Home কৃষি ও প্রকৃতি কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পে ১০ অনিয়ম
জুন ২৫, ২০২৩

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পে ১০ অনিয়ম

একই ধরনের যন্ত্র বিভিন্ন দামে (অতিরিক্ত) ক্রয়, যোগ্য ঠিকাদারকে বাদ দেওয়া, প্রকৃত কৃষক নির্বাচন না করাসহ ১০ অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পে এসব অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে সরকারি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।

অডিটে উঠে আসা অন্য আপত্তি দেওয়া অনিয়মগুলো হলো-ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) নির্দেশনা না মানা, কারিগরি কমিটির নির্দেশনা অমান্য করে বেশি দরে যন্ত্রপাতি কেনা এবং নতুন আসবাবপত্র মেরামত দেখিয়ে অর্থ ব্যয় করা। এছাড়া আরও আছে-বাজার দর যাচাই না করে উচ্চ দরে যন্ত্র কেনা, নিম্ন শক্তির যন্ত্র সরবরাহ করা হলেও জরিমানা না করে অনিয়মিতভাবে বিল পরিশোধ, কৃষকদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ আদায় এবং বাৎসসিক সীমার অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, আমার আগে যিনি পিডি (প্রকল্প পরিচালক) ছিলেন এগুলোর বেশিরভাগই তার সময়কার দেওয়া অডিট আপত্তি। তিনি হয়তো এগুলো খেয়াল করেননি। কিন্তু আমি দায়িত্বে আসার পর এগুলো নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখা দেওয়া হয়েছে। এতে দেখা যায় যারা অডিট করেছেন তাদের কিছু ভুল আছে। আমরা অনেক সময় ডিপিপিতে অবলিক (অথবা) দেওয়া অপশন ব্যবহার করেছি। সেটি তারা বুঝতে পারেননি। তাদের কাছে যা মনে হয়েছে সেভাবেই অডিট করেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের মেজর কোনো ফল্ট আছে বলে মনে করি না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, এই মুহূর্তে এগুলোকে অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছে সেটি বলা যায় না। কেননা প্রকল্প অফিসের জবাবে যদি অডিট অফিস সন্তুষ্ট না হয় তখন বলা যাবে। তবে এখানে যেটি দাঁড়ায় সেটি হলো ক্রয় প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং অনিয়মের ঝুঁকি আছে। আইএমইডি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে এটা ভালো। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসাবে তাদেরও একটি মূল্যায়ন দেওয়া দরকার ছিল। সেটি না করে শুধু অডিটের বিষয়গুলো তুলে ধরে পাশ কাটিয়ে যাওয়াও একটি বড় প্রশ্ন।

আইএমইডির প্রতিবেদনে অডিট আপত্তির বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয় পিপিআর-২০০৮ (সরকারি ক্রয় আইন) এর শর্ত পরিপালন না করে আরএফকিউ (কোটেশনের মাধ্যমে পণ্য সংগ্রহ) পদ্ধতিতে বাৎসরিক সীমার অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ২৭টি বিলের মাধ্যমে ৭৫ লাখ ৫৭ হাজার ২০ টাকা সিলিং সীমার অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়। এছাড়া বাজার দর যাচাই না করে ডিপিপিতে অস্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণ করায় দুই কোটি ৭৯ লাখ ২৪ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে ডিপিপিতে একটির বঁটির দাম ১০ হাজার টাকা, এয়ারকুলারের মূল্য সাড়ে ৭ লাখ টাকা, একটি চেয়ারের মূল্য ৫০ হাজার টাকা, মসলার বাটির দাম ২ হাজার টাকা ইত্যাদি ধরা হয়েছে। ফলে এই আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়া কম্বাইন্ড হারভেস্টার সরবরাহের ক্ষেত্রে কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত নয় লাখ ৫০ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী কৃষকদের কাছে ভর্তুকি মূল্যে ১৮৮টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার সরবরাহ বাবদ সরকার সমতল এলাকার জন্য ৫০ শতাংশ এবং হাওর এলাকার জন্য ৭০ শতাংশ দেবে। মোট দামের বাকি সমতলের জন্য ৫০ শতাংশ এবং হাওড়ের জন্য ৩০ শতাংশ কৃষকেরা পরিশোধ করবে। কিন্তু এ নিয়ম না মেনে কৃষকদের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করা হয়েছে।

আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন যুগান্তর বলেন, প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত হলে আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেব। সেই সঙ্গে সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় কি না সেটিও মনিটরিং করা হবে। অডিট আপত্তি বিষয়ে জানতে চাইলে থার্ডপাটি ডিটিসিএলের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি যুগান্তরকে বলেন এ বিষয়ে আমাদের কথা বলা নিষেধ আছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন আরও বলা হয়েছে, বাজার দর যাচাই না করে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে (২৫৭ শতাংশ) রিপার মেশিন কেনা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এজন্য সরকারের ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ ১০ হাজার টাকা। এছাড়া জেনারেল ফাইন্যান্সিয়াল রুলস (জিএফআর) বিধিমালা লঙ্ঘন করে সম্পূর্ণ নতুন ক্রয় করা আসবাবপত্র মেরামত দেখিয়ে চার লাখ টাকা তুলে নেওয়ায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, এক্সপানশন অব ইন্টারেস্টের (ইওআই) শর্ত লঙ্ঘন করে নিম্ন শক্তি সম্পন্ন হারভেস্টার সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এর পরও সরবরাহকারীকে অনিয়মিতভাবে পরিশোধ করা হয়েছে চার কোটি ছয় লাখ ৬০ হাজার টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে পিপিআর-২০০৮ লঙ্ঘন করে একই মডেলের চারার বেড তৈরি যন্ত্র পরবর্তীতে অতিরিক্ত দামে কেনা হয়েছে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২০ লাখ ১০হাজার টাকা। অনাবাসিক ভবন নির্মাণে ড্রইং, ডিজাইন, টপোগ্রাফি সার্ভে, মাস্টারপ্ল্যান তৈরি এবং ফুলটাইম সুপারভিশনের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব কাজ করতে শহিদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লি. এর সঙ্গে ২০২১ সালের ১৯ জুলাই তখনকার প্রকল্প পরিচালক বেনজীর আলম চুক্তি সম্পাদন করেন। এ সময় ডিপিপিতে স্থানীয় পরামর্শকের জন্য সংস্থার ছিল এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা। কিন্তু চুক্তি করা হয়েছে চার কোটি সাত লাখ টাকা। এতে অতিরিক্ত চুক্তি করা হয় দুই কোটি ৬৩ লাখ টাকা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির (টিইসি) রেসপন্সিভ সরবরাহকারীকে নন-রেসপন্সিভ দেখিয়ে চারার বেড তৈরির যন্ত্র সরবরাহ নেওয়া হয়। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এক কোটি নয় লাখ ৮০ হাজার টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে কাজ সমাপ্ত করতে পারেনি। এতে ওই প্রতিষ্ঠানকে এলডি (জরিমানা) আরোপ না করে বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে সরকারে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪৭ লাখ ৯৮ হাজার ৭০০ টাকা। পারস্পরিক যোগসাজশে যোগ্য সরবরাহকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয় এবং পরামর্শক নিয়োগের আগেই প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরু বাবদ অনিয়মিত বিল পরিশোধ করা হয়েছে। কারিগরি কমিটির নির্ধারিত দরের পরিবর্তে সরবরাহকারীর দেওয়া দরে কৃষি যন্ত্রের মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে কৃষকেরা ভর্তুকির টাকা থেকে বঞ্চিত হয়েছে আর লাভবান হয়েছে ঠিকাদার। সূত্র জানায়, ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুন মেয়াদে এটি বাস্তবায়ন করছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৪৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত বছরের জুন মাস পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৯৮৪ কোটি টাকা।

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *