Home বানিজ্য মুদ্রা ও রাজস্বনীতির সমন্বয়ে কাজ করার পরামর্শ
জানুuari ১৩, ২০২৪

মুদ্রা ও রাজস্বনীতির সমন্বয়ে কাজ করার পরামর্শ

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) যে ৫টি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছে, তা অত্যন্ত যৌক্তিক-এমন মন্তব্য করেছেন দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, এর আগে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) একই কথা বলেছিল। তবে এর বাইরেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আগামীতে এটি আরও ঘনীভূত হবে। কারণ বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। ক্রমেই এটি বাড়ছে। এই অবস্থায় ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর (এলডিসি উত্তরণ) হবে বাংলাদেশ। এতে কমবে স্বল্প সুদে ঋণ ও বাণিজ্য সুবিধা। যা বাংলাদেশের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। অর্থাৎ এলসিডি উত্তরণের নামে দেশ ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) মহাপরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তাফা কে মুজেরী। তাদের আরও অভিমত-দুর্নীতি রোধ ও স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ স্বচ্ছতা ছাড়া কোনো কর্মসূচিই সফল হয় না। এছাড়াও মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনা নীতি সমন্বয় করে কাজ করা জরুরি।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে পাঁচ ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-জ্বালানি স্বল্পতা, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সম্পদ ও আয়বৈষম্য এবং সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়া ও বেকারত্ব। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক সম্মেলনের আগে বুধবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম যেসব চ্যালেঞ্জের কথা বলেছে, সেগুলো এতদিন আমি বলে আসছি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এগুলো মৌলিক চ্যালেঞ্জ। তবে এর সমাধান কঠিন। কারণ একটির সঙ্গে অন্যটি জড়িত। উদাহরণস্বরূপ মুদ্রার বিনিময় হার কমালে অন্যটির ওপর প্রভাব পড়ে। আমদানি শুল্ক কমালে রাজস্ব আয় কমবে। তবে যে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে করতে হবে, তা হলো সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় বাড়ানো। কিন্তু সমস্যা হলো বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা যাদের পাওয়ার কথা, তারা পায় না। আবার যাদের পাওয়া উচিত নয়, তাদেরকেই দেওয়া হয়। এছাড়া এখান থেকে তছরুফ বা অর্থ আত্মসাৎ তো রয়েছেই। ফলে দুর্নীতি রোধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারলে কোনো কর্মসূচিই সফল হয় না। পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও উন্নতি করতে হবে। তবে এসব বিষয়ে সরকার কী সিদ্ধান্ত নেবে, তা দেখার বিষয়।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম যে ৫টি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছে, তা অত্যন্ত যৌক্তিক। এতদিন আমরাও এসব কথা বলে আসছি। এর বাইরে আমি আরও দুটি চ্যালেঞ্জ যোগ করতে চাই। যা হলো আমাদের রাজস্ব আয়ের স্বল্পতা এবং তৈরি পোশাক নির্ভর এক পণ্যকেন্দ্রিক রপ্তানি। এখান থেকে উত্তরণে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এখান থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা কম। সামনে এই চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে। সামনে আমরা এলডিসি উত্তরণে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে আমি বলব, এলডিসি উত্তরণের নামে আমরা একটি ফাঁদে পড়তে যাচ্ছি। এই সিদ্ধান্তের আগে আমাদের সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেশ যেভাবে চলছে, সেভাবে চললে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যাবে না। ফোকাস অন্যদিকেও বাড়াতে হবে। না হলে শাসক শাসন করতে পারবে। কিন্তু দেশের ১২টা বেজে যাবে। ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এলডিসি উত্তরণের ফলে আমাদের স্বল্প সুদে ঋণের সুযোগ থাকবে না। দ্বিতীয়ত, আমাদের বাণিজ্য সুবিধা কমবে। তৃতীয়ত, কমে আসবে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। এটি আমাদের জন্য আরও চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এলডিসি উত্তরণ মানে হলো আমাদের গরিবের কাতার থেকে মধ্যম আয়ে চলে যাবে। যা আমাদের জন্য সমস্যা তৈরি করবে। কারণ, মধ্যবিত্তদের কেউ সাহায্যও দেয় না। আবার সমর্থনও থাকে না। আমরা ওইদিকেই যাচ্ছি। অর্থাৎ ফাঁদে পড়তে যাচ্ছি। এতে প্রবৃদ্ধি বাড়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে রাজস্ব আয় একেবারেই কম। এটি আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়, তার মধ্যে ৮০ শতাংশই গার্মেন্ট বা তৈরি পোশাক। এই এক পণ্যকেন্দ্রিক রপ্তানি দিয়ে বেশি দূর আগানো যায় না। আগামীতে এটি ব্যালেন্স অব পেমেন্ট (আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য) ঠিক রাখা কঠিন হবে। এখান থেকে উত্তরণের উপায় কী এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য যেসব চ্যালেঞ্জের কথা বলা হচ্ছে, তা স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্পমেয়াদি চ্যালেঞ্জের মধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ অন্যতম। সরকার চাইলে এটি ৬ মাস থেকে এক বছরের মধ্যে মোকাবিলা করা সম্ভব। এ সময়ের মধ্যেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু অন্যান্য চ্যালেঞ্জগুলো মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি। যেমন বেকারত্ব নিরসন। এজন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। আর কর্মসংস্থানের জন্য দরকার বিনিয়োগ। কিন্তু বিনিয়োগ বাড়াতে হলে এর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কারণ পরিবেশ তৈরি না হলে নতুন বিনিয়োগ আসবে না।

বিআইডিএসের (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজ) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তাফা কে মুজেরী বলেন, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বাংলাদেশের অর্থনীতির মৌলিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছে। এর আগে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফও একই আশঙ্কার কথা বলেছে। তিনি বলেন, যেসব সমস্যার কথা বলা হয়েছে, এর কোনোটাই বিছিন্ন নয়। একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িত। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, চিহ্নিত সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে না পারলে সমস্যা আরও ঘনীভূত হবে। তিনি বলেন, আমাদের উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। এটি সবাই স্বীকার করে। এছাড়াও বৈদেশিক খাতে সমস্যা, ব্যাংকিং খাতের খারাপ অবস্থা এবং বিনিয়োগ স্বল্পতা রয়েছে। এগুলো মোকাবিলায় এখনই উদ্যোগ না নিলে বেকারত্ব কমবে না। আর্থিক খাতে সমস্যা আরও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, এসব সমস্যা সমাধানে- মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনা নীতি সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি দুর্নীতি রোধ এবং অর্থ পাচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ দরকার। না হলে সমস্যা আরও বাড়বে।

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *