Home বিশ্ব গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধ যেভাবে বদলে দিতে পারে বিশ্বব্যবস্থা
নভেম্বর ১২, ২০২৩

গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধ যেভাবে বদলে দিতে পারে বিশ্বব্যবস্থা

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের ভূরাজনৈতিক পটভূমি কতটা বদলে গেছে এবং পরাশক্তিগুলোর পারস্পরিক রশি–টানাটানি কতটা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নিয়ামক হয়ে উঠেছে, তা চলমান সংকট, সংঘাত ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এই প্রেক্ষাপটে গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক বিভেদকে বাড়িয়ে তুলছে। এটি ভূরাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসকে আরও গভীর করবে এবং নতুন একটি বিশ্বব্যবস্থার দিকে আমাদের ধাবিত করবে।

এই দুটি যুদ্ধ তৃতীয় আরেকটি যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেটি হলো তাইওয়ান যুদ্ধ।

যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন ও ইসরায়েলকে বিপুল পরিমাণে যে আমেরিকান আর্টিলারি যুদ্ধাস্ত্র, অত্যাধুনিক বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে যাচ্ছে, সেটিকে আমেরিকান অস্ত্রের মজুত-ক্ষয় হিসেবে মনে করছেন না এমন কেউ নেই। অন্তত চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এটি মনে করছেনই।

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা: অপরাধের শত বছর, অন্যায়ের ৮০, পাপের ৬৯

প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং (যিনি গণপ্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থায় তাইওয়ানের অন্তর্ভুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক মিশন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন) মনে করেন, যেহেতু ইউক্রেন ও গাজার যুদ্ধে আমেরিকা অস্ত্র সরবরাহ করছে এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের মজুত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে, সেহেতু এই দুটি যুদ্ধ যত বেশি প্রলম্বিত হবে, সেটি চীনের জন্য তত মঙ্গলজনক হবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই বিষয় বুঝতে পারছেন। হয়তো সে কারণে তিনি চীনের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমন করার চেষ্টা করছেন। খুবই লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, সান ফ্রান্সিসকোতে ১৫ থেকে ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় এশিয়া প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরামের সম্মেলনের আগে যুক্তরাষ্ট্র বেইজিংয়ে কেবিনেটের এক দল গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছে।

পশ্চিমারা যে কারণে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে একজোট

ধারণা করা হচ্ছে, আসন্ন ওই সম্মেলনে বাইডেন ও সি চিন পিং যে সাইডলাইন বৈঠক করবেন, সেটির ওপর বিশ্বের বিশেষ দৃষ্টি থাকবে। বাইডেন ও তাঁর জি-৭ ভুক্ত অংশীদার নেতারা ইতিমধ্যে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, তাঁরা চীনের সঙ্গে তাঁদের বিদ্যমান সম্পর্ককে ‘ঝুঁকিতে’ ফেলতে চান না এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই অর্থনীতির সঙ্গে তাঁদের ‘ছাড়াছাড়ি’ হয়ে যাক, এটিও চান না।

যে যা-ই বলুক, এতে কোনো সন্দেহ নেই, বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা এবং বিনিয়োগ ও বাণিজ্য অংশীদারিকে নতুন একটি আদল দেওয়ার কথা মাথায় রেখেই এসব প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগপ্রবাহ এমনভাবে গতিপথ পরিবর্তন করছে, যা দেখে মনে হচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নেতৃত্বাধীন দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে যেতে পারে।

চার দশক ধরে চীনের অর্থনৈতিক উত্থানকে সক্রিয়ভাবে সহজতর করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত করেছে। আজ চীন তার নিজের গড়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় নৌবাহিনী ও উপকূল রক্ষী বাহিনী নিয়ে গৌরব করছে এবং বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পশ্চিমা আধিপত্যকে স্পষ্টভাবে চ্যালেঞ্জ করছে।

আদতে চীন নিজেকে কেন্দ্রে রেখে একটি বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কঠোরভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ভারত-ইসরায়েল এত মাখামাখি কেন?

বর্তমানে নিরপেক্ষতার দ্যোতনাসঞ্জাত যে ‘আইনভিত্তিক বৈশ্বিক ব্যবস্থা’র কথা বলা হচ্ছে, নিঃসন্দেহে সেটির কেন্দ্রে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই বিশ্বব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে যেসব আইনকানুন দাঁড় করানো হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি। শুধু তা-ই নয়, এসব আইনকানুন মানা না মানার বিষয়েও দেশটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়ে থাকে।

আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার অন্যতম নিয়ম হলো, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে এই নিয়ম থেকে মুক্ত বলে মনে করে থাকে। বাস্তবতা হলো, আন্তর্জাতিক আইন ক্ষমতাহীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী, কিন্তু ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে শক্তিহীন।

বর্তমানে সংঘাতক্লিষ্ট যে বৈশ্বিক পরিবেশ বিদ্যমান রয়েছে, তা চীনের জন্য একটি বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করার বিষয়ে রসদ জোগাতে পারে। এর আগে মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক ব্যবস্থার উত্থান ঘটেছিল। একই সঙ্গে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও অন্য অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সূচনা ঘটেছিল। পরবর্তী সময়ে এসব প্রতিষ্ঠানে সংস্কার এনে সেগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র কবজা থেকে মুক্ত করা যায়নি। এমনকি শান্তির সময়েও সেই সংস্কার সম্ভব হয়নি।

হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধে বিপদে চীন ও ভারত

জাতিসংঘের জন্য এটি নিশ্চিত সত্য যে প্রতিষ্ঠানটির গ্রহণযোগ্যতা অপরিবর্তনীয়ভাবে পতনের মুখে রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতে এ সংস্থা ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।

গাজায় যুদ্ধ ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ না আসায় সাধারণ পরিষদের ওপর দায়িত্বের বোঝা বেড়েছে। সে কারণে গাজায় ‘মানবিক অস্ত্রবিরতি’র ও ইসরায়েলের গাজা ঘেরাও বন্ধের আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব আনতে সাধারণ পরিষদের ওপর চাপ ছিল। চাপের মুখে সাধারণ পরিষদ সে প্রস্তাব তুলেওছিল। কিন্তু আইনগত কাঠামো অনুযায়ী, সাধারণ পরিষদ নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ে অনেক দুর্বল। তাই এই প্রস্তাব মানার বিষয়ে আইনি কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর যেমন অবনমন ঘটছে, তেমনি নিজ সীমানার বাইরে আমেরিকার কর্তৃত্বও ফিকে হতে শুরু করেছে। সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল থাকা ইসরায়েল ও ইউক্রেন পর্যন্ত মাঝেমধ্যে তাদের পৃষ্ঠপোষক আমেরিকার পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে।

হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ যেভাবে বৈশ্বিক পরিস্থিতি পাল্টে দিচ্ছে

 সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে গাজায় সামরিক আক্রমণ প্রত্যাহার করতে ও ইতিমধ্যে সেখানে সৃষ্ট ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতিতে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা কমাতে সচেষ্ট থাকার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সে কথায় কর্ণপাত করেনি।

চীন-আমেরিকা দ্বন্দ্বের কারণে বিশ্বব্যবস্থায় যেমন দৃশ্যমান অদলবদল পরিলক্ষিত হচ্ছে, তেমনি আঞ্চলিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রেও তা ভূমিকা রাখছে। সেই নিরিখে বলা যায়, গাজার এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে তা বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক পুনর্গঠনেও গতি আনতে পারে। সেখানে মিসর, ইরান ও তুরস্ক বাদে প্রায় প্রতিটি দেশে বিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমাদের (বিশেষ করে ব্রিটিশ এবং ফরাসি) দ্বারা নির্মিত ব্যবস্থা চালু আছে।

ইতিমধ্যে ইসরায়েলের যুদ্ধ গ্যাসসমৃদ্ধ কাতারের ভূরাজনৈতিক ভূমিকাকে শক্তিশালী করেছে। এই যুদ্ধের ফলে মধ্যপ্রাচ্য এমন একটি অঞ্চল হয়ে উঠছে, যেখানে হামাসসহ সহিংস সংগঠনগুলোকে অর্থায়নের মাধ্যমে হস্তীসদৃশ একটি বৃহৎ আন্তর্জাতিক দুর্বৃত্ত চক্র গড়ে তোলা হয়েছে।

এই সংঘাত যদি গাজার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তার ভূরাজনৈতিক প্রভাব আরও সুদূরপ্রসারী হবে। এর ফলাফল যা-ই হোক, তাতে ইউক্রেনের যে বড় ক্ষতি হবে, তাতে সন্দেহ নেই।

কোনো ইহুদিরাষ্ট্র ৮০ বছর টেকে না—যে ভয়ে ভীত ইসরায়েল

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি স্বীকার করেছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর দেশের চলমান যুদ্ধ থেকে সবার দৃষ্টি এমন এক সময়ে গাজা যুদ্ধের দিকে চলে গেছে, যখন পশ্চিমের সহায়তা কমে যাওয়ায় ইউক্রেনের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

যদিও বিশ্ব পরিস্থিতির গতিধারা বিশদ আকারে এখনই জানা অসম্ভব, তবে একটি মৌলিক বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক পুনঃভারসাম্য যে অবশ্যম্ভাবী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ছাড়া পশ্চিম এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে (বিশেষ করে চীন, রাশিয়া ও ইসলামি বিশ্বের সঙ্গে) যে একটি দীর্ঘমেয়াদি সংঘর্ষের আভাস প্রকট হয়ে উঠছে, সেটি বলাই যায়।

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *