হাসিনার পদত্যাগ না দেখা পর্যন্ত থামব না আমরা এগিয়ে যাবো
‘হাসিনার পদত্যাগ না দেখা পর্যন্ত আমরা থামব না, আমরা এগিয়ে যাবো’। এমন ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল শুক্রবার বিকেলে বাড্ডায় গণমিছিল পূর্ব-সংক্ষিপ্ত সমাবেশে তিনি একথা বলেন। তিনি বলেন, এই গণমিছিল কেনো? একটাই দাবি.. শেখ হাসিনার পদত্যাগ…এক দফা এক দাবি…এটা জোরে বলতে হবে। এটাকে গগণবিদারি করতে হবে, এটাকে গণভবনে পৌঁছাতে হবে, এটাকে বঙ্গভবনে পৌঁছাতে হবে। এখানে সকলকে বলছি, আসুন, আমরা যে নতুন যুদ্ধ শুরু করেছি, যে নতুন লড়াই শুরু করেছি, সেই লড়াইয়ে আমাদের জয়ী হওয়ার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যাই। এই গণবিপ্লবের মধ্যে দিয়ে আবার তাদেরকে জানিয়ে দিতে চাই যে, তোমাদের দিন শেষ, পদত্যাগ করো। এসময় সরকার পদত্যাগ না করলে রাজপথেই গণবিপ্লব ঘটনানোর হুঁশিয়ারি দেন বিএনপি মহাসচিব।
রাজধানীতে বিএনপির উদ্যোগে দুইটি গণমিছিল অনুষ্ঠিত হয়। একটি মহানগর উত্তরের উদ্যোগে বাড্ডার সুবাস্তু টাওয়ার থেকে মালিবাগের আবুল হোটেল এবং অন্যটি মহানগর দক্ষিণের উদ্যোগে কমলাপুর স্টেডিয়ামের কাছ থেকে মালিবাগ রেল গেইট পর্যন্ত হয়। বিএনপি মহাসচিব বাড্ডার গণমিছিলে এবং দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস দক্ষিণের গণমিছিলে নেতৃত্বে দেন। দুটি গণমিছিলে রাজধানীর বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড থেকে হাজার হাজার নেতা-কর্মী অংশ নেয়। বিএনপি ছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ (রেজা কিবরিয়া) ও লেবার পার্টি জাতীয় প্রেস ক্লাব, ১২ দলীয় জোট বিজয় নগর, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট পুরানা পল্টন, এলডিপি তেজগাঁও এফডিসির কাছে, গণফোরাম ও পিপলস পার্টি আরামবাগ, গণঅধিকার পরিষদ (নূর) ফকিরাপুল কালভার্ট রোড এবং এনডিএম মালিবাগ থেকে গণমিছিল করে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরসহ নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে গত ১২ জুলাই থেকে বিএনপিসহ সমমনা জোটগুলো ‘এক দফা’র আন্দোলন শুরু করে। তার অংশ হিসেবে তারা ১৮ ও ১৯ জুলাই সকল মহানগর ও জেলা সদরে পদযাত্রা, ২৮ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশ এবং ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি করেছে।
সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করতে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বিএনপিসহ সমমনা জোটগুলো ১০ দফা দাবি উত্থাপন করেছিলো। টানা ৬ মাসের বেশি সময় তারা ঢাকাসহ সারাদেশে যুগপৎভাবে পদযাত্রা, গণমিছিল, সমাবেশের বিভিন্ন কর্মসূচি করেছে।
বাড্ডার সুবাস্তু টাওয়ারের সামনে গণমিছিল শুরুর আগে খোলা ট্রাকের অস্থায়ী মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিএনপি মহাসচিব বক্তব্য রাখেন। মিছিল শুরুর পূর্বে নেতা-কর্মীদের মুহুর্মুহু শ্লোগানের মধ্যে মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের নেতা (তারেক রহমান) কী বলেছেন? যদি কথা শুনে ভালো…মানে মানে শোন ভালো…পদত্যাগ করো। আর তা না হলে ফয়সালা হবে কোথায়? এই সময়ে নেতা-কর্মীরা ‘রাজপথে রাজপথে’। তিনি বলেন, আর কী বলেছেন, টেক ব্যাক বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশ যে বাংলাদেশের স্বপ্ন জিয়াউর রহমান দেখেছিলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেখেছেন। আসুন সামনে দিকে এগিয়ে যাই। এখন থামব না আমাদের লক্ষ্য অর্জন করা পর্যন্ত, আমাদের সেই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, হাসিনার পদত্যাগ না দেখা পর্যন্ত আমরা থামব না, আমরা এগিয়ে যাবো।
সংসদ, প্রশাসন, বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে দিয়েছে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, সবেচেয়ে বেশি ধ্বংস করেছেন আমাদের বিচার বিভাগকে। বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে আমাদেরকে কারাগারে পাঠায়, আটকে দেয়, সাজা দেয়। তাতে কি আন্দোলন বন্ধ করা যাচ্ছে? না, যাবে না। যত কারাগারে ঢুকাও, যতই জেলে দাও, যতই নির্যাতন করো, যতই টিয়ারগ্যাস মারো, যতই লাঠিচার্জ করো…এই বাংলাদেশের এই মানুষকে এবার তাদের গণতন্ত্রের অধিকার আদায় না করে ঘরে ফিরে যাবে না।
তিনি বলেন, এই সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। তাই পদত্যাগ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে, নতুন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। এবার আমাদের লড়াই জীবনপণ লড়াই। আসুন কোনো ভয়-ভীতি, জেল-জুলুম-কারাগার আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না।
নির্বাচন নির্বাচন খেলা খেলতে দেয়া হবে না মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, এই নির্বাচন কমিশন, লজ্জাহীন এরা। তাদের অধীনে কী নির্বাচনে যাবে? দুইটা দলকে রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে, নিবন্ধন দিয়েছে কেউ চিনে না। আপনারা কেউ চিনেন, চিনেন? এই সময়ে নেতা-কর্মীরা ‘ভুঁয়া, ভুঁয়া’ বলে শ্লোগান দিতে থাকে। তিনি বলেন, কেনো (দুইটা দলকে নিবন্ধন) দিয়েছে? যে এদেরকে দিয়ে তারা একটা নির্বাচন নির্বাচন খেলা করবে …তাই না। এই খেলা এবার খেলতে দেয়া হবে না, সেই খেলা খেলতে দেয়া হবে না। এরা (সরকার) মনে করেছে এভাবে ক্যারিকাচা করে, ডিগবাজী খেয়ে খেয়ে ‘১৪ ও ‘১৮‘র মতো যে নির্বাচন করেছেন আবার ওই নির্বাচন করে আবারও ক্ষমতায় যাবে। দেশের মানুষ কী যেতে দেবে? আর যেতে দেবে না।
মির্জা ফখরুল বলেন, দেশের মানুষ এখন একতাবদ্ধ হয়েছে। দেশে ছাত্র-যুবক-কৃষক-শ্রমিক, পেশাজীবী, সমস্ত রাজনৈতিক দল, সমস্ত রাজনৈতিক সংগঠন, সকল দেশপ্রেমিক মানুষের এখন একটাই আওয়াজ, এই অবৈধ, ফ্যাসিবাদী একনায়ক শেখ হাসিনা সরকার নিপাত যাক। এই দেশের ১৮ কোটি মানুষ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ তাদের অধিকার রক্ষা জন্য একাত্তর সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের যে চেতনা তা বাস্তবায়নের জন্য, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ঘোষণার মধ্যে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি, যে গণতন্ত্র পেয়েছি তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য এবার আমাদের লড়াই জীবনপণ লড়াই। ভয়ভীতি-জেল-জুলুম-কারাগার আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। ইনশাল্লাহ আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে এই ভয়াবহ দানব যারা আমাদের সব অর্জন শেষ করে দিচ্ছে তাদেরকে পরাজিত করে জনগণের সরকার গঠন করতে সক্ষম হবো।
৩১ দফায় নতুন রাষ্ট্রের চিন্তা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা সরকার পদত্যাগের এক দফা দিয়েছি। আমরা ৩১ দফা দিয়েছি। যেখানে আমরা একটা নতুন রাষ্ট্র তৈরি করব, যেখানে আমরা মানুষ যেন সম্মানের সঙ্গে ইজ্জতের সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করব। সবাই দুই বেলা খেতে পারে তার ব্যবস্থা করব, আমার যুবক ছেলেরা যাতে চাকুরি পায় তার ব্যবস্থা করব, সবাই যেন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে তার ব্যবস্থা করব। মিছিল শেষে সরকার পতনের এক দফা দাবি আদায়ে আগামী দুদিনের মধ্যে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মহানগর উত্তর : বাড্ডার সুবাস্তু টাওয়ারের সামনে মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব আমিনুল হকের সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। বাড্ডা থেকে মালিবাগ আবুল হোটেল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪ কিলোমিটারের এই পথে নেতা-কর্মীরা ব্যানার- ফেষ্টুন-প্ল্যাকার্ড হাতে সরকার বিরোধী শ্লোগান দেয়। বিকেল ৪টায় গণমিছিলটি শুরু হয়ে আবুল হোটেলের কাছে শেষ হয় বিকাল সাড়ে ৫টায়। এই গণমিছিলে বিএনপি মহাসচিব, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ দলের ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, কেন্দ্রীয় নেতা জয়নুল আবেদিন ফারুক, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, আতাউর রহমান ঢালী, শাহাজাদা সম্রাট, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, শ্যামা ওবায়েদ, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, এবিএম মোশাররফ হোসেন, আজিজুল বারী হেলাল, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, রাকিবুল ইসলাম বকুল, নাজিম উদ্দিন আলম, তাবিথ আউয়াল প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। পরে কেন্দ্রীয় নেতারা মিছিলে অংশ নেন।
মহানগর দক্ষিন : কমলাপুরে বীর শ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের সামনে মহানগর দক্ষিনের আহ্বায়ক আবদুস সালামের সভাপতিত্বে ও ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনের সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বক্তব্য রাখেন।
এখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা আব্বাস বলেন, এদেশের নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না হবে না, হতে দেয়া হবে না…এটা আমাদের সাফ কথা। সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে জনগন মাঠে সোচ্চার হয়েছে উল্লেখ করে রাজপথেই ওদের পতন ঘটানোর প্রত্যায় ব্যক্ত করেন তিনি। সাবেক এ মেয়র বলেন, সরকারের নির্দেশে তড়িঘড়ি করে তফসিল ঘোষণার চেষ্টা করছে নির্বাচন কমিশন। এ কমিশন অবৈধ সরকারের তৈরি ফরমায়েশি নির্বাচন কমিশন। তারা অবৈধ, তাদের তফসিল মানা হবে না। সেটাও অবৈধ হবে। মির্জা আব্বাস বলেন, বর্তমান অবৈধ সরকার আমাদের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকারও কেড়ে নিয়েছে। পেটোয়া পুলিশ বাহিনী দিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানি করছে। তারা সরাসরি গুলি করছে। এ স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে হবে।
এ সময় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, এ ফ্যাসিবাদীদের যতদিন ক্ষমতায় রাখা হবে, দেশের ততই ক্ষতি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এদের বিদায় করতে হবে। এখন আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে সরকার পতনের করার চেষ্টা করছি। তবে, কেউ অশান্তি করলে আমরা তার দাঁতভাঙা জবাব দেবো।
আবদুল মঈন খান বলেন, বর্তমান সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এরপর নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে বাংলাদেশে নির্বাচন হবে।
সমাবেশ শেষে গণমিছিলটি মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সবুজবাগ, খিলগাঁও সড়ক দিয়ে মালিবাগ রেল গেইটের সামনে এসে শেষ হয় বিকাল সাড়ে ৬টায়। এই মিছিলে মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ দলের ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, জয়নাল আবেদীন, আহমেদ আজম খান, এজেডএম জাহিদ হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য মনিরুল হক চৌধুরী, ফজলুর রহমান, জয়নাল আবেদিন ভিপি জয়নাল, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, কেন্দ্রীয় নেতা আসাদুজ্জামান রিপন, ফজলুল হক মিলন, নাসির উদ্দিন অসীম, শিরিন সুলতানা, মীর সরফত আলী সপু, ইশরাক হোসেনসহ কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেন।