স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ ৭ কোটি থেকে বেড়ে ৭০ কোটি
গত ১৫ বছরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মানিকগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ মালেকের অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১০ গুণের বেশি। এছাড়া আয় বেড়েছে সাড়ে ১১ গুণ। আর বর্তমানে তাঁর কোনো ইলেকট্রনিকসসামগ্রী নেই। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা বিশ্লেষণে এই তথ্য জানা গেছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ সদস নির্বাচনের হলফনামা এবং ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে জাহিদ মালেকের অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১০ দশমিক ৩৭ গুণ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় জাহিদ মালেক উল্লেখ করেছেন তাঁর কাছে নগদ রয়েছে ৬৪ লাখ ১১ হাজার ৮৩৫ টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে ৬৭ হাজার ৯৯৬.৬২ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ৭৫ লাখ ১৩ হাজার ৩৪৭ টাকা।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রয়েছে ১৫ কোটি ৫৭ লাখ ৯৯ হাজার ৪৬৮ টাকা, বন্ড ও ঋণপত্র, স্টোক একচেঞ্জে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির শেয়ার বাকি ব্যবসার মূলধনসহ, ব্যক্তি ব্যবসার মূলধনসহ ৪৯ কোটি ৪৭ লাখ ৭২ হাজার ৫৬ টাকা, যানবাহন বাবদ ২ কোটি ২৪ লাখ ৮৬ হাজার ৪৭৭ টাকা, আসবাবপত্র ৭০ হাজার এবং অন্যান্য ১ কোটি ৬৩ লাখ ১৩ হাজার ৪৭৮ টাকাসহ তাঁর অস্থাবর সম্পদের মোট আর্থিক মূল্য ৭০ কোটি ৩৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬১ টাকা। যা ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামার তথ্য অনুযায়ী ছিল ৬ কোটি ৭৮ লাখ ৫৩ হাজার ৫৭ টাকা। এই হিসাবে গত ১৫ বছরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য বেড়েছে ৬৩ কোটি ৫৫ লাখ ১৩ হাজার ৬০৪ টাকা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট বা দোকান বা অন্যান্য ভাড়া, ব্যবসা, প্লট, এগ্রো ফার্ম, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক আমানত, ডিভিডেন্ড এবং অন্যান্য (সংসদ সদস্যের সম্মানী ভাতা) বাবদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাৎসরিক আয় বর্তমানে ৮ কোটি ২৯ লাখ ৯৭ হাজার ২৫ টাকা। যা ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় ছিল ৭১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯১ টাকা। এই হিসেবে গত ১৫ বছরে তাঁর বাৎসরিক আয় বেড়েছে ৭ কোটি ৫৮ লাখ ৬২ হাজার ৩৩৪ টাকা। অর্থাৎ সংসদ সদস্য থেকে প্রতিমন্ত্রী, এরপর মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে গত ১৫ বছরে তাঁর বাৎসরিক আয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৬৩ গুণ।
হলফনামায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাঁর কোনো ইলেকট্রনিক সামগ্রী নেই বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য অনুযায়ী তাঁর ১ লাখ টাকা মূল্যের ইলেকট্রনিকস সামগ্রী ছিল। তবে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য অনুযায়ী তাঁর কোনো ইরৈকট্রনিক সমাগ্রী ছিল না।
হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, জাহিদ মালেকের স্থাবর সম্পদ অপরিবর্তনীয় রয়েছে। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্যানুযায়ী জাহিদ মালেকের নামে অকৃষি জমির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৫ কাঠা এবং তাঁর স্ত্রী সাবানা মালেকের নামে ২ দশমিক ৫ কাঠা জমির একটি প্লট ছিল। এছাড়া ৫৩ দশমিক ৪ শতক জমিতে ১১ তলা আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবন এবং বাড়ি ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। যার আর্থিক মূল্য ছিল ৩ কোটি ৬১ লাখ ৬ হাজার ২২ টাকা। এছাড়া যৌথ মালিকানায় ৪০ বিঘা কৃষিজমি ছিল। এখন এই স্থাবর সম্পদের পরিমাণ অপরিবর্তনীয় রয়েছে। তবে স্ত্রীর নামে ২ দশমিক ৫ কাঠার ওই জমি এবার নির্ভরশীলদের নামে স্থানান্তর করা হয়েছে। যৌথ মালিকানার ৪০ বিঘা কৃষিজমি এবার নির্ভরশীলদের নামে রয়েছে বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এবার হলফনামায় পেশা হিসেবে জাহিদ মালেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন। আর ২০০৮ সালে হলফনামায় পেশা হিসেবে ‘ব্যবসা’ এবং সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ও বাংলাদেশ থাই এ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড এই দুটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান উল্লেখ করেছিলেন। স্নাতকোত্তর পাস করা জাহিদ মালেকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই।
হলফনামার তথ্য অনুযায়ী স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঋণ বেড়েছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড এবং সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ও কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের কাছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ১ কোটি ৭৩ লাখ ৭৭ হাজার ৭৯ টাকা ঋণ রয়েছে। যা ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্যানুযায়ী ঋণের পরিমাণ ছিল ২৩ লাখ ৫৩ হাজার ২৮০ টাকা। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ১ কোটি ৫০ লাখ ২৩ হাজার ৭৯৯ টাকার ঋণ বা দায় রয়েছে।
গত পনের বছরে অনেক মন্ত্রী বা এমপির স্ত্রীদের সম্পদ যেখানে বেড়েছে, সেখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্ত্রী শাবানা মালেকের সামান্য অস্থাবর সম্পদ কমেছে। ২০০৮ সালে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্ত্রীর ৩৯ লাখ ৮৬ হাজার ৩০০ টাকার বন্ড বা ঋণপত্র ছিল। এবারের হলফনামায় তা উল্লেখ নেই। তবে ১৫ বছরে সাবানা মালেকের ৫ ভরি স্বর্ণ বেড়েছে। অর্থাৎ বর্তমান বাজার দরে ৫ ভরি স্বর্ণের দাম প্রায় ৫ লাখ টাকা। সেই হিসেবে গত ১৫ বছরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্ত্রীর প্রায় ৩৪ লাখ ৮৬ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ কমেছে। কিন্তু ২০০৮ সালে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ওপর নির্ভরশীলদের ২৫ ভরি স্বর্ণ থাকলেও এবারের হলফনামা তা উল্লেখ নেই। অর্থাৎ নির্ভলশীলদের ওই পরিমাণ স্বর্ণ কমেছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মানিকগঞ্জ জেলার সহসভাপতি ইকবাল হোসেন কচি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীরা যে হলফনামা জমা দিয়েছেন, তার সঙ্গে বাস্তবের তথ্যের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মনে হয় হলফনামার তথ্য সত্য নয়। এসব বিষয়ে রিটার্নিং অফিসারকে নির্বিকার দেখা যাচ্ছে। কেন প্রার্থীদের তারা এ বিষয়ে প্রশ্ন করছে না এটাও বোধগম্য নয়।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জাহিদ মালেকসহ নয়জন প্রার্থী জেলা প্রশাসক ও জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা রেহেনা আকতারের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেন। যাচাই-বাছাই শেষে দুজন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেন জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা। এই আসনে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সাতজন নির্বাচনে অংশ নেবেন।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন, মানিকগঞ্জ পৌরসভা ও সাটুরিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত মানিকগঞ্জ-৩ সংসদীয় আসন। ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ সাল এবং এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে টানা চার বার আওয়ামী লীগ থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন জাহিদ মালেক। তবে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রথম বার বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা তৃতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান জাহিদ মালেক।
সূত্র : ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি