‘মানুষের ভালোবাসা নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে চাই’
শিমুল মুস্তাফা। আমাদের দেশে আবৃত্তিশিল্পে তার নিবেদন দীর্ঘদিনের। তার কণ্ঠেই কবিতা এক অনন্য রূপ পায়। নিজের এই আবৃত্তি সংগ্রাম নিয়ে সারাদেশে অগণিত ভক্ত বা শিষ্যদের কাব্য প্রেমের ঘোরে রাখছেন তিনি বহুকাল। এবার রাষ্ট্র তাকে একুশে পদক দিতে যাচ্ছে।
দেশসেরা এই আবৃত্তিকার পদক প্রাপ্তিসহ একাধিক প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বললেন। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন তানভীর তারেক
কবিতাকে হূদয়ে লালন করার স্বীকৃতি পাচ্ছেন। এমন সম্মান পাওয়ার অনুভূতি আসলে কেমন?
দেখুন, একুশে পদকের মতো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার অনুভূতি আসলে এক কথায় বলে বোঝানো যাবে না। একটা জীবন তো কবিতার সঙ্গেই পার করলাম। সেই জায়গা থেকে একুশে পদক দায়বোধ এবং ভালোবাসা আরো বাড়িয়ে দিলো। এমন সম্মান দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
বৈকুণ্ঠ আপনার একটা স্বপ্ন। এটাকে নিয়ে সুদূর ভাবনা কত দূর?
এটা আমার একটা ব্যক্তিগত আন্দোলনের নাম। আবৃত্তি বা কবিতাকে আমার কণ্ঠে ধারণ করে তাকে জনপ্রিয়তার অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়া একদিনে হয়নি। বইমেলায় আমাকে ক্যাসেট বিক্রি করতে দিত না। আমি স্টল দিয়ে দীর্ঘদিন বিক্রি করেছি। এখন তো কত আজে-বাজে দোকান দেখি। তবে আবৃত্তিচর্চার ভেতর দিয়েই ভাষাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা যায়। এর কোনো উত্কৃষ্ট বিকল্প নেই। তবু আমরা খুব শর্টকাট খুঁজি। অনেকেই আমার কাছে আসেন। বলেন, এ সপ্তাহের ভেতরে আবৃত্তিটা একটু শিখিয়ে দেন। টাকা বেশি দেবো। আমি তখন বলি, তাহলে আরো ২টা দিন বেশি যোগ করে দেন, সাথে নাচটাও শিখিয়ে দিই। এই হলো অবস্থা।
শুধু তথাকথিত আবৃত্তিকার কেন, কবিদেরও তো একই অবস্থা…
হ্যাঁ, ইদানীংকালের কতিপয় কবিদেরও দেখি। আমাকে আবৃত্তির জন্য অনুরোধ করেন। ৮/১০টা বই বেরিয়ে গেছে তার। একটা কবিতাও বাছাই করতে যখন না পারি তখন খুব কষ্ট পাই। কারণ ওই কবি কবিতা লিখেননি, কবিতার লাইন ভরাট করেছেন। ৩০টা কবিতা হলেই তো ১টা বই। ৬০টায় ২টা। এভাবে বই করার জন্য কবিতা লিখলে কবিতার শরীর তৈরি হয় না। কবিতা লিখে যেতে হয়। ১০০ কবিতা থেকে ১০টা সম্পাদনা করলে সেটা হয়তো কবিতার মানদণ্ডে ফেলানো যায়। কিন্তু আমাদের সেই ধৈর্য কোথায়!
একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আপনার একটা স্মৃতিকথা শেয়ার করুন—
অগণিত স্মৃতি। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ফুল জোগাড় করে শহিদ বেদী সাজানো এবং নিজেরা একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। এগুলো এ প্রজন্মের ছেলেরা বুঝবে কী করে। এখন সেটা চলে গিয়েছে পোশাকে বা ফেসবুকের ওয়ালে।
গণমাধ্যমে এখন বাংলা ভাষার চর্চা কেমন হচ্ছে। বিশেষ করে টিভি বা এফএম স্টেশনে…
এটা এক সময় খুব প্রকট ছিল। কিন্তু আমার মনে হয় সচেতনতা বাড়ছে। তবুও অনেক কাজ বাকি। প্রত্যেক সংবাদ পাঠক কি উচ্চারণ শিখে ক্যামেরার সামনে বসছে? যেমন গান খুব জনপ্রিয় একটা মাধ্যম। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আমার সাক্ষাত্ গুরু ছিলেন। তিনি একাধারে শক্তিমান কবি, গীতিকবি, গায়ক। গানের ক্ষেত্রে উচ্চারণ নিয়ে তিনি অনেক বেশি সচেতন ছিলেন। কারণ একটি জনপ্রিয় মাধ্যমে ভুল উচ্চারণ ছড়িয়ে পড়লে সমাজের বিশাল ক্ষতি হয়ে যায়।
কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের স্পট রিপোর্টিংয়ে দেখা গেছে তারা শহিদ দিবস বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কেই জানেন না!
এটাও অনেকখানি কমেছে। এর প্রকোপ বেড়েছিল ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলগুলোর অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপে। এটি এখন অনেকখানি কমতে শুরু করেছে। আমার মনে হয় পরিবারে আধুনিক বাবা-মায়েরাও এখন পড়াশোনার পাশাপাশি দেশীয়-সংস্কৃতি শেখানোর ব্যাপারে মনোযোগী হচ্ছেন। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।
কিন্তু কীভাবে? এখনকার অধিকাংশ নাটকের নাম ইংরেজি শব্দে, ওয়েব সিরিজে তো কথাই নেই!
এগুলো খুব গুরুত্বসহকারে নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। আমরা যেমন প্রতিটি বিপণী দোকানের সাইনবোর্ডে বাংলা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে পেরেছি, এটাও আইন করেই করতে হবে। আমি ইংরেজি শব্দের বিরোধী নই। খুব জনপ্রিয় শব্দগুলো আসতেই পারে। কিন্তু নিজেকে বিশাল মাপের আধুনিক প্রমাণ করার জন্য যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করার চেষ্টা করছি সেখানে সচেতন হওয়া জরুরি। আমি অনেককে দেখেছি এমনিতে আড্ডায় বেশ ভালো বাংলা বলেন। কিন্তু টক শো বা সভা সেমিনারে তার ইংরেজি শব্দের প্রয়োগ বেড়ে যায়। এটা মহা অন্যায়। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার ইংরেজির শিক্ষক। ওনার মতো দারুণ ইংরেজি বলা মানুষ কম রয়েছে। অথচ তাকে ২ ঘণ্টা বক্তব্য দিতে বলুন। ১টা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করেই সাবলীল কথা বলতে পারবেন। এখানেই আধুনিকতা।
রুদ্রদার কথা যেহেতু এলো। আমরা জানি আপনি তার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কোনো একটা দারুণ স্মৃতি কি আজ বলবেন?
আমি আর সঞ্জীব চৌধুরী ছিলাম তার একনিষ্ঠ ছায়াশরীর। একবার দারুণ এক আড্ডা চলছে টিএসসিতে। হঠাত্ রুদ্রদা কিছু লাইন লিখে সুর করে আওড়াতে লাগলেন। আমি, সঞ্জীব, শংকর সাঁওজাল একসাথে। আমি তার সুর শুনে বললাম, এটা তো পরিচিত কোনো গানের সুর বলে মনে হচ্ছে। রুদ্র বললেন, না, এটা হতেই পারে না। আমার নিজের টাটকা বানানো সুর এটা। পরে গাইতে লাগলেন। শংকর সাঁওজাল বললেন, এ গানটা আমার। এটা আমি গাইবো। আমরা এভাবেই হয়ে গেলাম ইতিহাসের সাক্ষী। কারণ গানটি ছিল ‘ভালো আছি ভালো থেকো।’