চীন ও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে ঘাটতি ভারসাম্য আনছে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ
বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বর্তমানে বিপুল ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে। এ জন্য দায়ী করা হয় প্রধানত চীন ও ভারতসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশের আমদানি-রফতানিতে ভারসাম্যহীন পরিস্থিতিকে। তবে এতে খানিকটা ভারসাম্য রক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ও জামানিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর উদ্বৃত্ত বাণিজ্য। তবে সার্বিক আমদানি-রফতানিতে হতাশাজনক পরিস্থিতি অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের বড়ো অংশই পরিচালিত হয় চীন ও ভারতের আমদানি-রফতানির মাধ্যমে। তবে এই বাণিজ্যের মধ্যে বেশির ভাগই বাংলাদেশ যে পণ্য আমদানি করে তার মূল্য বাবদ প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে রফতানি করা পণ্যের পরিমাণ অনেক কম। এর ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে এক স্থায়ী ‘ঘাটতি’ কাঁধে চেপে বসে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমাদেশগুলো বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ পণ্য গ্রহণ করে তার মূল্য এই ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ করে আসছে বলে সূত্রে প্রকাশ।
বাংলাদেশের বাণিজ্য-চিত্র : বাংলাদেশকে বরাবরই সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতির মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে। সদ্য বিদায়ী (২০২২-২৩) অর্থবছরের বৈদেশিক বাণিজ্য-চিত্রে দেখা যায়, এসময় বাণিজ্য-ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৭১৫ কোটি ৫০ লাখ (১৭.১৫ বিলিয়ন) ডলার। এ সময় ৬ হাজার ৯৪৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। শতাংশের হিসাবে এই আমদানি কমেছে ১৫.৭৬ শতাংশ। আর রফতানি হয় ৫ হাজার ২৩৪ কোটি ডলারের পণ্য। শতাংশের হিসাবে রফতানি বেড়েছে ৬.২৮ শতাংশ। ফলে এতে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমাতে সহায়ক হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রফতানির তুলনায় আমদানি বেশি, বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সবধরনের পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী থাকা, আশানুরূপ রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় না আসা এবং বিদেশী বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া আশানুরূপ হারে বাড়েনি রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়। পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগ কমে গেছে, অন্যদিকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার বেড়েছে। এসব কারণে বিদেশী বাণিজ্যিক ঋণে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। গত অর্থবছরে সামগ্রিক লেনদেনে ৮২২ কোটি ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। পূর্ববর্তী অর্থবছরের এই ঘাটতি ছিল ৬৬৫ কোটি ডলার।
চীন-ভারত বনাম যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ : শীর্ষ ১০টি দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের জুন ২০১৩-এর চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৭০ হাজার ১৪৬ মিলিয়ন টাকা। আর ভারতের ঘাটতির পরিমাণ ৭৭ হাজার ১৪৩ মিলিয়ন টাকা। মোট ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৪৭ হাজার ২৮৯ মিলিয়ন টাকা। বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের শতকরা ২৩ দশমিক ৬৯ ভাগ দখলে ছিল এই দুটি দেশের।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ৭৩ হাজার ৫৬৪ মিলিয়ন টাকা। জার্মানির উদ্বৃত্ত ৬৪ হাজার ১৮৪ মিলিয়ন টাকা। যুক্তরাজ্যের উদ্বৃত্ত ৪৩ হাজার ৪৮৮ মিলিয়ন টাকা। স্পেনের উদ্বৃত্ত ৩৫ হাজার ৬৮৩ মিলিয়ন টাকা এবং ফ্রান্সের উদ্বৃত্ত ৩০ হাজার ২৬ মিলিয়ন টাকা।
এই ৫টি দেশের মোট উদ্বৃত্তের পরিমাণ ২ লাখ ৪৬ হাজার ৯৪৫ মিলিয়ন টাকা। এই দেশগুলোর দখলে ছিল বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের শতকরা ২৫ দশমিক ৭২ ভাগ। এই তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, চীন-ভারতের মোট বাণিজ্য ঘাটতির প্রায় পুরোটা সামাল দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো।
চীন-ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি : ২০২২ সালের হিসাবে দেখা যায়, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য-ঘাটতি ১৭ হাজার ৮২৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার। দেশটি থেকে আমদানি করা হয় ১৮ হাজার ৫০৯ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। রফতানি করা হয় ৬৮৩ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। এভাবে প্রতিবছর গড়ে বাংলাদেশ সঙ্গে চীনের বাণিজ্য-ঘাটতি সাড়ে ১৩শ’ কোটি মার্কিন ডলার দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সমীক্ষা সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) চীন থেকে ১৪৩৪ কোটি ডলারের আমদানি এবং রফতানি হয়েছে ৭৭ কোটি মার্কিন ডলারের। অর্থবছরে (২০২১-২২) আমদানি হয় ১৯৩৫ কোটি ডলারের পণ্য। বিপরীতে রফতানি হয়েছে ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য।
আর ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ১১ হাজার ৬৯৭ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার। আমদানির ১৩ হাজার ৬৮৯ দশমিক ৩০ মিলিয়ন ডলারের বিপরীতে দেশটিতে রফতানি করা হয় ১ হাজার ৯৯১ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন ডলার।
পণ্য ক্রয়ে শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র : সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের পণ্য ক্রয়ে বরাবরই শীর্ষে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির তুলনায় দেশটিতে রফতানি ছিল সাড়ে তিন গুণের বেশি। প্রবাসী আয়ের ১৬ শতাংশ দেশটি থেকে এসেছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ই.ইউ) বাজারই বাংলাদেশের রফতানি আয়কে বাঁচিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে অবশ্য একক বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানই শীর্ষে। পণ্য রফতানিতে অনেক দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় বাজার। মাঝে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে জার্মানি বাংলাদেশী পণ্যের শীর্ষ গন্তব্য হলেও সেটি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানির ২০ শতাংশই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে।