বিদেশি চাপে আ.লীগ-বিএনপির দূরত্ব কতটা কমেছে
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রভাবশালী দেশগুলোর নানামুখী চাপে সংলাপের সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে অনেকের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে এলেও দেশের বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখনো বিপরীতমুখী অবস্থানে। নির্বাচনকালীন সরকার, দলগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ছাড় না দেওয়া এবং কর্মসূচি পালনে বাধাসহ নানা ইস্যুতে সংকট তৈরি হয়েছে; যা সমাধানে নেই তেমন আশার আলো। কিন্তু বিদেশি চাপের পর বড় দুই দলের দূরত্ব আরও বেড়েছে।
ভিসানীতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে ব্যস্ত তারা। এমন পরিস্থিতিতে সব দলের অংশগ্রহণে নির্দিষ্ট সময়ে গ্রহণযোগ্য ভোট হবে কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নানা শঙ্কা। সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে ‘যথাসময়েই নির্বাচন হবে’-সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিদের এমন বক্তব্য এ আশঙ্কাকে আরও উসকে দিচ্ছে। অলিগলির চায়ের দোকান, সরকারি অফিস কিংবা নানা আড্ডায় এখন আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দুই আগামী নির্বাচন। সংবিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে কী হতে পারে, সেই আলোচনাও চলছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থানের সুযোগ কাজে লাগাতে মরিয়া প্রভাবশালী দেশগুলো। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের কথা বলে তারা নানাভাবে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের মতো করে হাজির করছেন নানা ফর্মুলা। কিন্তু এদেশের জনগণের চাওয়াপাওয়া বিবেচনায় তারা এসব করছে কি না, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে।
তারা মনে করেন, ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে প্রভাবশালী দেশগুলো তাদের লক্ষ্য পূরণে ব্যস্ত। সাধারণ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে কোনো কোনো দেশ আমাদের রাজনীতির অন্দরমহলে ঢুকে পড়ছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে নিচ্ছে নানা পদক্ষেপ। তাদের কর্মকাণ্ডে দেশের কোনো কোনো দল হয়তো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ওইসব দেশ তাদের নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কিছুই করে না। তাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে প্রভাবশালী দেশগুলোর ভূমিকাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। আমাদের রাজনীতিতে তারা যেন ‘মুরুব্বির’ ভূমিকায় আসতে না পারে। এজন্য রাজনৈতিক দলসহ দেশের মানুষের ঐক্যের বিকল্প নেই। নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সংকট সমাধানে নিজেদের উদ্যোগ নিতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে সবকিছুর সমাধান। বিদেশিদের হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হবে।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। তা না হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা দুরাশায় পরিণত হবে। বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোয় সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। এ অবস্থায় নির্বাচন হলে ভোটের মাঠ সমতল না হয়ে খাড়া হয়ে যাবে। তাই নির্বাচনি মাঠ সমতলের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতা।
তিনি বলেন, আমাদের নির্বাচন নিয়ে বিদেশি শক্তি জড়িত হয়ে পড়ছে। এ কারণে জটিলতা আরও বাড়বে। এসব দেশ আমাদের জনগণের চাওয়াপাওয়ার স্বার্থেই সবকিছু করবে-এমনটা বলা যায় না। তাই আমরা আশা করি, দেশের স্বার্থে এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের কথা চিন্তা করে রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনা করে সংকটের সমাধান করবে। রাজনীতি হচ্ছে একটা প্রক্রিয়া। ছাড় দিয়ে, আলোচনা করে সংকটের সমাধানই হলো রাজনীতি। তা না হলে সেটা হবে অপরাজনীতি। কথা বলব না, ছাড় দেব না; আমি যেভাবে বলব, সেভাবেই হবে-এভাবে রাজনীতি হয় না।
বদিউল আলম বলেন, সংকট সমাধানে দুই দলের ভূমিকা এখনো ইতিবাচক নয়। তবে সময় আছে। মুসলমানরা তো মৃত্যুর আগেও তওবা করে। বিগত ওয়ান-ইলেভেনের পর রাজনৈতিক দলের নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন-আর এ রকম করব না। ঘটনার পর বোধোদয় হয়েছিল। কিন্তু এখন তো দেখছি সবকিছু সেই আগের মতোই। আশা করি, তাদের ফের বোধোদয় হবে।
তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়ে হবে কি না, তা নিয়ে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন। কেউ বলতে পারছে না কী হবে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। রাজনৈতিক নেতৃত্বের শুভবুদ্ধি, দেশপ্রেম এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের প্রতি তাদের যে শ্রদ্ধাবোধ, সেটার ওপর নির্ভর করছে আগামী নির্বাচন যথাসময়ে হবে কি না। নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের যে শঙ্কা, সেটা রাজনীতিবিদদেরই দূর করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, বিদেশি কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নানা চাপ সত্ত্বেও সরকার সংবিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। সেই নির্বাচনে কোন দল আসবে কি না কিংবা সেটা কতটা অংশগ্রহণমূলক হবে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীনরা ততটা ভাবছে না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আরেকটি নির্বাচন করে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে রাখার চেষ্টা করবে। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো এবার অতীতের মতো যেনতেন নির্বাচন হতে দেবে না। সেই নির্বাচন প্রতিহতের চেষ্টা চালাবে। এমনটা হলে দেশে ভয়াবহ সংঘাতের শঙ্কা রয়েছে। তৈরি হতে পারে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতিও। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তৃতীয় কোনো শক্তি তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারে। পরিস্থিতি সেদিকে গেলে দেশের মানুষকে কড়া মাশুল দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোও এ থেকে রেহাই পাবে না। তাই এখনো সময় আছে দেশ ও জনগণের কথা ভেবে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি প্রবীণ রাজনীতিবিদ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম যুগান্তরকে বলেন, প্রকৃত অর্থে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো দূরত্ব নেই। দুটিই লুটপাটকারী দল। লুটপাটের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। কারণ, তারা রাজনৈতিক নিয়ম মেনে প্রতিযোগিতা করে না। যেনতেন উপায়ে তারা ক্ষমতায় থাকতে চায়, যেতে চায়। কারণ ক্ষমতা তাদের কাছে লুটপাটের একটা পথ। তাদের এ দ্বন্দ্বের পরিণতি দেশের সর্বনাশ হবে। সাধারণ মানুষ আরও বেশি সংকটে নিপতিত হবে।
বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, মেলায় গেলে দেখা যায় ভলুকের নাচ হয়। মানুষকে এ নাচে ব্যস্ত রেখে পকেট কেটে নিয়ে যায়। যে বিষয়গুলো নিয়ে জনগণের আসল মাথাব্যথা, সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে বিদেশিরা নানা খেলায় ব্যস্ত। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কেউ গণতন্ত্র মানে না। তারা নির্বাচনের নামে ছলচাতুরী করে ক্ষমতায় যেতে ব্যস্ত। বিদেশি শক্তিগুলো তাদের নাচিয়ে সেই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে।
সেলিম বলেন, দেশের রাজনৈতিক সংকটের পেছনেও বিদেশি শক্তি রয়েছে। তাদের সৃষ্ট সংকট ও রুগ্ণতার অজুহাত দেখিয়ে তারা আরও বেশি করে আমাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে। দেশের মানুষের চাওয়াপাওয়া তাদের কাছে গৌণ।
তিনি বলেন, দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে এ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। দেশের জনগণকে চিরদিন পদানত করে রাখা যাবে না। সময়ের ব্যাপার মাত্র। এজন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে একটা বিকল্প শক্তিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে হবে। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালনা করবে।
প্রবীণ এ রাজনীতিবিদের মতে, আগামী নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার কিছু নেই, অনিশ্চয়তা চলছে। বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন না হলে এ অনিশ্চয়তা আরও বাড়বে। প্রতিটি মানুষ বিশ্বাস করে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করার সুযোগ নেই। তাই এ সরকারকে অবসান করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ভোটের নামে প্রহসন বহুলাংশে কমে যাবে।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য থেকে ধরে নেওয়া যায় আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আগামী নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কা থাকলেও আমি মনে করি, নির্দিষ্ট সময়ে ভোট হবে। না হওয়ার কোনো কারণ নেই। নির্বাচন কমিশন নির্দিষ্ট সময়ে তফশিল ঘোষণা করবে। এখন প্রশ্ন হলো-ওই নির্বাচনে কতটা রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করবে। বিএনপিসহ অনেক দলের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা ক্ষীণ। সেক্ষেত্রে সীমিত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।’
তিনি বলেন, বিদেশি চাপ থাকলেও নির্বাচন হবে। অতীতের মতো হয়তো আরেকটি নির্বাচন হবে। তবে একটা কারণে সরকার হয়তো নির্বাচন করতে পারবে না। যদি রিজার্ভের ঘাটতির কারণে তেল, কয়লা আমদানি করতে না পারে, শ্রীলংকার মতো যদি পেট্রোল পাম্পে প্রতিদিন লাইন ধরতে হয়, তখন হয়তো সরকার নির্বাচন থেকে সরে আসবে। এছাড়া সরকার নির্বাচন করে ফেলবে। সেখানে কে গেল না গেল, তাতে কিছু আসে যায় না। ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন করেও সরকার চলেছে। এবারও না হয় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোট করবে।