শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গুলি, পথচারীর মৃত্যু আজিমপুর কবরস্থানের পাশে পরিত্যক্ত কক্ষে বসে হামলার পরিকল্পনা
ঢাকার রাস্তায় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ ওরফে মামুনের ওপর হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল আজিমপুর কবরস্থানের পাশের নামহীন আসবাবের দোকানের একটি পরিত্যক্ত কক্ষে। সেখানে নিয়মিত আড্ডা ও মাদক সেবন করতেন কারাবন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনের সহযোগীরা। ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের রাস্তায় মামুনের ওপর হামলা হয়। এ সময় সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে আহত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন পথচারী ভুবন চন্দ্র শীল (৫২)।
এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে পুরান ঢাকা থেকে গত সোমবার মারুফ বিল্লাহ ওরফে হিমেল নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানা গেছে বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, জিজ্ঞাসাবাদে মারুফ বলেছেন, ঢাকার হাজারীবাগ, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও অঞ্চলের অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন ইমন। ২৪ বছর পর কারাগার থেকে সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হয়ে এসব এলাকার অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন মামুন। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বর্তমানে কারাবন্দী ইমন।
শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও মামুন একসময় হাজারীবাগ, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার আতঙ্ক ছিলেন। তাঁদের গড়ে তোলা বাহিনীর নাম ছিল ‘ইমন-মামুন’ বাহিনী। তাঁরা দুজনই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যা মামলার আসামি।
পুলিশের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) আরিফ রাইয়ান গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মারুফ বিল্লাহ ঘটনা সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছেন। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মামুনকে গুলি করার সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন মারুফ বিল্লাহ। তবে হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার কথা তিনি স্বীকার করছেন না। তিনি বলেছেন, মামুনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে ইমনের সহযোগীরা মামুনের অবস্থান জানতে তাঁকে ‘টোপ’ হিসেবে ব্যবহার করেন।
মারুফ বিল্লাহ বলেছেন, ইমনের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক রয়েছে। তাঁদের সঙ্গে আড্ডাও দেন তিনি। তাঁদেরই একজন ১৭ সেপ্টেম্বর বেলা পৌনে ৩টার দিকে তাঁকে মুঠোফোনে আজিমপুর কবরস্থানের পশ্চিম পাশের নিউ পল্টন লেনের ওই আসবাবের দোকানে নিয়ে যান। সেখানে তাঁকে জিম্মি করে মামুনের সঙ্গে কথা বলে তাঁর অবস্থান জানতে বলা হয়। মধ্যরাতে সেখান থেকে তাঁকে যখন বের করে আনা হয়, তখন তাঁর চোখ বাঁধা ছিল। তাঁকে একটি মোটরসাইকেলে করে অজ্ঞাত স্থানে নেওয়া হয়। মামুনকে হত্যাচেষ্টার আগে তাঁকে চোখ বেঁধে মোটরসাইকেলে করে ঘটনাস্থলে নেওয়া হয়।
তবে কবরস্থানের পাশের ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৭ সেপ্টেম্বর বেলা ৩টা ৪৫ মিনিটে একটি মোটরসাইকেলে করে আরও দুজনের সঙ্গে হিমেল ওই দোকানে আসেন। তখন তিনি স্বাভাবিকভাবেই দোকানটির পরিত্যক্ত কক্ষে যান। রাত পৌনে ১২টায় মারুফ ওই কক্ষ থেকে বের হওয়ার সময় তাঁর মাথায় হেলমেট দেখা যায়। তাঁকে জিম্মি করা হয়েছে, ফুটেজ দেখে তা মনে হয়নি। তখন তাঁর চোখ বাঁধাও ছিল না।
গতকাল দুপুরে আজিমপুর কবরস্থান–সংলগ্ন নিউ পল্টন লেনে গিয়ে দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনারের (ডিসি) কার্যালয়ের পাশেই ওই আসবাবের দোকান। তার একটি কক্ষ তালাবদ্ধ। একপর্যায়ে দোকানমালিক মাসুদ খান ওই কক্ষের তালা খুলে দেন। তখন দেখা যায়, স্যাঁতসেঁতে কক্ষে পরিত্যক্ত কিছু আসবাব রয়েছে।
মাসুদ খান প্রথম আলোকে বলেন, এখানে এলাকার পরিচিত-অপরিচিত অনেক মানুষ এসে আড্ডা দেন। জোর করেই তাঁরা কক্ষটির তালা খুলে ঢুকে মাদক সেবন করেন। এ নিয়ে কিছু বললে তাঁরা হুমকি দেন। তাই ভয়ে তাঁদের কিছু বলা যায় না।
হামলায় অংশ নেন ১৩-১৪ জন
পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে হিমেল বলেছেন, ইমনের সহযোগীদের চাপে তিনি মুঠোফোনে যোগাযোগ করে মামুনের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য নেন। মামুন মগবাজারের পিয়াসী বারে আছেন জানতে পেরে তাঁরা রাত আটটার দিকে ওই বারের সামনে আছেন। মামুনের গাড়ি অনুসরণ করে তাঁরা তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বিজি প্রেসের সামনে এসে হামলা করেন। পরে তাঁরা মোহাম্মদপুরের দিকে চলে যান। এই পুরো সময় মারুফের চোখ বাঁধা ছিল বলে তিনি দাবি করেছেন।
তবে পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন, দায় এড়াতে মারুফ এমন গল্প ফেঁদেছেন। তাঁরা বলেছেন, মামুন চিনে ফেলবেন বলেই হামলার সময় মারুফ হেলমেট পরেছিলেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি নিজেই এ হত্যা পরিকল্পনার অংশ হতে পারেন।
মামুনের ওপর হামলায় ৬-৭টি মোটরসাইকেলে ১৩-১৪ জন অংশ নিয়েছিলেন জানিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেছেন, তাঁদের অনেকেরই পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। তাঁরা মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ ও বাসাবো এলাকার সন্ত্রাসী।
সন্ত্রাসী মামুনের সঙ্গে হিমেলের সখ্য যেভাবে
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, মারুফ বিল্লাহ হিমেলের ভগ্নিপতি এম এ শরীফ ২০০৩ সালে আইনজীবী হাবিব মণ্ডল হত্যা মামলায় দণ্ডিত হয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন সাজা খেটে ২০১৮ সালে মুক্তি পান। ভগ্নিপতির সঙ্গে দেখা করতে কারাগারে গিয়ে মামুনের সঙ্গে হিমেলের পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। কারাগারে থাকা অবস্থায় ইমনের সঙ্গে মামুনের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এই সূত্রেই ইমনের সহযোগীদের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ হয়। মামুন সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হলে হিমেলের সঙ্গে কয়েক দফা দেখা হয়েছে।