৬ লাখ প্রচারকর্মী তৈরি করছে আওয়ামী লীগ, অপপ্রচারের ‘জবাব’ দেবেন তাঁরা
যেকোনো নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ‘তিনি জিতে আসতে পারবেন তো’। অবশ্য এই বিবেচনা তখনই প্রযোজ্য হয়, যখন সুষ্ঠু ভোট এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সম্ভাবনা থাকে।
দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দলের প্রার্থী ‘জিতে আসতে পারবেন কি না’ এই ঝুঁকি কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের জন্য ছিল না। এর পরও এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কাকে প্রার্থী করতে যাচ্ছে, তা নিয়ে গত কয়েক দিনে বেশ আলোচনা হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ পদে ক্ষমতাসীন দল কাকে বসাচ্ছে, তা নিয়ে কৌতূহল থাকাটাই স্বাভাবিক। যদিও মানুষ জানত, আওয়ামী লীগ যাঁকে প্রার্থী করবে তিনিই রাষ্ট্রপতি হবেন। এই বাস্তবতা জানার পরও বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টির পেছনে অবশ্য গণমাধ্যমেরও একটা ভূমিকা ছিল।
এবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গোপনীয়তার যে কৌশল নেওয়া হয়েছে তাতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি সাধারণ কর্মী–সমর্থকদের আস্থা আরও বাড়াবে বলেই মনে করছেন অনেকে। এর আগেও আওয়ামী লীগ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কৌশলের পরিচয় দিয়েছে।
রাষ্ট্রপতি পদে আওয়ামী লীগ কাকে প্রার্থী করতে যাচ্ছে, তা নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন গত কয়েক দিনে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রচার ও প্রকাশ করেছে। সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে অনেকের নাম ও ছবি ছাপা হয়েছে—কেন তাঁরা রাষ্ট্রপতি পদের জন্য দলের বিবেচনায় রয়েছেন সেটি আওয়ামী লীগেরই বিভিন্ন সূত্র থেকে তুলে ধরা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিষয়টি গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব পাওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই মানুষ এ সংক্রান্ত আলোচনায় আগ্রহী হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে গত কয়েক দিনে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, এর প্রায় সবকটি সর্বোচ্চ পঠিতের তালিকাতে ছিল। অসংখ্য পাঠক এসব প্রতিবেদন পড়ে প্রথম আলোয় মন্তব্য পাঠিয়েছেন। এ সংক্রান্ত প্রতিটি প্রতিবেদনের নিচে পাঠকদের পাঠানো প্রচুর মন্তব্য প্রকাশ করেছে প্রথম আলো। একটি নির্দিষ্টি বিষয়ের ওপর করা প্রতিবেদনগুলোতে পাঠকের বিপুল যুক্ততা দেখেও বুঝা যায় এই নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ মোটেও কম ছিল না।
এবার আগে থেকে ঠিক অনুমান করা যাচ্ছিল না শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদে কাকে মনোনীত করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলটির টানা ক্ষমতার ১৪ বছরে দেশে তিনবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়েছে। প্রতিবারই কে রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন, সেটি আগেই জানা গিয়েছিল। কিন্তু এবার দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়টি বেশ গোপনীয়তার সঙ্গে করেছে। ফলে একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নানা অনুমান, জল্পনা–কল্পনা চলছিল। ১২ ফেব্রুয়ারি সকালে নির্বাচন কমিশনে রাষ্ট্রপতি পদে দলের প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগ পর্যন্ত তা অনেকটাই গোপন ছিল।
গত কয়েক দিনে আওয়ামী লীগ সরকারের একাধিক মন্ত্রী এবং দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় যেসব ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, মনোনীত প্রার্থীর নাম জানার পর দেখা গেল তা একদমই মিলেনি। এমনকি আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকে দল মনোনীত রাষ্ট্রপতির নাম শুনেছেন মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সামান্য আগে। অনেকে আবার সাংবাদিকদের কাছ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি (মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন) সকালে নামটি জেনেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক দক্ষ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেছেন। অনেকের কথা শোনা গেছে, আমার নাম কেউ কেউ আলোচনা করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা এমন একজনকে বেছে নিয়েছেন, যার নাম আজ (১২ ফেব্রুয়ারি) সকাল পর্যন্ত কেউ জানত না।
ওবায়দুল কাদের, সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
কেন এবার এতোটা কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব এই কাজটি করল, সেটি দলের অনেক নেতার কাছেই এখনো স্পষ্ট নয়। রাষ্ট্রপতি পদে দলীয় প্রার্থীর নাম কোনোভাবে আগে প্রকাশ হয়ে গেলে তা নিয়ে দলের ভেতরে যে কোনো প্রশ্ন উঠত, বিষয়টি এমনও নয়।
এ রকম পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, আওয়ামী লীগ তাহলে কেন এমন ‘কৌশল’ নিল। এই কৌশল নিয়ে অন্যদের আসলে কী বার্তা দিল দলটি। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের আটজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের মনে এমন আস্থা–বিশ্বাস জন্মেছে যে এখন তাঁরা ভাবতে শুরু করেছেন, এ রকম কোনো কৌশল নিয়েই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব আগামী নির্বাচনেও জয় নিয়ে আসবে। যে কৌশল, আগে থেকে কেউ অনুমান করতে পারবে না। অবশ্য তাঁরা এটিও দাবি করেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ জিতবে। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলেছেন, দেশের এত উন্নয়ন এর আগে কখনো হয়নি।
পাশাপাশি রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কৌশল কেন কার্যকর সে উদাহরণও দিয়েছেন ওই নেতারা। তাঁরা বলছেন, ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় নির্বাচন শেষ পর্যন্ত কেমন হবে বা আওয়ামী লীগ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে তাঁদের মধ্যে শঙ্কা–দ্বিধা ছিল। কিন্তু দেখা গেল ভোটের আগেই সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ। মোট ১৫৩ জন বিনা ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যান তখন। এ রকম কিছু ঘটবে তা ধারণার মধ্যে ছিল না বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন ওই নেতারা। একইভাবে ২০১৮ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের ‘কৌশল’ কাজ করেছিল বলে মনে করেন তাঁরা। বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো নির্বাচনে গেলেও ভোট কেমন হবে তা অনুমান করতে পারেনি কেউ। যদিও ভোট শেষে বিরোধীরা অভিযোগ করেছে, দিনের ভোট রাতে হয়ে গেছে।
আমি শুনেছি, (গত নির্বাচনে) পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনিনি।
ইতো নাওকি, ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত
আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনকে বিভিন্ন দেশ, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত বলেছে। এমনকি বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি গত বছরের নভেম্বরে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমি শুনেছি, (গত নির্বাচনে) পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনিনি।’
রাষ্ট্রদূতের এমন মন্তব্যে তখন দেশের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। পরে এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন,‘বাস্তবতা এটাই যে, জাপানি রাষ্ট্রদূত যে কথা বলেছেন চরম সত্য কথা বলেছেন।’
অবশ্য তর্ক–বিতর্ক, মত–দ্বিমত থাকলেও ক্ষমতার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের নির্বাচনকেন্দ্রিক কৌশল যে কার্যকর—টানা তিন মেয়াদে দলটি ক্ষমতায় থেকে সেটি প্রমাণ করে দিয়েছে। অবশ্য এই ‘কৌশলের’ কারণে এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও বিনা ভোটে জয়ী হওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে।
এবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গোপনীয়তার যে কৌশল নেওয়া হয়েছে তাতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি সাধারণ কর্মী–সমর্থকদের আস্থা আরও বাড়াবে বলেই মনে করছেন অনেকে। এর আগেও আওয়ামী লীগ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কৌশলের পরিচয় দিয়েছে। দলটির নেতাদের অনেকে মনে করেন, আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রেও দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছ থেকে ভিন্ন কোনো কৌশল আসতে পারে।
আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটি ৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি মনোনয়নের বিষয়টি দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়েছিল। আর ১২ ফেব্রুয়ারি সকালে জানা গেল দলের প্রার্থীর নাম। বিষয়টি কতোটা গোপন ছিল সেটি বুঝা যায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ১২ ফেব্রুয়ারি দলের এক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক দক্ষ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেছেন। অনেকের কথা শোনা গেছে, আমার নাম কেউ কেউ আলোচনা করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা এমন একজনকে বেছে নিয়েছেন, যার নাম আজ (১২ ফেব্রুয়ারি) সকাল পর্যন্ত কেউ জানত না।’
আওয়ামী লীগের মধ্যম পর্যায়ের অনেক নেতা মনে করেন, রাষ্ট্রপতি মনোনয়নের ক্ষেত্রে গোপনীয়তার যে কৌশল নেওয়া হয়েছে, তেমন কিছু আগামী নির্বাচনেও ঘটবে যা আগে থেকে কেউ অনুমান করতে পারবে না।