Home শিক্ষা-ক্যাম্পাস মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়
জুন ২, ২০২৩

মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের যে কোনো উন্নয়ন টেকসই করতে প্রয়োজন টেকসই শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ, সব উন্নয়নের মূলে রয়েছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জ্ঞান। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জ্ঞান না থাকলে দেশটিকে অন্য দেশের জ্ঞানীদের কাছে ধরনা দিতে হবে। আমরা সবাই জানি, শিক্ষা হলো জাতির মেরুদণ্ড। সেই মেরুদণ্ড যদি দুর্বল হয়, তাহলে দেশ ও জাতি কখনো সবল হবে না। আর সে দেশের উন্নয়নও টেকসই হবে না। সুতরাং উন্নয়ন টেকসই করতে টেকসই শিক্ষাব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যেতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ বিদেশি শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। তারা তাদের শিক্ষা ও কর্মদক্ষতা অনুসারে বেতন পেয়ে থাকেন। পত্রিকায় প্রকাশ, কর্মরত শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ২ লাখ টাকা!

এসব বিদেশি শ্রমিক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনেক যোগ্য ও দক্ষ। এসব শ্রমিক বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মী হিসাবে নিয়োজিত আছেন বছরের পর বছর। দেশের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র প্রভৃতি নানা মেগা প্রকল্পে নিয়োগ পাওয়া জনশক্তির অধিকাংশই বিদেশি। এসব প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়া বিশেষজ্ঞের অধিকাংশই বিদেশি। সূত্রে প্রকাশ, আমাদের দেশের প্রকৌশলীরা

এসব বিশেষজ্ঞের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করেন! এ অবস্থায় প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আমরা কী প্রোডাক্ট পাচ্ছি? পাশাপাশি এটিও প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, আমাদের উন্নয়নের ভবিষ্যৎটাই বা কী? এ উন্নয়ন কতটুকুই বা টেকসই?

একথা সত্য, দেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। জিপিএ-৫ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৯টি। বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৭০টি। এসব মেডিকেল কলেজের শিক্ষার মান নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন উঠেছে। হাসপাতালগুলোর সেবার মান মোটেই সন্তোষজনক নয়।

দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী ক্যারিয়ার অপশন হিসাবে বিসিএসকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। বিসিএসে ক্যাডার হওয়ার ধাপ আছে ২৮টি। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ক্যাডার হতে প্রশাসন, পুলিশ, ফরেইন অ্যাফেয়ার্স প্রভৃতি পদকেই প্রধানত চয়েস দেয়।

চয়েস নির্বাচনে প্রায় সব প্রার্থীই ‘শিক্ষা ক্যাডার পদটি’কে সর্বশেষ চয়েস দিয়ে থাকে। তার মানে সবাই বড়লোক হতে ক্ষমতা ও টাকাওয়ালা পদটিকে বেছে নেয়। শিক্ষকতা পেশায় টাকা কিংবা ক্ষমতা কম বিধায় এ পদটিকে সবাই এড়িয়ে চলে। এটি একটি দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির প্রধান অন্তরায়।

শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক দৈন্যের কারণে আমাদের দেশের শিক্ষার মান দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিুে। আন্তর্জাতিক এক মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশের শিক্ষার মান ২.৮ শতাংশ। বিপরীতে ভারত ও শ্রীলংকার শিক্ষার মান ২০.৮ শতাংশ। পাকিস্তানের শিক্ষার মান আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। এ সমীক্ষা প্রমাণ করে যে, আমাদের দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ।

যে কোনো দেশে শিক্ষার ভিত রচিত হয় প্রাইমারি থেকে। দেশে প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা ৬৬ হাজারের কাছাকাছি। এখানে চাকরিরত শিক্ষকের সংখ্যা ৪ লাখ। জাতি গড়ার ভিত্তিই হলো এ ৪ লাখ শিক্ষক। তারা প্রায় সারাটা দিন স্কুলে সময় দেন।

মাস শেষে তারা সর্বসাকুল্যে বেতন পান ১৭ হাজার টাকা। তারা প্রত্যেকে মাসিক টিফিন ভাতা পান মাত্র ২০০ টাকা! তার মানে তাদের প্রতিদিনের টিফিন ভাতা ৬ টাকা ৬৬ পয়সা! এসব শিক্ষকের মর্যাদা সচিবালয়ের একজন পিওনের মর্যাদার চেয়েও নিচে! এসব কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ভালো রেজাল্টধারী একজন গ্র্যাজুয়েট এখানে চাকরি করতে চান না।

দেশে মাধ্যমিক স্তরের ৯৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। দেশে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৬ হাজার। এখানে কর্মরত শিক্ষক সংখ্যা ৫ লাখ। নিয়োগ পেয়ে এন্ট্রি লেভেলে তারা বেতন পান ১২ হাজার ৫০০ টাকা। তাদের মাসিক চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা। অথচ একজন ভালো ডাক্তারের একবারের ফি ১ হাজার টাকা। এসব শিক্ষক বাড়ি ভাড়া বাবদ পান মাত্র ১ হাজার টাকা;

যা দিয়ে বস্তিতে একটি কক্ষও ভাড়া পাওয়া যায় না। যুগ যুগ ধরে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত এ ভাতা শিক্ষকরা পেয়ে আসছেন। এখানে নেই টিফিন ফি, নেই পদোন্নতি, নেই বদলি। বর্তমান বাজারে এ সামান্য বেতনে তাদের ১০ দিনও চলে না। তারা পাঠদানে মনোযোগী হতে পারেন না। সংসারের ঘানি টানতে তারা বেছে নেন নানা পেশা। কেউবা টিউশন করেন। এরপর রয়েছে উচ্চমাধ্যমিক লেভেল।

এ পর্যায়ে কলেজগুলো এমপিওভুক্তির কঠিন বেড়াজালে বন্দি। এখানেও পদোন্নতি বা বদলি কোনোটিই নেই। একজন শিক্ষক ৩০ বছর ধরে প্রভাষকই রয়ে যান! প্রভাষক পদে যোগদান করে প্রভাষক হিসাবেই অবসরে যান!

এরপর আসা যাক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রসঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয় হলো যে কোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। এখানে প্রমোশন থাকলেও একাডেমিক মোটিভেশন নেই। গবেষণা থাকলেও আন্তর্জাতিক মান নেই।

এখানে নিয়োগের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানান হিসাবনিকাশ। ফলে নিয়োগ পাওয়ার পর অনেকেই গবেষণায় বদলে অন্য বিষয়ে বেশি মনোযোগী হন। এসব কারণে আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে থাকে।

আমাদের শিক্ষার্থীরা এমন শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, তারা না শিখছে নৈতিক শিক্ষা, না শিখছে বিজ্ঞান শিক্ষা আর না শিখছে প্রযুক্তির শিক্ষা। এ শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা দেশপ্রেমিক হয়েও গড়ে উঠছে না।

অতি মেধাবীরা ঘটনাক্রমে শিক্ষকতা পেশায় এলেও অনেক ক্ষেত্রে তাদের ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, এ পেশায় যেহেতু আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা নেই, তাই এখানে তাদের আকর্ষণও নেই। আবহমানকাল থেকেই দেখে আসছি, আমাদের দেশের শিক্ষকদের আর্থসামাজিক অবস্থা খুবই নিুমানের! বর্তমানে যারা এ পেশায় নিয়োজিত আছেন, তারা সামাজিকভাবে যেন কিছুটা উপেক্ষিত।

তাদের অর্থনৈতিক সলভেন্সি নেই। তাই সামাজিক মর্যাদা কম। ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা আমলাতান্ত্রিক শাসন দেশে আজ অবধি চলমান রয়েছে। আমলানিয়ন্ত্রিত দেশে একজন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকতার আর্থসামাজিক অবস্থা আকাশচুম্বী। তাদের অর্থনৈতিক সলভেন্সি, সামাজিক মর্যাদা ও প্রশাসনিক ক্ষমতা সীমাহীন। অথচ আমলা তৈরির কারিগররা সমাজে অবহেলিত! একটি উদাহরণের মাধ্যমে একজন আমলা ও একজন শিক্ষকের সামাজিক অবস্থান স্পষ্ট করা যেতে পারে।

আমলারা এ দেশের সর্বোচ্চ সরকারি সুবিধাভোগী নাগরিক। তারা তাদের নির্ধারিত বেতনের বাইরে নানাবিধ সুবিধা পেয়ে থাকেন। শুধু বাবুর্চি অ্যালাউন্স বাবদ তারা মাসে ১৬ হাজার টাকা ভাতা পান! বাসভবনে নিরাপত্তা অ্যালাউন্স বাবদ ভাতা পান ১৬ হাজার টাকা! প্রতি মাসে না হলেও একজন আমলা বছরে অন্তত ২/১ বার বিদেশ ভ্রমণে যান। এ উপলক্ষ্যে টিএ/ডিএ বাবদ পান কমপক্ষে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা! একজন আমলা বিনা সুদে গাড়ি ক্রয়ের সুবিধা পেয়ে থাকেন। যার মূল্য পদভেদে ৫০ লাখ থেকে কোটি টাকা!

গাড়ির জ্বালানি খরচ বাবদ প্রতি মাসে তিনি পান ২০ হাজার টাকা। এছাড়া আবাসিক টেলিফোন ভাতা, সেলফোন ভাতা, ইন্টারনেট মডেম ভাতা, আপ্যায়ন ভাতা, ডোমেস্টিক ভাতাসহ নানা ভাতাদি পেয়ে থাকেন! চাকরি শেষে একজন আমলা প্রচুর টাকা পান। চাকরি শেষে একজন আমলা নিরাপদ জীবনের গ্যারান্টি পান। তাদের সন্তানদের মানুষ করার গ্যারান্টি পান। তাদের সন্তানরা এদেশে পড়ে না। সন্তানদের বিদেশ পাঠিয়ে তারা সুশিক্ষা নিশ্চিত করেন। সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করেন। তাদের অনেকে দেশের সব আয়-রোজগার বিদেশে ইনভেস্ট করেন। একসময় তিনিও বিদেশে পাড়ি জমান। বিদেশের মাটিতে নিশ্চিত ও সুন্দর আগামী গড়েন।

বিপরীতে আমাদের দেশের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের হাল হকিকত সবারই জানা। জীর্ণকায় শরীরে অপুষ্টিতে ভোগা একজন চুলপাকা বুড়ো মানুষই হলো বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক। যার কপালের প্রতিটি ভাঁজে দারিদ্র্যের কশাঘাতের ঘাম ভরপুর। তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ একেবারেই অনিশ্চিত। অথচ দেশ এবং জাতির উন্নয়ন নির্ভর করছে এসব শিক্ষকের ওপর। জাতি গড়ার এ কারিগরদের অনেকে অর্ধাহারে-অনাহারে দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনযাপন করেন। তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ছাড়া দেশের কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না।

ড. মো. কামরুজ্জামান : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *