Home দুর্ণীতি চট্টগ্রামে আসামির খাবারের টাকা যাচ্ছে পুলিশের পকেটে
Oktober ১৫, ২০২৩

চট্টগ্রামে আসামির খাবারের টাকা যাচ্ছে পুলিশের পকেটে

‘ভাই কিছুই খাইনি। অনেক ক্ষুধা লেগেছে। পারলে কিছু খাবার এনে দেন’। কথাগুলো চট্টগ্রাম নগরের খুলশী থানার মারধরের একটি মামলার গ্রেপ্তার আসামি সৈয়দ আলাউদ্দিনের। গত ১০ সেপ্টেম্বর বেলা ৩টা ৩৮ মিনিটে চট্টগ্রাম আদালতের মহানগর হাজতখানার ভেতর থেকে পুলিশ কনস্টেবল আবদুল কাইয়ুমকে এ কথা বলেন তিনি। সেদিন বিকেল পাঁচটার দিকে অভুক্ত অবস্থায় আলাউদ্দিনকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যায় পুলিশ।

শুধু সৈয়দ আলাউদ্দিন নন, গ্রেপ্তারের পর আদালতে আসা আসামিরা তাঁদের জন্য সরকারি বরাদ্দ থাকা দুপুরের খাবার পান না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরেজমিন ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত অন্তত ৫২ জন আসামি এবং তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা খাবার না পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেন।

হাজতখানায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরাও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিষয়টি স্বীকার করেছেন। অথচ আসামিদের নামে প্রতি মাসে সরকারি কোষাগার থেকে বিল তুলে নেওয়া হচ্ছে। গত আড়াই বছরে (২০২১ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত) আসামিদের দুপুরের খাবার (খোরাকি) বাবদ সরকারি কোষাগার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে ১৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা।

সরকারিভাবে বরাদ্দ আছে জানি। প্রতিদিন থানা থেকে অনেক আসামি আসেন। তাঁদের সঙ্গে কথাও হয়। কিন্তু কাউকে খাবার দেওয়া হয় না।

মো. আবদুর রশিদ, সরকারি কৌঁসুলি, চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত

হাজতখানায় থাকা আসামিদের সরকারি বরাদ্দের টাকায় দুপুরে খাবার দিতে কোনো দিন দেখেননি বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উল্টো আসামিদের সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাৎ করতে এবং খাবার পাঠাতে পুলিশকে টাকা দিতে হয়।

মহানগর হাজতখানায় আসামিদের দুপুরে খাবার দেওয়া হয় কি না, জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি মো. আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারিভাবে বরাদ্দ আছে জানি। প্রতিদিন থানা থেকে অনেক আসামি আসেন। তাঁদের সঙ্গে কথাও হয়। কিন্তু কাউকে খাবার দেওয়া হয় না।’

২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি, চট্টগ্রামে দুদক কর্মকর্তা কারাগারে

সরেজমিনে আসামিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের স্বজনেরা হাজতখানায় এসে পুলিশ সদস্যদের টাকা দিয়ে খাবার পাঠাতে পারেন। সাক্ষাতের জন্য ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, নাশতার জন্য ১০০ টাকা এবং দুপুরের খাবারের জন্য দিতে হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। আর যাঁদের স্বজনেরা আসেন না, তাঁদের অভুক্ত অবস্থায় কারাগারে যেতে হয়।

অভুক্ত অবস্থায় কারাগারে যাওয়া সৈয়দ আলাউদ্দিন ১০ সেপ্টেম্বর পুলিশের উপস্থিতিতে আদালতের বারান্দায় প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ ধরার সময় পকেটে ২০০ টাকা ছিল। এগুলো নিয়ে পুলিশ চা, সিগারেট খেয়েছে। গ্রেপ্তারের পর রাতে থানা-পুলিশ খাবার দিয়েছিল। সকালে আদালতের হাজতখানায় আসার পর থেকে মুখে একটি দানাও পড়েনি। স্ত্রী অসুস্থ থাকায় দেখতে আসতে পারেননি। বাইরে থেকে কোনো খাবার এনে দিতে পারেন কি না, সে জন্য পুলিশ কনস্টেবল আবদুল কাইয়ুমকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু টাকা দিতে না পারায় আর খাবার পাননি।

বিলে অসংগতি

আসামিদের খাবারের বিল প্রস্তুত করে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপকমিশনার (সদর) আবদুল ওয়ারীশের কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, থানা ও আদালতের হাজতখানার আসামিদের জন্য দৈনিক বরাদ্দ বর্তমানে ১৫০ টাকা। একবেলার জন্য বরাদ্দ ৭৫ টাকা। বিল পেলে থানা ও আদালতের হাজতখানায় সঙ্গে সঙ্গে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একজন আসামির এক বেলা খাবারের জন্য ৩৭ টাকা ৫০ পয়সা বিল করার কথা শুনে তিনি অবাক হন। তিনি বলেন, ১৫০ টাকার অর্ধেক ৭৫ টাকা। ৩৭ টাকা ৫০ পয়সা কেন? বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক পরিদর্শক আতিকুর রহমান (৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন) চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের হাজতখানার বিলগুলো তৈরির দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে সরকারি বরাদ্দ ১৫০ টাকার অর্ধেক একবেলা খাবার বাবদ একজন আসামির জন্য ৭৫ টাকা বিল হওয়ার কথা। কিন্তু ৩৭ টাকা ৫০ পয়সা কেন বিল করা হচ্ছে? এ বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে যেভাবে হয়েছিল, সেভাবে করা হয়েছে। ৩৭ টাকা ৫০ পয়সায় একজনকে কী খাবার দেওয়া হতো? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কিছুই দেওয়া হতো না। বিলের টাকাগুলো কার পকেটে যেত? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সঠিক তদন্তে জানা যাবে বিলগুলো কী হতো।

চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার সম্পদের অনুসন্ধানে দুদক

২০২১ সালের আগস্ট থেকে চলতি মাসের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম আদালতের নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন কামরুল হাসান। আসামিদের খাবার দেওয়া হয় কি না জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামিদের খাবার, বিলের বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’ এদিকে তাঁর সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চাকরিজীবনের শুরু থেকে গত জুলাই মাস পর্যন্ত বেতন-ভাতা থেকে কামরুল হাসান কত টাকা পেয়েছেন, তার হিসাব চেয়ে নগর পুলিশ কমিশনারের কাছে চিঠি দিয়েছে দুদক। দুদক চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. এমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, হাজতখানায় আসামিদের খাবারের বিল তুলে নিয়ে তা কীভাবে আত্মসাৎ করা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।

টাকা দিলে সবই মেলে

সরকারি বরাদ্দের খাবার আসামিদের না দিয়ে উল্টো পুলিশ সদস্যরা আসামিদের স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে খাবার ও নাশতা সরবরাহ করেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা। ১০ সেপ্টেম্বর মাদকের মামলায় মো. নুরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায় নগরের কর্ণফুলী থানা পুলিশ। তাঁকে রাখা হয় আদালতে মহানগর হাজতখানায়।

খবর পেয়ে স্বামীকে দেখতে আসেন স্ত্রী পপি আক্তার। হাজতখানার সামনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১০০ টাকা পুলিশকে দিয়ে স্বামীর দুপুরে খাওয়ার জন্য একটি পাউরুটি ও কয়েকটি কলা পাঠিয়েছেন। আর টাকা না থাকায় খাবার দিতে পারেননি। খাবার দিলে পুলিশ প্রথমে ৫০০ টাকা চেয়েছিল। পরে বলে, ৪০০ দিলেই হবে। কিন্তু এত টাকা তাঁর কাছে নেই।

রহমত উল্লাহ, মো. হাসান ও আকর আলী নামের তিন ভাইকে আনা হয় হাজতখানায়। বাইরে অপেক্ষায় থাকা তাঁর বোন সালমা আক্তার জানান, ভাইদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দিতে হয়েছে ১৫০ টাকা। সকালে নাশতার জন্য দিয়েছেন ১০০ টাকা। দুপুরের খাবারের জন্য দেন ৫০০ টাকা।

আসামিদের খাবারের নামে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তোলা টাকা আত্মসাৎকারী পুলিশ সদস্যদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত বলে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষুধার জ্বালা কী, সেটা কেবল ক্ষুধার্ত মানুষই বোঝে।

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *