Home অপরাধ ৪ বছর পর জানা গেল মমতাজ বেগম খুন হন ভাই-ভাতিজাদের হাতে
সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৩

৪ বছর পর জানা গেল মমতাজ বেগম খুন হন ভাই-ভাতিজাদের হাতে

স্কুলশিক্ষিকা মমতাজ বেগম খুন হয়েছেন সাড়ে চার বছর আগে। তবে এ খুনের রহস্যের কোনো কুলকিনারা হচ্ছিল না। কোনো সূত্র বা ক্লু ছাড়াই তদন্তে নামে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। চার বছর ‘ঘুরপাক’ খাওয়ার পর অবশেষে রহস্যভেদ করতে সমর্থ হয়। পিবিআই বলছে, জমি নিয়ে ঝামেলার জেরে মমতাজ বেগমকে শ্বাসরোধে খুন করা হয়। আর এ খুনে জড়িত তাঁর ভাই ও ভাতিজারা।

রাজধানীর নাখালপাড়ার হলি মডেল কিন্ডারগার্টেনের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন মমতাজ বেগম। পরিবার নিয়ে থাকতেন পূর্ব নাখালপাড়ায়। ২০১৯ সালের ১ মার্চ গাজীপুরের কোনাপাড়ার বাঘিয়ায় বড় ভাই আবদুর রশীদ সরকারের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন তিনি। পরদিন ২ মার্চ বাঘিয়ার ডিস পুকুরপাড়ের মণ্ডলবাড়ির সীমানাপ্রাচীরের পাশ থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

মমতাজ বেগমের বড় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মায়ের মরদেহ শনাক্ত করেন। পুলিশ জানায়, মমতাজের গলায় শ্বাস রোধ করে হত্যার চিহ্ন ছিল। এ ছাড়া তাঁর চোখের ডান পাশে ও ডান পায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল। পরে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে কোনাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন জান্নাতুল ফেরদৌস। তদন্তে নামে কোনাবাড়ী থানা-পুলিশ। কিন্তু কুলকিনারা করতে না পারায় ২৩ দিন পর মামলার তদন্তভার যায় পিবিআইয়ের হাতে।

মমতাজ বেগমের খুনের ঘটনায় কোনো ক্লু ছিল না। চার বছরের বেশি সময় পর গত আগস্টে এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় পিবিআই। আসামি করা হয় মমতাজের বড় ভাই ও পাঁচ ভাতিজাসহ স্থানীয় একটি ইটভাটার দুই কর্মচারীকে।

মামলার সর্বশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন পিবিআই গাজীপুরের পরিদর্শক হাফিজুর রহমান। তিনি এখন ঢাকায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) কর্মরত। হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মমতাজের মুঠোফোন জব্দ করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা থেকেও খুনের রহস্যের কুলকিনারা হয়নি। তাই ক্লু-বিহীন এ মামলা তদন্তে গত মার্চে সোর্স (তথ্যদাতা) নিয়োগ করা হয়। সেই সূত্রেই খুনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্লু হাতে আসে।

হাফিজুর রহমান জানান, তাঁর আগে মামলাটি তদন্ত করেছিলেন পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ কাওছার উদ্দিন। তিনি মমতাজের দুই ভাতিজাসহ তিন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে মমতাজের মেয়ে জান্নাতুল জানিয়েছিলেন, মমতাজের কাছ থেকে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমি কেনার জন্য তাঁর মামা ৩ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তবে মমতাজের খুনের পেছনে মামা ও মামাতো ভাইয়েরা জড়িত থাকতে পারেন—এমন সন্দেহ করেননি জান্নাতুল।

ঝগড়ার সূত্র ধরে রহস্যভেদ

মমতাজ বেগমের ভাতিজা উচ্ছ্বাস সরকার পুলিশের সন্দেহের তালিকায় ছিলেন। উচ্ছ্বাস মাদকাসক্ত। পিবিআইয়ের সোর্স উচ্ছ্বাসকে অনুসরণ করেন। গত ১২ মার্চ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বাঘিয়া এলাকার বাসিন্দা মো. মামুনের ঝগড়া হয়। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে মামুন হুমকি দেন, বেশি বাড়াবাড়ি করলে সবকিছু ফাঁস করে দেবেন। জবাবে উচ্ছ্বাস বলেন, ‘তাহলে তোর অবস্থাও ফুফুর (মমতাজ) মতোই হবে।’

উচ্ছ্বাস ও মামুনের এই কথা-কাটাকাটির খবর সোর্সের মাধ্যমে পিবিআইয়ের কাছে পৌঁছায়। তাৎক্ষণিকভাবে পিবিআই মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। শুরুতে তিনি মুখ খুলতে চাননি। নিজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে বলে ভয় পাচ্ছিলেন মামুন। পিবিআই তাঁকে নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দিলে মামুন জানান, মমতাজের খুনের ঘটনা তিনি দেখে ফেলেছিলেন।

চলতি বছরের ১৩ মার্চ মামুন সাক্ষী হিসেবে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। মামুন জানান, ২০১৯ সালের ১ মার্চ রাত ১২টা নাগাদ তিনি কাজ শেষে বাড়িতে ফিরছিলেন। দেখতে পান, ইটভাটার শ্রমিক কাজী বাবুল ও হাবিবুর রহমান ভারী একটি বস্তা নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের ঠিক পেছনে ছিলেন মমতাজের বড় ভাই আবদুর রশীদ সরকারের ছেলে অনুপম হায়াত ও নাজমুস সাকিব। পরিত্যক্ত একটি দেয়ালের পাশে বস্তাটি ফেলে দেওয়ার আওয়াজ পান তিনি। পরদিন ওই জায়গা থেকে মমতাজের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

পুরো ঘটনাটি নিয়ে অনুপম ও নাজমুসের সঙ্গে কথা বলেছিলেন মামুন। তাঁরা মামুনকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য হুমকি দেন। তাই ভয়ে এত দিন কাউকে কিছু জানাননি তিনি। পরে মমতাজ বেগমের আরেক ভাইয়ের ছেলে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে মামুনের কথা-কাটাকাটি হয়। তখন তিনি সবকিছু ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেন।

মামুনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে উচ্ছ্বাসকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি তাঁর ফুফুকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি। গ্রেপ্তার করা হয় মমতাজের ভাতিজা অনুপম হায়াত (২০), নাজমুস সাকিব (২০), হাসিব সরকার (২৬), ইটভাটার কর্মচারী কাজী বাবুল (৩২) ও হাবিবুর রহমানকে (৪৮)। মমতাজের ভাই আবদুর রশীদ সরকার (৫৭) ও তাঁর ছেলে আসাফ-উদ-দৌলা পলাতক।

জমির জন্য ভাই-ভাতিজাদের হাতে খুন

পিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে উচ্ছ্বাস জানান, বাঘিয়ার মোল্লাপাড়ায় তাঁর ফুফু মমতাজ বেগমের ৩০ শতাংশ জমি আছে। সেই জমি কিনে নেওয়ার জন্য তাঁর চাচা আবদুর রশীদ ফুফুকে তিন লাখ টাকা দেন। এ টাকার বিনিময়ে চাচা আবদুর রশীদ জমি নিবন্ধন করে নিতে চেয়েছিলেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে ফুফু জমি নিবন্ধনে গড়িমসি করছিলেন।

উচ্ছ্বাস আরও জানান, জমিসংক্রান্ত আলোচনার জন্য ওই দিন (২০১৯ সালের ১ মার্চ) ফুফুকে আবদুর রশীদের বাড়িতে ডেকে আনা হয়েছিল। চাচা আবদুর রশীদ পরিকল্পনা করেছিলেন, বোনের কাছ থেকে জোর করে জমি লিখিয়ে নেবেন। রাজি না হলে তাঁকে খুন করা হবে। পরে মরদেহ প্রতিপক্ষ সাইদুর রহমানের বাড়ির কাছে ফেলে দিয়ে তাঁর পরিবারের লোকজনদের ফাঁসানো হবে। ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী আবদুর রশীদ তাঁর ছেলে ও ভাতিজাদের নিয়ে বোন মমতাজকে মারধর ও শ্বাস রোধ করে হত্যা করেন।

মমতাজ বেগম হত্যা মামলার বাদী ও তাঁর বড় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, ‘মা খুন হওয়ার পর আমাদের পরিবারটা তছনছ হয়ে গেছে। আমরা দুই বোন। ২০১৯ সালে ছোট বোন মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছিল। এরপর টাকার অভাবে বোনের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে।’

মা-হারা জান্নাতুল ফেরদৌস আরও বলেন, ‘জমি কিনে নেওয়ার জন্য বড় মামা আর মামাতো ভাইয়েরা মিলে আমার মাকে খুন করেছেন—এটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। বুঝলে সন্দেহভাজন হিসেবে তাঁদের নাম পুলিশকে জানাতাম।’ চার বছর পর খুনের রহস্যভেদ করায় পিবিআইয়ের তদন্তকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি চাই, খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক।’

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *