নির্বাচনী সমঝোতার কোনো লক্ষণ নেই!
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ইসির পক্ষ থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিলের দিনক্ষণ গণনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সংবিধান মতে নির্দিষ্ট সময়েই নির্বাচন হবে। অথচ রাজপথের বিরোধী জোটের সাথে সমাঝোতার কোনো লক্ষণ নেই। সরকার বিরোধীদলগুলো বলছে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। এমনকি নির্বাচন হতেও দেয়া হবে না হুঁশিয়ারি দেয়া হচ্ছে। সকল দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে বিদেশীরাও। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবার অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে ভিসানীতিও প্রয়োগ শুরু করেছে। নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করছে বা করবে এমন লোকদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে দেশটি ভিসানীতি কার্যকর শুরু করেছে। এমন অবস্থাতে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, দিন যত ঘনিয়ে আসছে, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। কী হবে সামনে? বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী? রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী? প্রধান দুই রাজনৈতিক জোট ছাড়ের প্রশ্নে অনড়। বিশেষ করে সরকারি দল যেনতেনভাবে নির্বাচন করে টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় থাকতে মরিয়া।
এমন পরিস্থিতির শেষ কোথায়? সমাধান কী হতে পারে? এ বিষয়ে সরকারপন্থি হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, বিগত দুটি নির্বাচন একতরফা হলেও আলোচনা, সংলাপের আয়োজন ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করেছিলেন। যদিও তাতে ফল হয়নি। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে সংলাপ হলো। ফলাফল ছিল শূন্য। অতীতকে সামনে এনে আমরা ভবিষ্যৎকে মূল্যায়ন করতে পারি না। বিদেশীরা সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে। এটা বলাটাও স্বাভাবিক। সরকারও তাই বলছে। তবে আমি মনে করি জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ কোন পথে যাবে।
সূত্র মতে, আপাতত সংঘাতের পথ পরিহার করে আন্দোলন করছে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য বিরোধীদলগুলো। তাদের স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না তারা। অপরদিকে সরকারিদল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করার কথা বারবার জানান দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এদিকে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব মহল যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে, তা আগে কখনই দেখা যায়নি। পূর্বঘোষিত ভিসা নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসপি সুবিধা বাতিলের আলোচনা করছে। রাজনীতিই সব সংকটের মূল।
রাজনীতিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, যে সংঘাত ও অরাজকতা রাজনীতিতে চলছে, তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। একটি দেশের রাজনীতি এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে দীর্ঘদিন চলতে পারে না। আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে গত দুই দশকে। এখানকার পেশাজীবীরা আর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। গণমাধ্যমের প্রতি গণমানুষের কোনো আস্থা নেই। গণমাধ্যম লেজুড়বৃত্তি করে বিশ্বাস হারিয়েছে আগেই। তৃতীয়ত, ছাত্র সংগঠনগুলোও এখন নিষ্ক্রিয় নতুবা গণআন্দোলনবিরোধী। একটি দেশের সংকটময় মূহূর্তে এই তিনটি শক্তি জোরালোভাবে কাজ করার কথা। আপনি ভালো করে খেয়াল করবেন, আজকের সংকটের পেছনে এই তিনটি শক্তিই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। এই বিশ্লেষক মনে করেন, এমন বিপদে বাংলাদেশ কখনই পড়েনি। সমাঝোতা করতে হবে সরকারকেই। কিন্তু সে লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। দেশ সংকটে পড়লে সবচেয়ে বিপদে পড়ে সাধারণ মানুষ। অতীতে এই সাধারণ মানুষই সংকট মোকাবিলায় অংশ নিয়েছে। সরকার, রাষ্ট্র মিলে সাধারণ মানুষের সে শক্তির জায়গাগুলো ভেঙে দিয়েছে। সর্বত্রই ভয় এখন। কেউ কথা বলতে পারছে না বা বলতে চাইছে না। সংকট উত্তরণে আলোচনার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, আমি মনে করি, যত বড় সংকটই আসুক না কেন? সমাঝোতা হতেই হবে। দেশটি কোনো এক বিশেষ দলের নয়। সরকারকে এটি বুঝতে হবে। সমঝোতার জন্য, আলোচনার জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এর আগেও বিভিন্ন সংকট মোকাবিলায় সরকারকেই আলোচনার উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। এবারও তাই করতে হবে বলে আশা করি।
সূত্র মতে, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন দুই জোটের আন্দোলন-প্রচারপ্রচারণা এখন তুঙ্গে। একজোট একটা কর্মসূচি দিলে অপর দলও আরেকটা দেয় এবং একই দিনে। মূলত: আগামী নির্বাচন নিয়ে দুই জোটে এখনো কড়া বিভাজন রয়েছে। আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী সরকারের অধীনেই যথারীতি নির্বাচন হবে। সরকার বিরোধীরা বলছে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখে তাদের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। সরকারকে পদত্যাগ করতেই হবে। দুদলই যার যার নীতিতে অটল রয়েছে। এ অবস্থায় পরিণতি কী হবে? দু’অবস্থানে দুদলই থাকল।
নির্বাচন বিশ্লেষক এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান সাবেক সচিব, বদিউর রহমান বলেছেন, হাল অবস্থা দেখে আমরা পরিষ্কার আঁচ করছি যে, আওয়ামী লীগ বোধকরি ২০১৪-স্টাইলে হলেও নির্বাচন সেরে নেবে। বিএনপি নির্বাচনে না এলেও এবার ভিন্নতর কৌশল অবলম্বন করবে আওয়ামী লীগ। অন্য কিছু দলকে নিয়ে আসবে। প্রয়োজনে নিজ ঘরানার দলকে আসন ভাগ ভাগ করে দিয়ে নির্বাচন সেরে নিতে পারবে। আওয়ামী লীগের প্রয়োজন যেভাবেই হোক আবার ক্ষমতায় আসা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মাঠের রাজনীতিতে সরব দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের ‘পালটাপালটি’ কর্মসূচি ঘিরে বেড়েছে রাজনীতির উত্তাপ। দলীয় প্রধানের মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে অপরাজনীতি ছাড়তে বিএনপিকেও ৩৬ দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এমন আলটিমেটামে রাজনীতির মাঠে সংঘাতের আশঙ্কা করছেন সবাই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পালটাপালটি আলটিমেটামের পরিণতি হবে ভয়াবহ। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ বের করা না যায়, তার মাশুল দিতে হবে পুরো জাতিকে।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বলেন, বর্তমান সরকার দেশের মঙ্গল চায় না। ধীরে ধীরে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ তারা সাধারণ মানুষের ওপর ১৫ বছর ধরে জুলুম করে আসছে। জনগণেরও সময় আসবে। তখন আওয়ামী লীগের কী অবস্থা দাঁড়াবে তা বুঝতে হবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকারের যে অহমিকা, একগুঁয়েমি অর্থাৎ যে ধারায় তারা ক্ষমতায় থাকতে চাচ্ছে। তা আসলে একটা সংঘাত-সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তুলছে। সরকারের আচরণের ওপর অনেক সময় বিরোধী দলের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হবে, না সহিংস হবে এটা নির্ভর করে। সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, আন্তর্জাতিকভাবে তাদের ওপর বহুমাত্রিক চাপ, এর মধ্যে থেকে তারা ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে নির্বাচনের পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এটা নিশ্চিত, তারা গোটা দেশকে বিপদে ফেলছে। জনগণকে বিপদে ফেলছে।
সূত্র মতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘আমরা অত্যন্ত আশ্বস্ত বোধ করছি। সরকারের পক্ষ থেকে ইদানীং বারবার বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনটাকে সুষ্ঠু করতে চায়। এ প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছে। এর আগে কিন্তু সরকার কখনো এ প্রতিশ্রুতি দেয়নি। প্রথমবারের মতো সরকার এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আইনমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, সেতুমন্ত্রী তারাও সরকার শব্দটা ব্যবহার করেছেন। প্রধানমন্ত্রীও স্পষ্টভাবে কয়েকবার বলেছেন, সরকার আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার নিশ্চয়তা দিচ্ছে। আমি বলব, আস্থা রাখতে চাই’। সিইসির এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, গত এক দশকে দেশে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়নি। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনেকটা একদলীয় রূপ নেয়। এ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের ১৫৪টিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের গুটিকয়েক সহযোগী দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার ফলে দেশের মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ৯৭৭ ভোটারের মধ্যে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান মাত্র ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। দশম সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন না ঘটায় দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। গণতন্ত্রকামী বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন করে নির্বাচন দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করে নির্বাচন-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি ও অন্যসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি তার সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনেও প্রধানমন্ত্রীর দেয়া কোনো প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কোনো চেষ্টা করেনি। নির্বাচন মোটেই অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি। এ নির্বাচনে নজিরবিহীন অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ছিল-নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্ধারিত দিনের আগের রাতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ব্যালট বাক্সে ভোট প্রদান। নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি এসব অনিয়ম রোধে ব্যবস্থা গ্রহণে শুধু বিরত থাকেনি, বরং বিরোধী দলগুলোর আনা অভিযোগগুলো তদন্ত না করেই তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের ফলাফল নিশ্চিত করে গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ‘দ্য ২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি।
সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বলেন, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার যেসব প্রতিশ্রুতি গত এক দশকে প্রধানমন্ত্রী তথা আওয়ামী লীগ সরকার দিয়েছে, সেগুলোর একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। অতীতে যা হয়নি, আগামীতে তা হবে এমন আশা করা বৃথা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, সরকরি দল যেভাবে আবারো একতরফা নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও দেশবাসী। ক্ষমতার দম্ভে আওয়ামী লীগ নেতারা যেভাবে চড়াও হচ্ছেন নানা পেশার মানুষের ওপর, বিরোধীদলীয় চাপ না থাকায় তাদের আরও দুর্দমনীয় হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।