হাঁসফাঁস অবস্থা কাটেনি আওয়ামী লীগের
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগের ওপর বিদেশিদের যে চাপ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার সফরের মধ্য দিয়ে তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি দলটি। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, সফরে উজরা জেয়া যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান ব্যক্ত করেছেন সেটাকে আওয়ামী লীগের দুশ্চিন্তা কেটে গেছে বলা যাবে না।
আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নও তৎপর। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি একাধিকবার বাংলাদেশ সফর করছেন। তারা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেন, আগামী নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে সে সম্পর্কে জানতে চান।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে। এরপর দেশটির উচ্চপর্যায়ের কোনো প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করল। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বেসামরিক নিরাপত্তাবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরার নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলটি ভারত ঘুরে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশে আসে। গতকাল শুক্রবার উজরা জেয়া সফর শেষ করে ফিরে গেছেন। বৃহস্পতিবার দিনভর তার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প বাণিজ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। উজরা জেয়ার সঙ্গে ছিলেন গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফর করে যাওয়া মার্কিন সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ঢাকায় এসে বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা করলেও আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারকে দুশ্চিন্তামুক্ত করবে এমন আভাস মেলেনি।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যা করার তার সবই করবে জানিয়ে উজরা জেয়া যে অবস্থান ব্যক্ত করেছেন, তা দুশ্চিন্তামুক্ত করার মতো কোনো অবস্থান নয় বলে জানান কূটনীতিক তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা।
জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে কোনো কথা বলতে চাননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘এ ইস্যু নিয়ে কোনো কথা বলব না। আমার আরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে।’
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলেন, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক করার পর উজরা জেয়া নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক জটিলতা নিরসনে যুক্তরাষ্ট্র সংলাপ সমর্থন করে বলে যে অবস্থান জানিয়েছেন সেটাও ইতিবাচক নয়। কারণ বিএনপি সংবিধান ও আইনবহির্ভূত দাবি করছে। বেআইনি দাবি নিয়ে সংলাপ কীভাবে হবে।
দলের আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ি কমিটির সভাপতি ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপিকে আগে সংলাপে বসতে হবে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে। তারপর দ্বিতীয় ধাপ। তিনি বলেন, ‘কোনো দল অরাজনৈতিক আচরণ, অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক দাবি করলে সেখানে সংলাপ বা আলোচনা হওয়ার সুযোগ কই।’
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ‘নির্বাচন ইস্যুতে বিদেশি অবস্থান নিয়ে আমাদের নিশ্চিন্ত হওয়ার মতো কোনো অগ্রগতি এখনো হয়নি। তবে অগ্রগতি হবে এমন প্রত্যাশা আছে আমাদের।’ তিনি বলেন, ‘উজরা জেয়ার সফরের মধ্য দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বদলে গেছে, বিএনপির জন্য সুবিধা হয়েছে তেমন কিছুও নয়।’
দলটির সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ‘ব্যাড ইনটেনশন’ (খারাপ উদ্দেশ্য) বাস্তবায়নে বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে মূলত কাজ করছে। তাদের ইনটেনশন কাউকে ক্ষমতায় বসানো নয়, তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে দেখতে চায় না। তাদের এ অবস্থান আমরা ধরতে সক্ষম হয়েছি।” তিনি বলেন, দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা সর্বশেষ কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় দলের সবাইকে বিষয়টি জানিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের এ নেতা বলেন, “এমন ‘ব্যাড ইনটেনশন’ নিয়ে কেউ বসে থাকলে, কাজ করলে সরকারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তন করানো অনেকটাই অসম্ভব ব্যাপার। ফলে তাদের চাপ মোকাবিলা করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ।” তিনি আরও বলেন, গত বুধবার বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেট থেকে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচন হবে বলে যে এক দফা ঘোষণা করা হয়েছে, তার মূল কারণ ঢাকায় উপস্থিত বিদেশি বন্ধুদের জানিয়ে দেওয়া যে, আওয়ামী লীগের অবস্থান নির্বাচনকালে সরকারে থাকা।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, ‘দেশের মানুষ ও আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের চাওয়া সংবিধানসম্মতভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। বড় সমাবেশ করে সমবেত কণ্ঠে আওয়াজ তুলে আওয়ামী লীগও জানিয়ে দিয়েছে জনগণ তাদের সঙ্গে রয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচন শুধু তাদের নয়, জনগণেরও দাবি।’ তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান থেকে সরাতে সরকার আরও কিছু কৌশলে এগোবে। সফল না হলে যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে বিকল্প শক্তির সঙ্গে মিলে নির্বাচন তুলে ফেলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। ক্ষমতাসীন দলের প্রবীণ আরেক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আপস করে নয়, দলীয় শক্তি দিয়ে নির্বাচন করার পরিকল্পনা আরও পোক্ত করবে দলটি।