“খাদিজা কারাগারে, প্রশাসন কী করে?” ধ্বনিতে মুখরিত জবি
তৌকির আহমেদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরার বিনা বিচারে কারাবন্দীর এক বছর অতিবাহিত হওয়ার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা।
আজ সোমবার (২৮ ই আগষ্ট) দুপুর ১২ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর প্রাঙ্গণে অবস্থান নেন জবির সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
অনলাইনে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচারসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে ২০২০ সালের অক্টোবরে খাদিজা ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাজধানীর কলাবাগান ও নিউমার্কেট থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ।
খাদিজাতুল কুবরার নামে ২০২০ সালে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় তখন তার বয়স ১৭ বছর। অথচ, তাকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে মামলাটি করা হয় এবং সেই মামলায় আজ ৩৬৫ দিন ধরে খাদিজা কারাগারে দিনাপাত করছে।তবে তিনি যে মামলায় গ্রেফতার আছেন, সেই মামলার বিচার শুরু হয়নি এখনো।
এদিকে গত জুলাইয়ে আপিল বিভাগের এক আদেশে আগামী ১০ নভেম্বর পর্যন্ত (৪ মাস) তার জামিনসংক্রান্ত আবেদনের শুনানি স্ট্যান্ডওভার (মুলতবি) রাখা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এতে ধারণা করা হচ্ছে, এর আগে তার জামিনসংক্রান্ত আবেদন শুনানির সুযোগ নেই।
মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, “খাদিজাতুল কুবরাকে বিনা বিচারে ৩৬৫ দিন জামিন না দিয়ে কারাগারে আটক রাখা স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন। খাদিজার আটকের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে সরকার। এ ভয়ের সংস্কৃতি এতটাই প্রখর হয়েছে যে তার কারনে খাদিজার উপর চলমান অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকেরা মুখ বন্ধ করে আছে। এটা চলতে পারে না।”
তারা আরও বলেন, “খাদিজাকে যে অভিযোগের প্রেক্ষিতে মামলা দেওয়া হয়েছে তা কখনোই রাষ্ট্রদ্রোহী হতে পারে না। খাদিজা যে প্রশ্নগুলো করেছিলো সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সে প্রশ্নগুলো সকল সাধারন মানুষের মনের কথা। আমরা আজকে খাদিজার মুক্তি নিয়ে লড়াই করেছি এটা শুধু খাদিজার মুক্তির জন্য নয় এটা আমাদের সকলের মুক্তির জন্য লড়াই।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মো. মিনহাজ উদ্দিন বলেন, “আমি শিক্ষকদের প্রতিনিধি হয়ে নয়, নিজের তাড়না থেকে আজকের মানববন্ধনে উপস্থিত হয়েছি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী এভাবে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকতে পারে না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী এভাবে কারাগারে থাকতে পারে না। আমি দাবি জানাই অতি দ্রুত তাকে মুক্তি দিয়ে ক্লাসে আসার সুযোগ দিন।”
মানববন্ধনে খাদিজার সহপাঠী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তাসলিমা জাহান মুন বলেন, বাকস্বাধীনতা বলে আমাদের যে একটি সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে সেটার সুফল আমরা আজ কোথায় পাচ্ছি? আজ দেশে যদি বাকস্বাধীনতা থাকতো তাহলে আমার সহপাঠীকে বিনা বিচারে এক বছর কারাগারে থাকতে হতো না। আমরা যদি বাকস্বাধীনতার সুফল না পেয়ে থাকি তাহলে সংবিধান থেকে বাকস্বাধীনতার বিষয়টি তুলে দিতে পারেন।
মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া সোমা বলেন, “আমাদের বিশ্বিবদ্যালয়ে একটি অকার্যকর প্রশাসন আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়ার বডির কাছে আমরা গিয়েছিলাম। তারা বলেছে, খাদিজাকে নিয়ে যারা কথা বলবে, তারাও রাষ্ট্র বিরোধীতার অপরাধে দোষী হবে। যারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থী জেলে থাকলেও নির্লিপ্ত অবস্থান গ্রহন করে। এ ধরণের প্রশাসন আমাদের দরকার নেই। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, খাদিজা কি চোর, ডাকাত? সে এ বিশ্ববিদ্যালযের একজন শিক্ষার্থী। শিক্ষক হিসেবে আপনাদের কি কোন লজ্জা নেই? আপনাদের একজন শিক্ষার্থী একবছর ধরে জেলে আছে। কিন্তু আপনারা তার জন্য কিছুই করতে পারলেন না। এর চেয়ে লজ্জার কিছু হতে পারে না।”
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ইভান তাহসীব বলেন, “একটা গণতান্ত্রিক রাষ্টে প্রত্যেকটি জনগনের স্বাধীনতা আছে তার মতামত প্রকাশ করার। অনুষ্ঠানে খাদিজা সেসব বিষয়ে জানতে চেয়েছে। তা আমাদের সকল সাধারন নাগরিকের জিজ্ঞাসা।এখানে সরকার এবং রাষ্ট্রকে প্রশাসন এক করে দেখছে কিন্তু সরকার এবং রাষ্ট্র যে দুটি ভিন্ন সত্ত্বা এটা আমাদের ধারণা রাখা উচিত।”
মানববন্ধনে খাদিজার মা ফাতেমা খাতুন মোবাইল ফোনে যুক্ত হয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, “এক বছর হযে গেল খাদিজাকে আমি পাশে নিয়ে ঘুমাতে পারি না। কোন অপরাধে আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হলো? শুধু একটা অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করার জন্য এতদিন জেলে থাকতে হবে? এটা আমার জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। আজ সকলেই কিন্তু আছে আমার মেয়ে নেই। আমার মেয়েকে যেন আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হয়। সে দীর্ঘদিন ধরে কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত। আমি আমার মেয়েকে চিকিৎসা করাতেও পারলাম না। খাদিজাকে চিন্তায় আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমার এমন কোন দিন নেই, যেদিন চোখের পানি না ঝরে।”
মানববন্ধনে খাদিজার বোন সিরাজুম মনিরা উপস্থিত হয়ে বলেন, “আমার বোন কী অপরাধ করেছে, আজকে এক বছর ধরে জেলে আছে। জেলে দেখা করতে গেলে জিঙ্গেস করে, কেন আমি এতদিন কারাগারে। তখন আমাদের কাছে কোন উত্তর থাকে না। আমার বোন কেন কারাগারে? সে কী এমন অপরাধ করেছে! এতদিন তাকে বিনা বিচারে আটক রাখতে হবে। আমার বোনকে অবিলম্বে মুক্তি দিয়ে আগামী নভেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ব শরীরে উপস্থিত থেকে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।”
সেখানে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের কারও কারও হাতে ছিল পোস্টার, তাতে লেখা ‘ফ্রি খাদিজাতুল কুবরা’, `৩৬৫ দিনের অবিচারের মুক্তি হোক’ , `ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নয়,জানমাল রক্ষায় সুষ্ঠ আইন চাই’, `গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চাই,আমাদের কথা বলার স্বাধীনতা চাই’।