Home রাজনীতি খাদ্য মূল্যস্ফীতির জটিল রোগে বাংলাদেশ
সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩

খাদ্য মূল্যস্ফীতির জটিল রোগে বাংলাদেশ

কূটনীতি-রাজনীতির চারদিকে কেবল সরকারের সাফল্যের খবর। শুধু ভারত নয়, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-চীন-রাশিয়া, এমনকি ফ্রান্সও সরকারের কৃতিত্বে মুগ্ধ। পাশে থাকার অঙ্গীকার। স্মার্ট বাংলাদেশকে এগিয়ে দেয়ার ওয়াদা। আর রাজনীতিতে কোনো প্রতিপক্ষই নেই। বিরোধী দল বিএনপি নেতাকর্মীদের চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে বলে দাবি ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের। অর্থাৎ সরকার নির্ভার; একদম নো টেনশনে।

সরকারের এ অবস্থার মাঝে ভয়াবহ খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে ভুগছে বাংলাদেশ। অঙ্কটি ভয়ানক পর্যায়ে, ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ যা গত সাড়ে ১১ বছরে সর্বোচ্চ। এ জন্য দায়ী করা হয়েছে মুরগি ও ডিমকে। পরিকল্পনামন্ত্রীর ভাষায় আগস্টে মূল্যস্ফীতির মূল নায়ক মুরগি ও ডিম। তার মতে, ‘উদীয়মান অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি এক ধরনের আশীর্বাদ’। ‘যে সাপের খেলা জানে, সে ঠিকই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। অর্থমন্ত্রীও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ বললে ক্ষেপে যান। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, যারা বলে দেশের অবস্থা খারাপ, তারা অর্থনীতি বোঝেন না। অর্থনীতি সম্পর্কে তাদের কোনো পড়াশোনা নেই। আর বাণিজ্যমন্ত্রী ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ‘কিছুটা’ বেড়েছে স্বীকার করেছেন। তবে দায় চাপিয়েছেন ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়া ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়াসহ কয়েকটি কারণকে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশ বেশ সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু বলার সময় আরেকটু বেশি করে বলার চর্চা বাংলাদেশে রয়েছে। কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিপ্লব এনেছে বলে প্রচারটা একটু বেশি। পাট উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, চাল উৎপাদনে তৃতীয়, বিভিন্ন সুগন্ধি মসলা এবং কয়েক ধরনের ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ, বাংলাদেশ ডাল, কাঁঠাল, লিচু এ ধরনের শস্য ও ফল উৎপাদনে ষষ্ঠ অবস্থানে। আলু, পেঁয়াজ, আদা, চা, মিষ্টি কুমড়া, সিডস, ব্রকলি, আম, এসব শস্য ও ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দশটি রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থান করছে। প্রায় বিশটি পণ্যে পৃথিবীতে দশম স্থানের মধ্যে আছে। অর্থাৎ বিভিন্ন কৃষিপণ্যে এক থেকে দশের মধ্যে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যানের এসব তথ্যের সাথে বাজারের চিত্র মিলছে না। গোল আলু থেকে শুরু করে কচুর লতি-শুঁটকিসহ কোনো পণ্যই সাধারণ ক্রেতাদের আয়ত্তে নেই। বাজার ব্যবস্থাপনায় চরম নৈরাজ্য। সরকারি ঘরানার ব্যবসায়ীদের ফ্রিস্টাইলের কাছে বাজার জিম্মি। বিশ্ববাজারে কমলেও তাদের কাণ্ড-কীর্তিতে বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম কেবলই বাড়ছে। তাও রেকর্ডমাত্রায়। সরকারের দিক থেকে তা মানতে অনীহা। তার ওপর সারের দামও চড়া। ক্রমেই তা প্রকট হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় গ্যাস সঙ্কটে কয়েকটি সার কারখানায় উৎপাদন স্থগিত।

প্রকৃতির বিরূপ আচরণের কারণে এমনিতেই বিপাকে রয়েছেন কৃষক। চলতি বছর দুই দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আউশ আবাদ। নষ্ট হয়ে গেছে রোপা আমনের বীজতলাও। এ দিকে ভরা বর্ষা মৌসুমেও নেই পর্যাপ্ত বৃষ্টি। অনাবৃষ্টিতে সৃষ্ট খরার কারণে পিছিয়ে গেছে রোপা আমনের চাষ। এমন অবস্থায় কৃষক সেচ দিয়ে আমন ক্ষেত প্রস্তুত করছেন। সেখানে আবার বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে ডিজেল। বেশি দামে কিনতে হচ্ছে কৃষি উপকরণ, বীজ ও বালাইনাশক। শ্রমিকের বাড়তি মজুরি তো রয়েছেই যা ফসলের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরিস্থিতিটি চালসহ কৃষিপণ্যের দাম আরো বাড়ার নমুনা। কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার শঙ্কাও আছে। ভূ-রাজনীতির সঙ্গে বৈশ্বিক খাদ্যবাজার জড়িয়ে পড়াটা বিপজ্জনক। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, সারা বিশ্ব খাদ্যসঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে। সেই সতর্কতা ফলতে শুরু করেছে। বিভিন্ন দেশ আগাম ব্যবস্থা নিয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশই দ্রব্যমূল্য লাগামে আনতে সক্ষম হয়েছে। পাশের দেশ শ্রীলঙ্কাও পেরেছে। তাদের মূল্যস্ফীতি ছিল ৪৯ শতাংশ। দেশটিই দেউলিয়া হয়ে যায় প্রায়। সরকার পতনও হয়ে যায়।

সেই শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের মূল্যস্ফীতি এখন ৫ শতাংশ। শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়ালো কিভাবে, তা আমলে নেয়ার গরজ কম। বৈশ্বিক সঙ্কটকে দায়ী করতে পারলেই যেন রক্ষা। এ সুযোগটা নিচ্ছে দুষ্টচক্র। তাদের উড়ানো ধুলায় চোখে অন্ধকার, মুখে বোবাকান্না নিম্ন ও মধ্যবিত্তের। আজ ডিম, কাল লবণ-মরিচ। পেঁয়াজ-আদা, চাল-ডাল-তেল। কিছুতেই ছাড় নেই। ধনাঢ্যদের কথা আলাদা। চালের কেজি পাঁচ শ’, পেঁয়াজ হাজার বা কাঁচা মরিচের কেজি দুই হাজার টাকা হলেও কোনো ঝাঁজে পাবে না তাদের। তাছাড়া, ‘সারা বিশ্বেই পণ্যমূল্য বাড়তি, বাংলাদেশে সেই তুলনায় কম’- এ ধরনের কথা ছুড়ে দিতে তাদের বিবেকে একট্ওু বাধবে না। চালের বিকল্প আলু-কাঁঠাল বা বেগুনের বিকল্প কুমড়া-পেঁপে বাতলে দেয়ার মশকরায়ও লজ্জিত হবেন না। লজ্জায় প্রিজারভেটিভ দেয়া সম্প্রদায়ের ‘ভাত না খেলে কী হয়, বলতে মুখে আটকাবে না।

প্রকারান্তরে এরা ঘায়েল করছে সরকারকেও। চাল, ডাল, তেল, নুন, চিনি, আটা, ময়দা, আদা, পেঁয়াজ, রসুন, চামড়া, আমড়া সব কিছু নিয়েই খেলছে সমানে। ডিমের বাজারেও দফায়-দফায় তাদের হাটটিমা-টিম গেইমের শিকার মানুষ। ডিম যে কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেই তালগোল পর্যন্ত বাঁধিয়ে দেয়ার পারঙ্গমতা দেখিয়েছে চক্রবাজরা। সুঁই-সুতা থেকে ওষুধ-পথ্যও তাদের গেম ফিল্ড। দুই হাতে অর্থ হাতানোর এ পদ্ধতিতে চাহিদা, জোগানের পরিমাণ; কে সরবরাহকারী-বিপণনকারী, কে ভোক্তা; এসবের কোনো বালাই নেই। শিকার ধরাই আসল। বাজার নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের কাছে বাদবাকিরা কেবলই শিকারের বস্তু। বাজার চড়ানোর পেছনে শীত-গরম, বৃষ্টি-খরা, মন্দা-যুদ্ধসহ হরেক অজুহাত তারা হাতে হাতেই রাখে। সরকারকে বানিয়ে ফেলে তাদের সেই অজুহাত প্রচারকারী জনসংযোগ কর্তৃপক্ষ। মন্ত্রীকে পর্যন্ত বলতে হয়, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। প্রতিমন্ত্রী বলে দেন, নাম বললে তার জীবন চলে যাওয়ার শঙ্কা আছে। খেলাটা কী আচানক! সিন্ডিকেটের প্রবল ক্ষমতার কাছে সরকারেরই যখন অসহায়ত্ব, তখন সাধারণ মানুষের জায়গা কোথায়?

বাজারে চাহিদার বিপরীতে জোগান কমে যাচ্ছে; নাকি কমিয়ে দেয়া হচ্ছে-তাও প্রশ্ন। ব্যবসায়ী নেতারাই বলছেন, সব পণ্যদ্রব্যই মজুদ আছে, নাটক চলছে কৃত্রিম সঙ্কটের। যে কৃত্রিমতা কম-বেশি অন্যান্য সেক্টরেও। চতুর্মুখী এ অস্বাভাবিকতায় কৃষক উৎপাদন করে, মাঠে ফসল দেখে হাসে, আর বিক্রি করে কাঁদে। বাজারে মৌসুমেও চালের দাম কমে না, সবজির দাম তেমন কমে না। কিন্তু কৃষকের ভাগ্যে যে ন্যায্য দাম জোটে না- সেই বেদনা কেবল কৃষকরাই ভোগে, হজম করে। কৃষি বাজেট বাড়ে না কেন, কৃষি উপকরণের মূল্য সহায়তা কৃষক কতটুকু পান, কৃষি উৎপাদন করে কেন কৃষক অসহায় ফড়িয়াদের কাছে? এসব প্রশ্ন অসহ্য-বিরক্তিকর ক্ষমতার শীর্ষপর্যায়ের কাছে। দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মসংস্থান কৃষিতে। খাদ্য চাহিদার ৯০ শতাংশ পূরণ করে কৃষি খাত।

কারণ সাধারণ মানুষের খাদ্যপণ্য চাল, আটা, ডাল, চিনি, তেল, লবণ, সবজি, পেঁয়াজ, মরিচ, মাছ, ডিম, মুরগি, কোনটার দাম না বেড়েছে? সব কিছুর দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এটি সিন্ডিকেটের দারুণ সমন্বয় ও সুযোগ। মলম পার্টির মতো জোরজবরদস্তি লাগছে না। মানুষকে আপসেই নিজের চোখে নিজে মলম মেখে বোবাকান্না কাঁদতে হচ্ছে। একবার পেঁয়াজ, আর একবার মরিচ, কখনো ডিম তো কখনো মুরগি! এক মাসে তেলে আর ডালে চক্রাকারে চক্রশূলে চড়ছে। মৌসুমে পেঁয়াজের দাম ২০০ টাকা ছুঁয়ে ফেলল, তারপর আবার ৬০ টাকায় নেমে এলো। এ সময়কালে পেঁয়াজের কোনো নতুন উৎপাদন কি হয়েছে? তাহলে দাম কমল কেন? মূলত এ সময়ে উৎপাদন হয়েছে ব্যবসায়ীর মুনাফার আর জনগণের দুর্দশার। নিদারুণ বাস্তবতায় রাজনীতিতে এগুলো ইস্যু হয় না। মিছিল, পদযাত্রা, শোভাযাত্রার বিষয়আশয় সব রাজকীয়।

রাজক্ষমতার নানাদিকের মাঝে ছোট ও দুর্বল মানুষের কষ্ট দূর করার অ্যাজেন্ডার বাজারও ‘নাই’ করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়ে থাকে- বাজার পুড়লে মাজারও থাকে না; লোকালয়ে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না। এ ধরনের আরো অনেক কথার প্রচলন আছে আমাদের সমাজে ও লোক সাহিত্যে। কথাগুলোর অর্থ বহুমুখী। আক্ষরিক-আভিধানিকে অনেক তফাৎ। এর মাঝেও কেউ ক্ষমতায় আছেন, আরো থাকবেন বলে ছক আঁকছেন। পারলে জনমভর বা আজীবন থাকার চেষ্টা। আবার কারো যত চেষ্টা পাকাপোক্ত হয়ে ক্ষমতায় আসার। সেই প্রস্তুতিতে কোমর বাঁধছেন। তাদের উভয়ের মন-মনন, মানসিকতা, কথা-কাজ বোঝার কারো বাকি নেই। সমাজের ধড়িবাজরা আগুয়ান সেই নিরিখেই।

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *