আইজীবীদের পদযাত্রায় পুলিশের বাধা, সংঘর্ষে আহত অর্ধশতাধিক
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে আইনজীবীদের পদযাত্রায় রাজধানীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশসহ অর্ধশতাধিক আইনজীবী আহত হয়েছেন। কোতয়ালী জোনের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মুহিত সেরনিয়াবাতসহ কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন বলে দাবি করছে পুলিশ। কয়েকজনকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা আইনজীবী সমিতির মূল গেটের সামনে (ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উল্টো পাশে) এ ঘটনা ঘটে।
আইনজীবীদের সংগঠন ইউনাইটেড ল’ইয়ার্স ফ্রন্ট ঢাকা বার ইউনিটি পদযাত্রার আয়োজন করে। দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সামনে থেকে পদযাত্রা শুরু হয়। এরপর মিছিলটি আদালতের সামনের প্রধান সড়কে এলে পুলিশ বাধা দেয়। পরে আইনজীবীরা রাস্তায় বসে পড়লে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে পুলিশ আইনজীবীদের লাঠিচার্জ করে। পরবর্তী সময়ে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে তারা সিএমএম আদালতের প্রধান গেটে অবস্থান নেন। এসময় তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সেখান দিয়ে সিএমএম আদালতে ঢুকতে গেলে পুলিশ তাদের আটকে দেয়। কিছুক্ষণ সেখানে ধাক্কাধাক্কি হয়। এরপর পুলিশ প্রধান গেট খুলে দেয়। আইনজীবীরা সিএমএম আদালতের সামনে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। কিছুক্ষণ অবস্থান করে তারা সেখান থেকে ঢাকা আইনজীবী সমিতি ভবনের সামনে আসেন। তারা সেখানে এসে সমাপনী বক্তব্য রাখেন।
বিএনপি যুগ্ম-মহাসচিব ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আজকে আমাদের প্রোগাম ছিল শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা। কোর্ট থেকে বের হলে পুলিশ জঙ্গির মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো। আইনে তো জঙ্গির ডেফিনেশন নেই। আজকে পুলিশের আক্রমণ জঙ্গির মতো আচরণ। নির্বিচারে তারা আইনজীবীদের পেটালো। তা জঙ্গিদের হার মানিয়েছে। তারা আইনজীবী বোনদের টর্চার করেছেন। গায়ে হাত দিয়েছেন। সবাই এডিসি হারুন হতে চায়। পুলিশের দুই রকম বিচার। এডিসি হারুন ছাত্রদের মারলো। তারপর সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবীদের ওপর হামলা করেছে। বিচার হয়নি। অথচ দুইজন ছাত্রলীগকর্মীকে মেরে রবখাস্ত হয়েছে। সরকারি দলের দুইজন আহত হওয়ায় এডিসি হারুনকে বরখাস্ত করা হয়। অথচ হাজারো মানুষের ওপর হামলা করেছেন তার কোনো বিচার নেই।
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, এটা আমাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ছিল। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করছিলাম। প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের নির্দেশে আজ পুলিশ বাহিনী আইনজীবীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ হামলা শুধু আইনজীবীদের ওপর হামলা নয়, আইনের শাসন, মানবাধিকারের ওপর হামলা। আমরা এই হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। আইনজীবীরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, যতদিন পর্যন্ত সরকারের পতন না হবে ততদিন তারা ঘরে ফিরে যাবে না।
কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহিনুর রহমান বলেন, আইনজীবীরা সাধারণত আদালতের ভেতর কর্মসূচি পালন করেন। তারা আজ আদালতের বাইরে এসে কর্মসূচি পালন করেছেন। আমরা অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু তারা অতি উৎসাহী হয়ে আমাদের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে কোতয়ালী জোনের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মুহিত সেরনিয়াবাতসহ আমাদের ৫/৬ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। পুলিশের লালবাগ জোনের ডিসি জাফর হোসেন বলেন, আইনজীবী আমাদের পুলিশের ওপর হামলা করেছে। পুলিশ ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের চারজন পুলিশ আহত হয়েছেন। এ বিষয় আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেবো।
এদিকে আইনজীবীদের কাছ থেকে পুলিশ এমন আচরণ আশা করেনি বলে মন্তব্য করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। গতকাল সন্ধ্যায় রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাত পুলিশ সদস্যকে দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ মন্তব্য করেন তিনি। আইজিপি বলেন, আইনজীবীদের হামলায় একজন এডিসি, এসি, ওসি ও একজন পরিদর্শকসহ (তদন্ত) কয়েকজন আহত হয়েছেন। দায়িত্ব পালনের সময় তারা আহত হয়েছেন। তাদের কর্মসূচি পালনের সময় আমরা তাদের বার বার বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করেছি জনসন রোডের রাস্তাটা ব্লক করা ঠিক হবে না। কিন্তু তারা আমাদের কথায় কর্ণপাত না করে রাস্তায় বসতে চেয়েছিলেন। আমরা তাদের বলেছি, এটা আপনারা পারবেন না, তখন তারা পুলিশ সদস্যদের ওপরে হামলা করেছে। তাদের হামলায় আমাদের লোকজন আহত হয়েছে। তারা সবাই আইনজ্ঞ মানুষ, বিজ্ঞ আইনজীবীদের কাছ থেকে আমরা আরও দায়িত্বশীল আচরণ আশা করছিলাম। তিনি বলেন, যারা এর সঙ্গে জড়িত, আমরা ভিডিও ফুটেজ দেখে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যখন যে সমস্যা আসে সেটার ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আমরা আশা করেছিলাম, আজকে তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি থাকবে। তারা যে হঠাৎ করে এমন আচরণ করবেন সেটা আমরা প্রত্যাশা করিনি। আগামীতে যখন তারা এ ধরনের কর্মসূচি করতে চাইবে আগে থেকে আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। তখন যদি তাদের মধ্যে এগ্রেসিভ লক্ষণ থাকে তখন আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
বাংলাদেশকে পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে
বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের (বিএসপিপি) আহবায়ক প্রফেসর ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন ও সদস্য সচিব সাংবাদিক কাদের গনি চৌধুরী গতকাল মঙ্গলবার এক যুক্ত বিবৃতিতে ঢাকা কোর্টে আইজীবীদের শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় পুলিশী হামলায় অর্ধশতাধিক আইনজীবী আহতের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, বিচারালয়ে আইনজীবীদের উপর এমন ন্যক্কারজনক হামলা সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না।
পেশাজীবী নেতৃদ্বয় আইনজীবীদের শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় হামলাকারি পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
বিবৃতিতে বিএসপিপি নেতৃদ্বয় বলেন, ব্যর্থ সরকারের পদত্যাগ, বিএনপি চেয়ারপারসন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মাদার অব ডেমোক্রেসি, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে প্রেরণ, এবং স্বঘোষিত দশপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিতে বিজ্ঞ আইনজীবীরা গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সামনে জড়ো হন। এরপর সরকার বিরোধী আইনজীবীদের মোর্চা ইউনাইটেড ল’ইয়ার্স ফোরামের (ইউএলএফ) উদ্যোগে পদযাত্রা শুরু হয়। ঢাকা বার ভবন থেকে আইনজীবীদের পদযাত্রা প্রধান সড়কে প্রবেশ করলে সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ সদস্যরা আইনজীবীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। নারী আইনজীবীরাও পুলিশের লাঠিপেটা থেকে রেহাই পায় নি।
পেশাজীবীদের এই দুই নেতা বলেন, সরকার দেশ থেকে আইনের শাসন নির্বাসনে দিয়ে মগের মুল্লুক কায়েম করেছে। দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষকে নিরাপত্তা দেয়া। অথচ পুলিশের হাতেই এখন মানুষের জীবন অনিরাপদ। রাষ্ট্রীয় এ বাহিনীকে ফ্যাসিস্ট সরকার দলীয় ঠেঙ্গারে বাহিনীতে পরিণত করেছে।
আমরা জানি পুলিশ বাহিনীর মূল দর্শন ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের লালন’। এই মূলমন্ত্র নিয়েই পৃথিবীতে পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছে ,যার সদস্যরা কেবল জনসাধারণের কল্যাণে নিবেদিত থাকবে। অথচ আমরা এখন দেখছি পুরো উল্টো চিত্র। পুলিশের সামনেই সরকারি দলের অস্ত্রধারীরা ঘুরে বেড়ায় পুলিশ তাদের ধরে না। আর বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের বিনা কারণে ধরে এনে হত্যা করছে। শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে গুলী করে বুক ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। আইনজীবীরাও রেহাই পাচ্ছে না। দেশে অব্যাহত গুম, খুনের সঙ্গেও আজ রাষ্ট্রীয় এ বাহিনী জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
দেশকে পুরোপুরি পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে উল্লেখ করে পেশাজীবী নেতৃদ্বয় বলেন, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে শাসক দল তার শাসন কাজ পুলিশ বাহিনীর ওপর নির্ভর করে ইচ্ছামতো স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে পরিচালনা করে। এ ধরনের রাষ্ট্রে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশে বাধা দেয়া, ভিন্ন মতাদর্শের রাজনীতি সীমিত এবং সিক্রেট পুলিশ দ্বারা বিরোধী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাংলাদেশ আজ এর ব্যতিক্রম নয়।
জার্মানির হিটলার, চিলির ফ্যাসিস্ট অগাস্টো পিনোচেটের মতো আজ শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পুলিশ ও র্যাবকে ব্যবহার করে এক ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
হিটলার জার্মানির জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে নাজি পুলিশ গঠন করেছিল, তাদের আচরণ ছিল ভয়ংকর। কেউ তার কৃতকর্ম সম্পর্কে টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারত না। বাংলাদেশেও আজ একই কায়দায় পুলিশী নির্যাতন চলছে। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা পুলিশি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ছিল। তখন দেশটির জনগণ ছিল পুরোপুরি অবরুদ্ধ। সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কথা বলা দূরে থাক, স্বাভাবিকভাবে চলাচলও করতে পারত না। তাদের অধিকার বলে কিছু ছিল না। রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা ছিল দূরাশা মাত্র। যারাই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলত, তাদের গণহারে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকানো হতো। এসবই করা হতো পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে। যা এখন বাংলাদেশে অহরহ হচ্ছে। চিলিতে ফ্যাসিস্ট অগাস্টো পিনোচেট-এর শাসনামলে রাজনৈতিক আন্দোলন করার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না।
ঠারেঠুরে যে কথা বলবে তারও কোনো সুযোগ ছিল না, বাংলাদেশ সরকার এখন সে পন্থা অবলম্বন করছে। লেখলে জেল,সমালোচনা করলে জেল, সভা-সমাবেশে বাধা, মিছিলে গুলী করে হত্যা, রাতের আঁধারে গুম-ক্রসফায়ার, ফরমায়েশি সাজা, গায়েবি মামলা,দিনের ভোট আগের রাতে সম্পন্ন করে ক্ষমতা দখল, অন্যায়ের প্রতিবাদ মানেই চৌদ্দ শিখের ভাত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার এখন হিটলার, অগাষ্টোকেও হার মানিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বর্তমান সরকারের অন্যায়, অবিচার ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারছে না। দেশের কোথাও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হচ্ছে না। কেউ প্রতিবাদ করলে হামলা, মামলা ও গুমের স্বীকার হতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনে দেশে এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ বিরাজ করছে। সরকার দেশের মানুষের বাক স্বাধীনতা রোধ করে দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছে। সুশাসনের পরিবর্তে আজ দানবীয় শাসন চলছে। দেশের মানুষ আজ এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চায়। জনগণের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে আমরাও ব্যর্থ সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধিনে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি।