Home বানিজ্য জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমে, সরকার কমায় না
জানুuari ২৪, ২০২৪

জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমে, সরকার কমায় না

বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের কথা বলে দেড় বছর আগে বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। তখন বলা হয়েছিল, বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও কমবে। তবে সেটি আর হয়নি। গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া বাড়তি অর্থে দেড় বছর ধরে মুনাফা করছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের শুল্ক-কর থেকে বিপুল রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি লভ্যাংশও নিয়েছে সরকার।

২০২২ সালের আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম সর্বোচ্চ সাড়ে ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ওই মাসে মাত্র ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ দাম কমানো হয়েছিল (প্রতি লিটারে কমেছিল ৫ টাকা)। এর পর থেকে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিন ১০৯ টাকা, পেট্রল ১২৫ টাকা ও অকটেন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়।

বিপিসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিপিসি মুনাফা করেছে ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। সরকারকে লভ্যাংশ দিয়েছে ২০০ কোটি টাকা। বিপিসির সূত্র বলছে, গত অর্থবছরের মুনাফা থেকে লভ্যাংশ নেওয়ার পাশাপাশি উদ্বৃত্ত অর্থ হিসেবে বিপিসির কাছ থেকে ৫০০ কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেও (জুলাই-ডিসেম্বর) ৪০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে বিপিসি।

কর থেকে সরকার রাজস্ব বাড়াতে পারছে না। তাই যেখান থেকে রাজস্ব পায়, সেখান থেকে আর সরতে চায় না। বিশ্ববাজারে উচ্চ দামের সময় দেশে দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর বিশ্ববাজারে কমার পর বিপিসি চুপচাপ মুনাফা করছে।

ম তামিম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, লম্বা সময় ধরে মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। দাম নিয়ন্ত্রণ করাটাকেই মূল অগ্রাধিকার বলেছে নতুন সরকার। অথচ গ্যাসের দাম বাড়িয়ে মুনাফা করছে পেট্রোবাংলা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে মুনাফা করছে বিপিসি। জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুযোগ ছিল। এটি কমালে বাজারে পণ্যের দাম কমত।

দেশে জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহের একমাত্র সংস্থা হলো বিপিসি। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েল ও উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জেট ফুয়েলের মতো তেলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করে তারা। এই দুই ধরনের তেল বিক্রি করে সব সময়ই মুনাফা করে বিপিসি। তবে পরিবহনে ব্যবহৃত ডিজেল, পেট্রল, অকটেনের দাম নির্বাহী আদেশে নির্ধারণ করে জ্বালানি বিভাগ। এর মধ্যে পেট্রল ও অকটেনে সব সময়ই মুনাফা করে বিপিসি। দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭৫ শতাংশই ডিজেল। কয়েক মাস ধরে ডিজেল বিক্রি করেও মুনাফা করছে তারা।

অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বিপিসির নিট (কর দেওয়ার পর) মুনাফা ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। একই সময়ে সরকারকে লভ্যাংশ দিয়েছে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিপিসির ব্যাংক হিসাবে জমা থাকা উদ্বৃত্ত তহবিল থেকে দুই দফায় ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। এর বাইরে জ্বালানি তেলের শুল্ক-কর থেকে প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায় সরকার। টানা সাত বছর মুনাফা করার পর ২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিসি লোকসান করে। বিপিসির হিসাব বলছে, ওই সময়ে ২ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা লোকসান করে সংস্থাটি। ওই অর্থবছর শেষ হওয়ার এক মাস পর বাড়ানো হয়েছিল জ্বালানি তেলের দাম।

ডলার–সংকটের চাপে জ্বালানি তেলের মজুত

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, এর মধ্যে দাম কমানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। মূল জ্বালানি তেল হলো ডিজেল, আর ডিজেল বিক্রি করে মুনাফা হচ্ছে না। অন্যান্য জ্বালানি তেলের মুনাফা, স্থায়ী আমানত (এফডিআর) থেকে আয় ও অন্যান্য আয় মিলে বিপিসির মুনাফা হয়েছে। তবে এপ্রিল থেকে স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয় চালু করা হবে। এরপর বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও কমবে।

দাম কমানোর সুযোগ ছিল

২০২২ সালের মার্চে বিশ্ববাজারে অপরিশোধ জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল (১৫৮ দশমিক ৯৯ লিটার) ১৪০ ডলারে পৌঁছায়। একই সময়ে ডিজেলের দাম ১৭০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর ধাপে ধাপে দাম কমতে থাকে। যদিও বিশ্ববাজারে ডিজেলের গড় দাম ১৩৯ ডলার ধরে দেশে নতুন দাম নির্ধারণ করে সরকার। এর সঙ্গে পরিবহন ভাড়া এবং বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও কর যুক্ত হয় ৩২ শতাংশ। এ ছাড়া ৬ শতাংশ মুনাফা ধরে বিপিসি। আর গ্রাহক পর্যায়ে নির্ধারিত দামের সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবেশকদের কমিশন। এরপর গত বছর জ্বালানি তেলের দাম কমে ৭০ ডলারের নিচে নেমে আসে বিশ্ববাজারে। তবে বর্তমানে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৮০ ডলার। আর ডিজেলের দাম ৯৮ ডলার।

বিপিসির দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে। এরপরও এখন প্রতি লিটার পেট্রল ও অকটেনে ২০ টাকার বেশি মুনাফা করছে বিপিসি।

বিপিসির দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে। এরপরও এখন প্রতি লিটার পেট্রল ও অকটেনে ২০ টাকার বেশি মুনাফা করছে বিপিসি। আর ডিজেল বিক্রি করে প্রতি লিটারে ৩০ পয়সা মুনাফা হচ্ছে। তবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এ বছর কমতে পারে বলে পূর্বাভাস আছে একাধিক বৈশ্বিক গবেষণা সংস্থার। যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাকস বলছে, এ বছর জ্বালানি তেলের দাম ৭০ থেকে ৯০ ডলারের মধ্যে থাকবে।

এপ্রিল থেকে প্রতি মাসে দাম নির্ধারণ

ঋণসহায়তার শর্ত হিসেবে ভর্তুকি সমন্বয়ের পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ডিজেল, পেট্রল, অকটেনের মতো জ্বালানি তেলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করতে চায় সরকার। শুরুতে এটি তিন মাস পরপর নির্ধারণের পরিকল্পনা থাকলেও এখন প্রতি মাসে নির্ধারণের চিন্তা করা হচ্ছে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে নিয়মিত দাম সমন্বয় করা হবে। গত সেপ্টেম্বর থেকে এটি চালু করার কথা থাকলেও হয়নি। আগামী এপ্রিল থেকে এটি কার্যকর হতে পারে। ইতিমধ্যে মূল্য সমন্বয়ের একটি সূত্র তৈরি করেছে বিপিসি। এ সূত্র চূড়ান্ত করছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।

তেলের দাম এ বছর ১০ শতাংশ কমেছে, ২০২৪ সালে কী হবে

তেলের দাম এ বছর ১০ শতাংশ কমেছে, ২০২৪ সালে কী হবে

বিপিসি সূত্র বলছে, দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের দাম ও ডলারের বিপরীতে টাকার মান হিসাব করা হবে। আগের মাসের জ্বালানি তেলের দাম গড় করা হবে। এর বাইরে আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে আমদানি শুল্ক। বর্তমানে আমদানি করা জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে ট্যারিফ মূল্য ধরে শুল্ক হিসাব করা হয়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বা কমলেও এটি পরিবর্তন হয় না। ট্যারিফ মূল্য সাধারণত কেনা দামের চেয়ে কম ধরা হয়। এতে শুল্ক খরচ কমে বিপিসির। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কেনা দামে শুল্ক নির্ধারণ করতে চায়। এটি হলে জ্বালানি তেলে বিপিসির খরচ বেড়ে যাবে। যদিও এ নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি সরকার। তাই ট্যারিফ মূল্য ধরেই দাম নির্ধারণের সূত্র তৈরি করেছে বিপিসি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, কর থেকে সরকার রাজস্ব বাড়াতে পারছে না। তাই যেখান থেকে রাজস্ব পায়, সেখান থেকে আর সরতে চায় না। বিশ্ববাজারে উচ্চ দামের সময় দেশে দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর বিশ্ববাজারে কমার পর বিপিসি চুপচাপ মুনাফা করছে। এ ছাড়া বিপিসির আয়-ব্যয়েও স্বচ্ছতা নেই। তিনি দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মাধ্যমে গণশুনানির পরামর্শ দিয়েছেন।

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *