বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল
অগ্নিঝরা মার্চের ২৪তম দিন আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যকার পূর্বনির্ধারিত বৈঠকটি বাতিল হয়ে যায়। এদিকে করাচি থেকে ‘সোয়াত’ জাহাজে করে আনা ৫ হাজার ৬৩০ টন অস্ত্র নামাতে এদিন বাঙালি শ্রমিকরা অস্বীকৃতি জানান এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। অবরোধ করে রাখেন জাহাজটিকে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন বেশ কয়েক জন স্বাধীনতাকামী শ্রমিক। এছাড়া এদিনেই সৈয়দপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে কমপক্ষে ৩০০ বাঙালিকে হত্যা করে। মিরপুরে অবাঙালিরা বাঙালিদের বাড়ির ওপর ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা ও কালো পতাকা জোর করে নামিয়ে দেয়। রাতে বিহারিরা ঐ এলাকায় ব্যাপক বোমাবাজি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
এদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সমাগত মিছিলকারীদের উদ্দেশে বিরামহীন ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সরকারকে হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, ‘বাংলার জনগণের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলে তা বরদাশত করা হবে না।’ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, ‘আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। আগামীকালের (২৫ মার্চ, ১৯৭১) মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে বাঙালিরা নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে। আমরা ৭ কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোনো ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি কঠোরতর সংগ্রামের নির্দেশ দেওয়ার জন্য বেঁচে থাকব কি না জানি না। দাবি আদায়ের জন্য আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। মানুষের মতো স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকব, নয়তো সংগ্রামে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।’
এদিন সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। প্রায় তিন ঘণ্টার ঐ বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য প্রদান শেষ। এখন প্রেসিডেন্টের উচিত তার ঘোষণা দেওয়া। তিনি বলেন, ‘আজ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ আলোচনা আর দীর্ঘ করতে রাজি নয়।’
২৩ মার্চ রাত থেকে ২৪ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসের পাশের এলাকা বোতলগাড়ী, গোলাহাট ও কুন্দুল গ্রাম ঘেরাও করে অবাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে ১০০ জন নিহত এবং ১ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়। রংপুর হাসপাতালের সামনে ক্ষুব্ধ জনতা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি সেনারা সেনানিবাসসংলগ্ন এলাকায় নিরস্ত্র অধিবাসীদের ওপর বেপরোয়া গুলি চালায়। তাতে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়। চট্টগ্রামে পাকিস্তানিরা সেনারা নৌবন্দরের ১৭ নম্বর জেটিতে সোয়াত জাহাজ থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে গেলে স্থানীয় বাঙালিরা তাদের ঘিরে ফেলে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে কিছু অস্ত্র নিজেরাই খালাস করে ১২টি ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়ার সময় জনতা পথরোধ করে। সেনাবাহিনী ব্যারিকেড দেওয়া জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে শতাধিক শ্রমিক শহিদ হন। এদিকে এতদিন যারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন, তারাও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন ব্যক্ত করতে শুরু করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচার গুলি, আন্দোলনরত বাঙালির ওপর নির্যাতন, চরম দুর্ব্যবহার ও পাকিস্তানের পক্ষে অনুষ্ঠান প্রচারের চাপের মুখে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের সর্বস্তরের বাঙালি শিল্পী-কলাকুশলী কাজ বর্জন করে কর্মস্থল ত্যাগ করেন। ফলে এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা টিভির সম্প্রচারও বন্ধ হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র গণবিপ্লবকে আরও জোরদারে জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়।