Home নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা কাদের দরকার, কেন দরকার
Mei ২৯, ২০২৩

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা কাদের দরকার, কেন দরকার

অনলাইন ডেস্ক,

একটি দেশ কাকে ভিসা দেবে বা দেবে না, সেটা সব সময়ই সেই দেশটির নিজস্ব ও অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য অনেকেই ভিসার আবেদন করেন, কিন্তু সবাই ভিসা পান না।

এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সরকার গত বুধবার রাতে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি নতুন নীতি ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি বলছে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধা দেওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত করার সঙ্গে জড়িত বা দায়ী ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকোচন, নির্বাচনপ্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাকে জবরদস্তি করে নষ্ট করা, মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন—এসব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের দেশগুলোর যে আপত্তি আছে, তা আমাদের জানা। বেশ কিছু সময় ধরেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে এসব নিয়ে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিষেধাজ্ঞা’ আসতে পারে। সেই নিষেধাজ্ঞা আসেনি, এসেছে একটি ‘সামান্য’ ভিসা নীতি। গণতন্ত্র বা নির্বাচনপ্রক্রিয়ার ক্ষতি করাকে অন্যায় বিবেচনা করে এর সঙ্গে জড়িতদের যুক্তরাষ্ট্র ভিসা না দেওয়ার কথা বলেছে।

যে কাজগুলোকে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা হিসেবে ধরে নেওয়া হবে, তার মধ্যে রয়েছে ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনগণের সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারচর্চাকে সহিংস পথে বাধা দেওয়া।

তা ছাড়া রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখার পদক্ষেপও নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হবে। আর এসব কাজের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য—যে কেউই এই ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় পড়তে পারেন। এমনকি জড়িত ব্যক্তিদের স্ত্রী, স্বামী বা সন্তানেরাও ভিসা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের আইন বা সামাজিক-রাজনৈতিক বিবেচনাতেও কি এই কাজগুলো অন্যায় বা খারাপ নয়? তাহলে এই ভিসা নীতি কেন আমাদের দেশের সব মহলের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল? এ নিয়ে এত বিচলিত হওয়ারই–বা কী আছে?

তবে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, দেশের গণতন্ত্র রক্ষা ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য মরিয়া কিছু লোকের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে! সন্তানদের পড়াশোনা বা যুক্তরাষ্ট্রে জমানো সম্পদ রক্ষায় যাঁদের যুক্তরাষ্ট্র যেতেই হবে, তাঁরা যদি ভয় পান, তবেই তৈরি হবে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ? দেশকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে আসার দায় কার?

আসলে এরই মধ্যে এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞার চেয়ে এই ভিসা নীতির প্রভাব অনেক বেশি। বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র জেনেবুঝেই এই কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি কিছু ব্যক্তি, কোনো প্রতিষ্ঠান বা অন্যান্য কোনো ক্ষেত্রে ‘নিষেধাজ্ঞা’ দিত, তবে এ নিয়ে সমালোচনা ও যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা করার সুযোগ থাকত। নিষেধাজ্ঞার পথ না ধরায় সেটা হয়নি। বরং উল্টো দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতিকে কীভাবে নিজেদের পক্ষের পদক্ষেপ হিসেবে দেখানো যায়, সেই চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে।

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সুবিনয় মুস্তাফী নামের এক ‘আশ্চর্য ভূয়োদর্শী’ যুবকের কথা আছে, যার ক্ষমতা ছিল একই সঙ্গে বিড়াল ও বিড়ালের মুখে ধরা ইঁদুরকে হাসানোর (‘সুবিনয় মুস্তাফীর কথা মনে পড়ে এই হেমন্তের রাতে। /একসাথে বিড়াল ও বিড়ালের-মুখে-ধরা-ইঁদুর হাসাতে/ এমন আশ্চর্য শক্তি ছিল ভূয়োদর্শী যুবার’ সুবিনয় মুস্তাফী, কবি জীবনানন্দ দাশ)। যুক্তরাষ্ট্র তো দেখা যাচ্ছে সুবিনয় মুস্তাফীর মতো দুই পক্ষকেই খুশি করতে সফল হলো! বিড়ালকেও হাসাচ্ছে, সঙ্গে বিড়ালের মুখে ধরা ইঁদুরকেও!

নিষেধাজ্ঞার চেয়ে নতুন ভিসা নীতি কেন বেশি শক্তিশালী বা বাংলাদেশের জন্য বড় চাপ—এই প্রশ্ন কেউ তুলতে পারেন। এর জবাব হচ্ছে, এর আওতা অনেক বড়। যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন ভিসা নীতির ঘোষণায় এটা স্পষ্ট যে দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ, বিচারিক এমনকি সামাজিক নেতৃত্বের যে কেউই এর আওতায় পড়তে পারেন।

আগেই বলেছি, যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট হিসাব-নিকাশ করে এই কৌশলী নীতি ঘোষণা করেছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র জানে যে সমাজের এই অংশই বেশি যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চায়, সেখানে তঁাদের স্বার্থ রয়েছে, তাঁরা তাঁদের সন্তানদের পড়াতে চান, কেউ কেউ সেখানে তাঁদের সম্পদ গড়েছেন, অর্থ জড়ো করেছেন। মানে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, বিচারিক ও সামাজিক যে নেতৃত্বের সমন্বয়ে আমাদের দেশটি পরিচালিত হয়, নীতি নির্ধারিত হয়, তাঁদের একধরনের যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা তাঁদের দরকার। নিজেদের জন্য দরকার, পরিবার ও সন্তানের জন্য দরকার, সেখানে জমা করা তাঁদের সম্পদের নিরাপত্তার জন্য দরকার। তা না হলে এ নিয়ে এত বিচলিত হওয়ার কিছু ছিল না।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি কী বার্তা দেয়

কিছুদিন ধরে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী কথাবার্তা শোনা গেছে। ভিসা নীতি ঘোষণার পর সরকার বা দলের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই জনমনে কৌতূহল ছিল।

তারা যে আগের অবস্থানে নেই, তা অনেকটাই স্পষ্ট। অথবা এমনও হতে পারে, এই ভিসা নীতির প্রভাব কতটা গভীর হতে পারে, তা তারা বোঝার চেষ্টা করছে এবং এ জন্য সময় নিচ্ছে। এর বাইরে আরও একটি কারণ হতে পারে এই যে ভিসা নীতির সমালোচনা করার যৌক্তিক ভিত্তি কম। যেমন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সব সময় ভিসা তাদের নিজের দায়িত্বে দেয়, এটি চলে আসছে।

ভিসা নীতিকে নিজেদের পক্ষে নেওয়ার কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগ বলতে শুরু করেছে, এটা তাদের উদ্দেশে দেওয়া হয়নি, বরং এর মূল লক্ষ্য বিএনপি। কারণ ‘বিরোধী রাজনৈতিক দলের’ সদস্যরাও এই ভিসা নীতির আওতায় রয়েছেন। আর বিএনপি যদি ভোট ঠেকানোর চেষ্টা করে, তাহলে তা ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধা দেওয়া’ হিসেবে বিবেচিত হবে। ওবায়দুল কাদেরের মুখে শোনা গেল, আমেরিকার নতুন ভিসা নীতিতে বিএনপির গলা বসে গেছে, মুখ শুকিয়ে গেছে।

মার্কিন ভিসা নীতি: নিষেধাজ্ঞা নয়, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে চাপ

জনসভার বক্তৃতা বা আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে নেতারা যা বলেন তা দিয়ে সব বোঝা যায় না। ‘অফ দ্য রেকর্ড’ কিছু কথাবার্তা বিবেচনায় নিতে হয়, পরিস্থিতির বিচার-বিশ্লেষণ করতে হয়। কিছু প্রশ্নও তুলতে হয়। নির্বাচন সামনে রেখে আন্দোলন জোরদার করার চেষ্টা করবে বিএনপি। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা দলীয় নেতা-কর্মীদের ব্যবহার করে আগে যেভাবে বিএনপিকে সামাল দেওয়া যেত, সামনে কি তা পারা যাবে?

সরকার, দল বা প্রশাসনের যাঁদের মার্কিন ভিসা খুব দরকার, তাঁরা কি আগের মতো সক্রিয় থাকবেন? নাকি পিছুটান দেবেন? ভিসা নীতির আওতা বা জালটি অনেক বড় হওয়ায় কে কোন কাজ করে ভিসা না পাওয়ার জালে আটকা পড়ে যান, সেই ভয়টি হয়তো অনেকের মধ্যেই কাজ করবে। সরকারের ওপর এর প্রভাব পড়া স্বাভাবিক।

অন্যদিকে ভিসা নীতিকে সরকারবিরোধী উদ্যোগ বিবেচনা করে বিএনপি হয়তো খুশিতে আছে। কিন্তু যথেষ্ট ভারসাম্য রেখেই নীতিটি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধা’ দেওয়ার বিরোধিতা করেছে কিন্তু নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ হওয়া না-হওয়া নিয়ে কিছু বলেনি। সম্ভবত কৌশল হিসেবে তারা এটা বলবেও না। আবার আওয়ামী লীগের ‘সংবিধান’ মেনে নির্বাচন প্রশ্নেও তারা কিছু বলা থেকে বিরত আছে। বিএনপি বড় দ্বিধায় পড়বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা না করা নিয়ে। নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকলে কী কৌশল হবে বিএনপির? আন্দোলন করবে? নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করবে? সে ক্ষেত্রে সহিংসতা হলে দলটি দায় এড়াতে পারবে কি? বোঝা যায় সামনের দিনগুলো বিএনপির জন্যও কঠিন।

যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় ভিসা নীতি কার্যকর করবে, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করবে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল এবং নানা কায়দার রাজনৈতিক কৌশলে পারদর্শী দলগুলোর কে কোথায় কীভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে, নির্বাচনে কারচুপির ছক সাজাবে, গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করবে—সেই তদারকি একটি কঠিন কাজ। তবে ভিসা নীতি কার্যকর করার ক্ষেত্রে এ দিকগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব ও বাড়তি পর্যবেক্ষণ থাকবে বলে ধরে নেওয়া যায়। কীভাবে ও কার ওপর এই ভিসা খড়্গ কাজ করে, তা দেখার জন্য আপাতত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

তবে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, দেশের গণতন্ত্র রক্ষা ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য মরিয়া কিছু লোকের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে! সন্তানদের পড়াশোনা বা যুক্তরাষ্ট্রে জমানো সম্পদ রক্ষায় যাঁদের যুক্তরাষ্ট্র যেতেই হবে, তাঁরা যদি ভয় পান, তবেই তৈরি হবে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ? দেশকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে আসার দায় কার?

Tinggalkan Balasan

Alamat e-mel anda tidak akan disiarkan. Medan diperlukan ditanda dengan *