বিনা রসিদ ও ভুয়া প্রকল্পে কোটি টাকা আত্মসাৎ
প্রশংসাপত্র বিতরণ, ভর্তি বাতিল, নির্বাচনি পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের জরিমানাসহ এ রকম কয়েকটি খাতে বিনা রসিদে টাকা আদায় এবং অসংখ্য ভুয়া প্রকল্প বানিয়ে কলেজ ফান্ডের কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে রামু সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মুজিবুল আলমের বিরুদ্ধে। শুধু আর্থিক অনিয়ম নয়, কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের নাম ধরে ডাকা, অধ্যক্ষের সামনে দাঁড়িয়েই কথা বলা, শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। এছাড়া কলেজটি সরকারিকরণের পাঁচ বছর হলেও এখনো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেসরকারি নিয়মে বেতন ও অন্যান্য ফি আদায় করা হচ্ছে। যে কারণে চরম অসন্তোষ রয়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে। অথচ একই সঙ্গে সরকারি হওয়া টেকনাফ, চকরিয়াসহ বিভিন্ন কলেজে সরকারি নিয়মে বেতন ও ফি নেওয়া হচ্ছে।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট রামু কলেজ সরকারি হয়। এরপর ২০২২ সালের ৮ আগস্ট মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তর থেকে সংযুক্তিতে কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পান মুজিবুল আলম। যোগদানের পর কলেজের এইচএসসি, ডিগ্রি ও অনার্স পর্যায়ে অন্তত এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পাশ করেছেন। এদের কাছ থেকে বিনা রসিদে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আদায় করা হয়েছে। একইভাবে এইচএসসির নির্বাচনি পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিনা রসিদে মোটা অঙ্কের জরিমানার টাকা নিয়ে কলেজ ফান্ডে জমা না করে অধ্যক্ষ আত্মসাৎ করেন।
বিনা রসিদে টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে কলেজের প্রধান অফিস সহকারী কাম হিসাবরক্ষক আলাউদ্দিন বলেন, এক সময় আমরা রসিদমূলে টাকা নিয়ে ব্যাংকে জমা দিতাম। কিন্তু নতুন অধ্যক্ষ যোগদানের পর বিষয়গুলো কয়েকজন কর্মচারীর মাধ্যমে তিনি নিজেই তদারকি করেন।
প্রকল্পের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বর্তমান অধ্যক্ষ তার পছন্দের কয়েকজন শিক্ষকের নামে কাগজে-কলমে ৬০ থেকে ৭০টি প্রকল্প দেখিয়েছেন। এমনকি দুই শিক্ষকের নামে দেখানো হয়েছে ১৫টি করে প্রকল্প। যেখানে বড় অসংগতির প্রমাণ মিলেছে। এ রকম অর্ধশতাধিক প্রকল্পের নথি এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। একটি নথিতে দেখা যায়, চলতি বছরের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন করা হয়। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের ভাষ্য, এ অনুষ্ঠানে খরচ সর্বসাকুল্যে ৪০-৫০ হাজার টাকার বেশি নয়। কিন্তু ভুয়া বিল-ভাউচার বানিয়ে খরচ দেখানো হয়েছে দুই লাখ ৯৮ হাজার টাকা। একইভাবে ’২৩ সালে কলেজের বার্ষিক সাহিত্য, সাংস্কৃতিক, আন্তঃ ও বহিঃক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে খরচ দেখানো হয় ৬ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুপ্রতিম বড়ুয়াকে আহ্বায়ক করা হয়। তবে এ বিষয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অর্গানাইজারের দায়িত্বে থাকা রাজিব বড়ুয়া বলেন, ওইদিন আমি সাউন্ড সিস্টেম বাবদ ৫ হাজার টাকা দিয়েছি। অন্যান্য খরচের বিষয়ে আমি অবগত নই। শুধু এ দুটি নয়, শিক্ষকদের পার্কিং শেড রং করা, পার্কিং শেড-গ্রিল লাগানো এবং কলেজের বিভিন্ন কক্ষে রং করার পৃথক ৫ প্রকল্প, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পোশাক তৈরি, চারা রোপণসহ অন্তত ১৫ প্রকল্প দেখানো হয়েছে সুপ্রতিম বড়ুয়ার নামে। যা বেশির ভাগই ভুয়া।
তবে সুপ্রতিম বড়ুয়া বলেন, আমি প্রকল্পের আহ্বায়ক ঠিক, কিন্তু বেশিরভাগ প্রকল্পের কাজ করেছেন বাংলা বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ হোছাইন। আমি শুধু চেক ও ভাউচারে সই করেছি।
একইভাবে ২০২২ সালের অক্টোবরে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানের নামেও বড় ধরনের অসংগতির প্রমাণ মিলেছে। নথিতে দেখা গেছে, এ অনুষ্ঠানে কলেজ ফান্ড থেকে ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৫০ টাকা খরচ দেখানো হয়। একই অনুষ্ঠানের জন্য প্রায় ৫০০ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৩০০ টাকা করে চাঁদাও নেওয়া হয়। সব মিলে অনুষ্ঠানের ব্যয় দাঁড়ায় ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৫০ টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ অনুষ্ঠানের বাস্তব খরচ আড়াই থেকে দুই লাখ ৭০ হাজার টাকা। এ প্রকল্পের আহ্বায়ক ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইসরাত জাহান বলেন, আমার নামে চেক ইস্যু এবং চেকে স্বাক্ষর নেওয়ার পর একটি টাকাও আমি চোখে দেখিনি। অধ্যক্ষ নিজেই সব খরচ করেছেন। একইভাবে কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছলিম উল্লাহর নামে রয়েছে ১৫ প্রকল্প। এর মধ্যে শুধু ক্রোকারিজ কেনার প্রকল্প আছে চারটি যা টাকার অঙ্কে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এছাড়া পৃথক ৭টি প্রকল্পে ২৪টি বৈদ্যুতিক পাখা কেনার প্রকল্প, অধ্যক্ষের কক্ষে এসি লাগানো, ফ্রিজ, সোফাসেট, কার্পেট কেনাসহ বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। যা টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় ৯ লাখের বেশি। তবে ছলিম উল্লাহ জানান, ৭-৮টি ফ্যান ও ক্রোকারিজ সামগ্রী তিনি নিজে কিনেছেন। এসি, ফ্রিজসহ বড় অঙ্কের কেনাকাটা অধ্যক্ষ নিজেই করে আমার থেকে ভাউচারে সই নিয়েছেন। ভবিষ্যতে তার নামে প্রকল্প না দেওয়া এবং ক্রয় কমিটি থেকেও বাদ দিতে অধ্যক্ষকে অনুরোধ করেন বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিভিন্ন শিক্ষকের নামে প্রকল্প তৈরি করা হলেও অধ্যক্ষের নির্দেশক্রমে অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করেন তার ঘনিষ্ঠ বাংলা বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ হোসাইন। তিনি প্রকল্পের নামে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে অধ্যক্ষকে দুর্নীতির সুযোগ করে দেন। প্রকল্পের আহ্বায়কসহ সংশ্লিষ্টরা অধ্যক্ষ ও হোসাইনের তৈরি করা ভুয়া বিল-ভাউচারে স্বাক্ষর করেন মাত্র।
অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে মোহাম্মদ হোছাইন বলেন, অধ্যক্ষ আমাকে যা টাকা দিয়েছেন তা সেখানে খরচ করেছি। এসব বিষয় নিয়ে কলেজে গিয়ে অধ্যক্ষসহ সামনাসামনি কথা বলতে তিনি অনুরোধ করেন। অন্যজনের প্রকল্প নিজে করার বিষয়ে বলেন, আহ্বায়কের অনুমতি সাপেক্ষে আমি কাজ করেছি।
কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল হক বলেন, ২০১২ সালের ১৮ জুনে আমার দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় কলেজ ফান্ডে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা জমা ছিল।
বর্তমানে কলেজ ফান্ডে ৫০ লাখ টাকার কম স্থিতি আছে এ কথা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক জানান, মূলত কলেজ ফান্ডের মোটা অঙ্কের এ টাকা আত্মসাতের জন্য অধ্যক্ষ এসব ভুয়া প্রকল্প দেন।
কলেজের আইসিটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আকতার জাহান বলেন, এ কলেজের সুপ্রতিম স্যার, প্রণতি ম্যাডাম, সাহাব উদ্দিন স্যার, আবু তাহের স্যার কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক। কিন্তু তারাসহ সব সিনিয়র শিক্ষকদেরও নাম ধরে ডাকেন অধ্যক্ষ। তার কক্ষে টেবিলের সামনে চেয়ারগুলোও তিনি সরিয়ে ফেলেছেন যেন সবাইকে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়।
অধ্যক্ষ মুজিবুল আলম বলেন, আমার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মিথ্যা। আমি কোনো অনিয়ম করিনি। যারা বলছেন ভুয়া প্রকল্প বা বিনা রসিদে টাকা তুলে আমি আত্মসাৎ করেছি, তারাই এসব ভালো বলতে পারবেন। আমি ব্যাংকের বাইরে কোনো লেনদেন করিনি।
জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে নাম ধরে ডাকা ও দাঁড়িয়ে কথা বলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা মিথ্যা অভিযোগ। বরং আমি শিক্ষকদের অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি।