয়ে এলেও কার্যত আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলেরই তেমন আগ্রহ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ফলে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতোই উপজেলা নির্বাচনেও ভোট বর্জনের পথে হাঁটছে সরকারবিরোধী দলগুলো। উপজেলা নির্বাচনের চেয়ে আন্দোলনকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। তাদের মতে, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ কিংবা স্বাধীন নয়, তাদের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা নেই। এজন্য ভোটার ও নেতা-কর্মীরাও আগ্রহ হারিয়েছেন।
বিএনপির মিত্র লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, বর্তমান সরকার দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। বিএনপিসহ আমরা যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছি। উপজেলা নির্বাচন নিয়েও আমাদের কোনো আগ্রহ নেই, মাথাব্যাথাও নেই। বিএনপির মিত্র বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, তাদের দলসহ গণতন্ত্র মঞ্চ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবে না। তবে, স্বতন্ত্রভাবে কিংবা মঞ্চের শরিক দলগুলোর কোনো নেতা নির্বাচনে অংশ নিলে, তাদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে; সেবিষয়ে এখনও বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। বিএনপির মিত্র জোট ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদার মতে, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া আর আত্মহত্যার মদ্যে তফাত নেই।
এদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছোট এবং ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত নতুন দলগুলো উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় প্রার্থী দিলেও আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ঘিরে তাদেরও আগ্রহ নেই। এ নির্বাচনে প্রার্থীদের জামানতের পরিমাণ ১০ গুণ বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টিও অন্যতম একটি কারণ। দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যাদের আর্থিক সামর্থ্য এবং জনপ্রিয়তা রয়েছে তারাই প্রার্থী হবেন। এখানে দলের মনোনয়নের প্রয়োজন নেই। গতবারের উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়নি চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলটি অংশ নেয়নি। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনেও দলটি প্রার্থী দেবে না বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, বিদ্যমান আইনে উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস-চেয়ারম্যান- এই তিন পদেই রাজনৈতিক দল থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার বিধান রয়েছে। নির্বাচন কমিশন এরইমধ্যে যেসব রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে প্রার্থী দিতে চায়, সেসব দলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বা সমপর্যায়ের পদাধিকারীদের অথবা তাদের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্তদের স্বাক্ষরসহ তালিকা চেয়ে পাঠিয়েছে।