Home বানিজ্য টাকা ছাপিয়ে ঘাটতি মেটালে সংকট আরও ভয়াবহ হবে
জুন ১৯, ২০২৩

টাকা ছাপিয়ে ঘাটতি মেটালে সংকট আরও ভয়াবহ হবে

প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাতীয় বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মেটানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে যে অবস্থা চলছে, তাতে এখান থেকে টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে একমাত্র পথ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাপানো। আর এ পরিস্থিতিতে টাকা ছাপালে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে।  রোববার রাজধানীর স্থানীয় একটি হোটেলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত বাজেট সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন।

তাদের মতে, ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ যেভাবে বাড়ছে, তাতে সত্যিকারের ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা অসম্ভব। এ অবস্থায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। এছাড়া জবাবদিহিতা ছাড়া সুষ্ঠুভাবে বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন।

সিপিডি বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এ সময় বক্তারা বলেন, চলমান সংকট সমাধানে বাজেটে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেই। এ ছাড়া এজেন্টের মাধ্যমে কর আদায়ের সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেন তারা।

অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় পার্টি নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সভাপতি মো. সামীর সাত্তার, কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম, ইংরেজি দৈনিক ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, মেজর জেনারেল (অব.) আমছা আমিন, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) সভাপতি আনিস-উদ-দৌলা, গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র পরিচালক আরশাদ জামাল দীপু, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল এবং বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপতি তাসলিমা আক্তার লিমা। তাদের মতে, করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করা উচিত।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা অত্যন্ত কম। বাংলাদেশের মতো দেশে এই বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত।

তিনি বলেন, এবারের বাজেটে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঘাটতি রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করা হবে। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের যে অবস্থা, তাতে এখান থেকে টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে একমাত্র পথ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাপানো। কিন্তু এভাবে টাকা ছাপানো হলে, বর্তমানে অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। বাড়বে মূল্যস্ফীতি।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সোমালিয়া এবং রাশিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ এভাবে মুদ্রা ছাপিয়ে চরম মূল্য দিয়েছে। তিনি বলেন, দেশের আর্থিক খাতে আস্থার সংকট চলছে। ব্যাংকিং খাতের পাশাপাশি শেয়ারবাজারও ভালো নেই। ফ্লোর প্রাইসের (নিুসীমা) কারণে আটকে আছে বাজার।

রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বাজেটে শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ানো হয়েছে। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। ইউনেস্কো বলে, বাংলাদেশে শিক্ষার ব্যয় ৭০ শতাংশই অভিভাবকদের পকেট থেকে দিতে হয়। তিনি বলেন, নতুন আয়কর আইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এনজিওকে লাভজনক কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিষয়টি দেখে আমরা হতভম্ব।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাজস্ব সংগ্রহে মরিয়া সরকার। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কোম্পানি হিসাবে বিবেচনা গ্রহণযোগ্য নয়। নির্বাচনি বছরে একটি রাজনৈতিক সরকারের এ রকম বাজেটীয় পদক্ষেপ হতে পারে না। তিনি বলেন, এটি কোনো রাজনীতির ভেতরে পড়ে না। কীভাবে সরকারি ও বিরোধী দল মিলে এটাকে অনুমোদন দিল আমার বুঝে আসে না। এটি অবৈজ্ঞানিক, অবাস্তব এবং আমলাতান্ত্রিক পদক্ষেপ।

তার মতে, এখনো বিষয়টি একটি খসড়া। এখনো পরিবর্তনের সুযোগ আছে। আমরা আশা করছি, সরকার এটি পরিবর্তন করবে।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেটের অন্যতম চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এখানে মুদ্রার বিনিময় হার ও সুদের হারের মধ্যে সমন্বয় রাখতে হবে। তিনি বলেন, মধ্যমেয়াদি অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তন জরুরি। শামসুল হক জাহিদ বলেন, শেয়ারবাজারের ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হলে বাজারে বিপর্যয় হবে। তিনি বলেন, এখানে সরকারি কোম্পানি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা আটকে আছে।

মো. সামীর সাত্তার বলেন, সরকার রাজস্ব আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ে কর কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। তিনি বলেন, চলতি বছরে বিনিয়োগ বাড়বে না। ফলে এটি রক্ষণশীল বিনিয়োগের বছর। কিন্তু মূল্যস্ফীতি বাড়বে। আর সরকার ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নিলে ব্যবসায়ীদের ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা কমবে। এবারের বাজেটে সরকার করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। তার মতে, বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে এটি আরও বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করা উচিত।

ড. শামসুল আলম বলেন, বর্তমানে ৮০ শতাংশ মানুষ আর্থিক সংকটে রয়েছে। এখান থেকে উত্তরণ জরুরি। তার মতে, শহরে ও গ্রামে বিদ্যুতের সংকট চলছে। আর এই সংকট কাটাতে না পারলে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে। তিনি বলেন, বিদ্যুতের উচ্চমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর সুবিধা সাধারণ মানুষ পায় না।

আশরাদ জামাল দীপু বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বর্তমানে বিদ্যুতের দাম অনেক বেশি। এরপরও বিদ্যুৎ মিলছে না। এ অবস্থায় সত্যিকারের ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা কঠিন। তিনি বলেন, প্রতিবছর গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। এরপরও নির্বাচন সামনে রেখে সরকার পোশাক খাতে অস্বাভাবিকভাবে মজুরি বৃদ্ধির উদ্যোগ নিলে তা এ খাতের জন্য কঠিন হবে। অন্য ব্যবসায়ীরা বলেন, বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম মন্দা চলছে। বেসরকারি বিনিয়োগ একেবারেই নেই। ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় যারা প্রকৃত ব্যবসা করেন, তাদের টিকে থাকা দিন দিন অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, বাজেট সামনে রেখে আয়কর আইন পাশ করা হয়েছে। তড়িঘড়ি করে পাশ করা হলো এই আইন। তার মতে, আইনটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মানুষ অনেকটা অন্ধকারে রেখেই এটি পাশ করা হলো।

তাবিথ আউয়াল বলেন, দেশে দুঃশাসন চলছে। আর এর প্রভাব সব খাতে পড়ছে। তিনি বলেন, সরকারি ব্যয়ের সঙ্গে তিনটি বিষয় জড়িত থাকে। এগুলো হলো-অদক্ষতা, অপচয় এবং দুর্নীতি। এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবহিদিতার ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে আইএমএফের চাপে বিভিন্ন সংস্কার করা হচ্ছে। কিন্তু এই সংস্কারগুলোর কথা বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছেন। কিন্তু সরকার আগে তা আমলে নেয়নি।

তাসলিমা আক্তার লিমা বলেন, বাজেট বাস্তবায়নের সঙ্গে গণতন্ত্র ও ভোট অধিকারের বিষয়টি জড়িত। আন্তর্জাতিকভাবেও এসব বিষয় সামনে আসছে। তার মতে, বর্তমান বাস্তবতায় ভর্তুকি বাড়ানো উচিত। কিন্তু যৌক্তিকীকরণের নামে তা আরও কমানো হয়েছে। এছাড়া সরকার সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেয়, সেখানে গার্মেন্ট শ্রমিকদের রাখা হয় না। এটি বিবেচনা করা উচিত। মেজর জেনারেল (অব.) আমছা আমিন বলেন, দেশে লুটের অর্থনীতি নয়, লুটের রাজনীতিও চলছে। এটি বন্ধ করে জবাবহিদিতা নিশ্চিত করতে হবে।

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *