Home অপরাধ নগরে সড়ক পরিবহনে বেপরোয়া চাঁদাবাজি অভিযানেও থামছে না কোটি টাকার টোকেন বাণিজ্য
ফেব্রুruari ১০, ২০২৪

নগরে সড়ক পরিবহনে বেপরোয়া চাঁদাবাজি অভিযানেও থামছে না কোটি টাকার টোকেন বাণিজ্য

পরিবহন সেক্টরে দিন দিন বেড়েই চলছে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য। ব্যাঙের ছাতার মতো গজানো নানা সমিতি বা সংগঠনের নামে-বেনামে স্টিকার ও লোগো লাগিয়ে চলছে টোকেন বাণিজ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এসব অপরাধীদের ধরা হলেও জেল থেকে বের হয়ে আবারো শুরু হয় একই কার্যক্রম।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মোড়, চকবাজার, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, বন্দর, নিউ মার্কেট, কর্ণফুলী নতুন ব্রিজ, দেওয়ানহাট, ইপিজেড, অলঙ্কার মোড়, অক্সিজেন মোড়, হাটহাজারি রোডসহ ১৬ থানায় অর্ধ শতাধিক স্পট দখল-বেদখল করে সমিতি কিংবা সংগঠনের নামে কোটি টাকার টোকেন বাণিজ্য করছে এসব চক্রের সদস্যরা। তাদেরকে কে বা কারা রোডে গাড়ি চলাচল করার অনুমতি কিংবা বাধাদানের মতো নির্দেশ দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে তাও জানা যায় না। এমনকি চাঁদার নির্দিষ্ট টাকা দেওয়া না হলে মামলার ভয় দেখানো হয় বলেও জানা যায়। যার ফলে রাস্তায় বৈধভাবে লাইসেন্স ও রোড পারমিট নেওয়ার পরও ড্রাইভাররা এসব সংগঠনের কাছে জিম্মি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কাপ্তাই রাস্তার মোড় স্পট থেকে মাসে অর্ধ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে অটোরিকশা-অটো-টেম্পোচালক সমন্বয় পরিষদসহ নামে-বেনামে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। এ রোড দিয়ে চলাচলকারী চার থেকে পাঁচশোর অধিক অটোটেম্পো থেকে মাসে টোকেন বাবদ আদায় হয় সাড়ে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। ১২শ ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে টোকেনে আদায় হয় ৩০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে শ্রমিক সংগঠনের ব্যানারে কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয় কাপ্তাই রাস্তার মোড়ের স্পট থেকে। এ স্পটে প্রকাশ্য চাঁদাবাজি চললেও তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযান চালানো হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে- চাঁদাবাজির একটি অংশ যায় স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা এবং পুলিশের পকেটে। যদিও ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে মাসোহারার বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উত্তর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ট্রাফিক জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমরা ট্রাফিক আইনগুলো দেখাশোনা করি। ট্রাফিক সেক্টরে যদি কেউ চাঁদাবাজি করে তাহলে তার বিষয়ে ভালো বলতে পারবে নিকটস্থ থানা বা ডিসি অপরাধ বিভাগ। আর আমাদের কোন ট্রাফিক কর্মকর্তা যদি চাঁদাবাজির অপরাধে জড়িত থাকে তাহলে ভুক্তভোগীরা আমাদের জানাতে পারে। আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’
এদিকে নগরীর উল্লেখযোগ্য চাঁদাবাজি হয় চকবাজার ও বাকলিয়া এলাকায়। চকবাজার কাঁচাবাজারের পাশেই টমটম গাড়ির স্ট্যান্ড। সেখান থেকে বাকলিয়া রাহাত্তারপুল, কালামিয়া বাজার, টেরিবাজার, কোরবানিগঞ্জ ও আন্দরকিল্লার মাতৃসদন হাসপাতালের পাশ হয়ে ময়দার মিল এলাকায় চলে টমটম ও সিএনজি চালিত টেক্সি। এসব রোডে অন্তত গাড়ি চলে ৫০০ এর অধিক। এসব রোডে টমটম চালানোর নির্দেশনা না থাকলেও প্রভাবশালীদের ক্ষমতাবলে গাড়ি ঠিকই চলছে। তবে এসব রোডে গাড়ি রোডে চালাতে হলে ড্রাইভারদের নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। যার ভাগ নেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
এছাড়া জানা যায়, চকবাজার গোলজার মোড় থেকে শতাধিক মাহিন্দ্র ও লম্বা টেম্পো আগ্রাবাদ বারেক বিল্ডিং মোড় পর্যন্ত চলাচল করে। কাপ্তাই রাস্তার মোড় থেকে বহদ্দারহাট মোড় হয়ে প্রায় আরও শতাধিক গাড়ি সিনেমা প্যালেস হয়ে শাহ আমানত মার্কেট এলাকায় যায়। এসব গাড়ি থেকে দিনে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা করে চাঁদা নেয় চক্রের সদস্যরা। এ চক্রের রয়েছে ১৫ জনের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
তাছাড়া এসব সিন্ডিকেট থেকে টিকেট না নিয়ে গাড়ি চালানোর কারণে ইতিপূর্বে বেশ কয়েকজন ড্রাইভারের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
এদিকে চট্টগ্রাম অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন ও লালদীঘি অটো টেম্পো সার্ভিসের নাম ব্যবহার করে নগরীর বাকলিয়া থানার নতুন ব্রিজ থেকে কোতোয়ালী থানার নিউ মার্কেট পর্যন্ত এলাকায় পরিবহন সেক্টর থেকে চাঁদাবাজি করার অভিযোগ রয়েছে। নতুন ব্রিজ থেকে নিউ মার্কেট সড়কে রুট পারমিটবিহীন প্রায় ২ শতাধিক মাহিন্দ্র, ম্যাক্সিমা গাড়ি চলাচল করে। ওই গাড়িগুলো থেকে চট্টগ্রাম অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের নামে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা হারে চাঁদা নেয় জানে আলমের নেতৃত্বে একটি চক্র। ড্রাইভারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চক্রটির মধ্যে রয়েছে লিটন, কালু, হিরু, রফিক (১), রফিক (২), আবুল হোসেন, জামাল উদ্দিন, মোহাম্মদ কাশেম। এই রোড থেকে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হয় ৪০ হাজার টাকার বেশি বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে জানতে বুধবার বিকালে লালদীঘি অটো টেম্পো সার্ভিসের সভাপতি জানে আলমের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এম এন নাসিরুদ্দিন বলেন, ‘নতুন ব্রিজ, নিউমার্কেট এলাকাগুলো আমার আওতাধীন এলাকা। কোন সমিতি কিংবা সংস্থার ব্যানারে যদি কোন গাড়ি থেকে চাঁদা তোলা হয় তাহলে নিকটস্থ থানায় জানাতে পারে। আর ট্রাফিক পুলিশের কোন কর্মকর্তা যদি জড়িত থাকে অভিযোগ করলে বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।’
বন্দর থানার টোল প্লাজা রোড়ে গাড়ি রাখলেই স্থানীয় প্রভাবশালী তিন সিন্ডিকেটকে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দিতে হয়। গাড়িচালকরা জানান, বন্দর থেকে বের হলে টোল প্লাজার আগে সক্রিয় রয়েছে দুটি সিন্ডিকেট, অপরটি টোলের পরে। স্থানীয়রা জানান, সাদ্দাম, রফিক, রাব্বি, জনি, শাহজাহান, আলতাফ, শফি, রাশেদ, নয়ন, বুলবুল ও হাবিব শরীফ ও আবু সায়িদসহ প্রায় ৪০ জনের অধিক সদস্য নিয়ে এ তিনটি সিন্ডিকেট সড়কে চাঁদাবাজি করছে।
এদিকে র‌্যাবের অভিযানেও তার সত্যতা উঠে এসেছে। মঙ্গলবার র‌্যাবের এক অভিযানে চান্দগাঁও, পাহাড়তলী, আকবরশাহ ও বায়েজিদ থানায় পৃথক অভিযান চালিয়ে ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর থেকে চকবাজার, বাকলিয়ার নতুন ব্রিজ ও দেওয়ানহাট এলাকার চাঁদাবাজরা আপাতত গা ডাকা দিলেও অব্যাহত রয়েছে তাদের টোকেন বাণিজ্য।
র‌্যাবের সিনিয়র সহকারী পরিচালক নূরুল আবছার বলেন, চান্দগাঁও থানাধীন কাপ্তাই রাস্তার মাথায় রিয়াদ এবং বখতিয়ার উদ্দিন সিকদারের নেতৃত্বে দিনে ৪ লাখ, বালুর টাল এলাকায় রুবেল ওরফে ইয়াবা রুবেল এবং মিজান এর নেতৃত্বে দিনে ৬ হাজার, পাহাড়তলী থানার মো. পেয়ার আহম্মেদের নেতৃত্বে টমটম ও সিএনজি থেকে মাসে ৮০ হাজার, আকবরশাহ এবং এ কে খান মোড় এলাকায় নারায়ন দে নামক এক প্রভাবশালীর নেতৃত্বে দিনে ১০০ টাকা এবং বায়েজিদ থানাধীন অক্সিজেন মোড় এলাকায় মো. সোহেল এর মিনিবাস এবং ট্যাম্পু থেকে মাসিক ৮০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। তাদের গ্রুপের ৩০ জন চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নামে-বেনামে তারা চাঁদা তোলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদেও স্বীকার করেন।
এদিকে সড়কপথে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অব্যাহত অভিযান কার্যক্রম সক্রিয় রয়েছে বলে জানান সিএমপির ক্রাইমস অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগ।
বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আ স ম মাহতাব উদ্দিন সুপ্রভাতকে বলেন, ‘চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অনেক আগে থেকেই নির্দেশনা রয়েছে। আমরা চাঁদাবাজির প্রমাণ পেলেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *