কর্মেই বেঁচে থাকবেন শিল্পের জাদুকর
গভীর শোক, বিনম্র শ্রদ্ধা এবং হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় স্মরণ করা হলো যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামকে। দেশের শিল্প খাতের অগ্রদূত, আপসহীন উদ্যোক্তার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী ছিল বৃহস্পতিবার। এ উপলক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে নুরুল ইসলামের পরিবার, দৈনিক যুগান্তর, যমুনা টেলিভিশন ও যমুনা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এসব কর্মসূচির মধ্যে ছিল বনানী কবরস্থানে প্রয়াত চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের কবর জিয়ারত, শ্রদ্ধা নিবেদন, স্মরণসভা, স্মৃতি রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড প্রদান, প্রামাণ্যচিত্র উপস্থাপন, এতিমদের মধ্যে কুরআন শরিফ বিতরণ এবং মিলাদ ও বিশেষ দোয়া মাহফিল। অনুষ্ঠানে পরিবারের সদস্য, স্বজন, প্রতিষ্ঠানের সহকর্মী এবং গুণগ্রাহীরা অংশ নেন। ঢাকার বাইরেও সারা দেশেই বিভিন্ন স্থানে কুরআন খতম ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। এতে নুরুল ইসলাম ও পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি দেশ ও জাতির কল্যাণে দোয়া করা হয়।
অনুষ্ঠানগুলোয় স্বপ্নদ্রষ্টার রেখে যাওয়া কাজ এগিয়ে নেওয়ার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তার পরিবার, সহকর্মী ও স্বজনরা। তারা বলেন, সাহসী এই শিল্পোদ্যোক্তা আজ সশরীরে বেঁচে নেই। কিন্তু রেখেছেন তার অমর সৃষ্টি বিশাল কর্মযজ্ঞ যমুনা গ্রুপের ৪২টি প্রতিষ্ঠান। আর এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনন্তকাল মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। যার সওয়াব নুরুল ইসলামের আমলনামায় যোগ হবে।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় যুগান্তর কার্যালয়ে নুরুল ইসলামের ম্যুরালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন যমুনা গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন যমুনা গ্রুপের পরিচালক-মনিকা নাজনীন ইসলাম, সুমাইয়া রোজালিন ইসলাম, এসএম আবদুল ওয়াদুদ ও মেহনাজ ইসলাম।
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন যমুনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম ইসলামের দুই ছেলে-ইয়াসিন ইসলাম নাজেল ও আরশান ইসলাম। আরও ছিলেন যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, যমুনা টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফাহিম আহমেদ, যুগান্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং প্রয়াত নুরুল ইসলামের ভাই তাজুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে নুরুল ইসলামের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন হাফেজ মো. আবু ইউসুফ।
এর আগে সকালে বনানী কবরস্থানে নুরুল ইসলামের কবর জিয়ারত ও আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া করে যমুনা ও যুগান্তর পরিবার। যমুনা গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি এবং যুগান্তর সম্পাদক জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলমের নেতৃত্বে কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত যুগান্তরের সিনিয়র সাংবাদিক ও কর্মকর্তারা নুরুল ইসলামের কবরের পাশে অবস্থান করেন। এরপর দুপুরে যুগান্তরে মিলাদ, বিশেষ দোয়া মাহফিল ও স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়।
যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলমের সভাপতিত্বে এবং প্রধান প্রতিবেদক মাসুদ করিমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন যমুনা গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি। এ সময় তিনি বলেন, স্বপ্নদ্রষ্টার দেখানো পথেই চলবে যমুনা, যুগান্তর পরিবার। সাইফুল আলম বলেন, একজীবনে সবদিক থেকে সফল নুরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন যুগান্তরের উপসম্পাদক বিএম জাহাঙ্গীর, যমুনা টেলিভিশনের সিইও ফাহিম আহমেদ, কালবেলা পত্রিকার সম্পাদক সন্তোষ শর্মা, যুগান্তরের সহকারী সম্পাদক মাহবুব কামাল এবং যমুনা গ্রুপের পরিচালক (ট্যাক্স) আলী আশরাফ। এ সময় বক্তারা বলেন, কর্মেই বেঁচে থাকবেন শিল্পের জাদুকর।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন যুগান্তরের যুগ্ম-সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার, উপসম্পাদক-আহমেদ দীপু ও এহসানুল হক, প্রধান বার্তা সম্পাদক আবদুর রহমান, নগর সম্পাদক মিজান মালিক, বিশেষ সংবাদদাতা-শেখ মামুনুর রশীদ, দেলোয়ার হুসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন ও মাহবুব আলম লাভলু, স্পোর্টস ইনচার্জ পারভেজ আলম চৌধুরী, সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান দেওয়ান আসিফ রশীদ, সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) আবুল খায়ের চৌধুরী, সার্কুলেশন ম্যানেজার-আবুল হাসান ও সাইদুল হক, ম্যানেজার (হিসাব) মো. সাইফুল ইসলাম, মফস্বল ইনচার্জ নাঈমুল করিম নাঈম, সম্পাদনা সহকারী বিভাগের প্রধান আতিকুর রহমান চৌধুরী, প্রেস ম্যানেজার নাজমুল আনাম খান প্রমুখ।
যমুনা গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি বলেন, নুরুল ইসলাম সব সময় ভালো কিছুকেই বুকে ধারণ করতেন। তিনি একজন সাদা মনের মানুষ ছিলেন। ১৯৭১ সালে দেশকে ভালোবেসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি যুদ্ধে যান। আর ফিরে এসেছিলেন লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে। এরপর মানুষের কথা ভেবে, মানুষের কর্মসংস্থানের কথা মাথায় রেখে স্বাধীন বাংলাদেশে একে একে ৪২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সালমা ইসলাম বলেন, ‘কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে তিনি বহু মানুষের কাজের ব্যবস্থা করেছেন। আমি মনে করি, তিনি আমাদের রেখে চলে যাননি। আমাদের পাশেই আছেন এবং থাকবেন। আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসাবে গর্ববোধ করি। দীর্ঘ ৪৫ বছর আমরা সংসার করেছি। এই দীর্ঘ সংসার জীবনে অনেক স্মৃতি, যা বলে শেষ করা যাবে না।’
সালমা ইসলাম আরও বলেন, নুরুল ইসলাম তার কর্মজীবনে কোনো বিশ্রাম নিতেন না। শুক্র, শনিবারও কাজে ব্যস্ত থাকতেন। কাজগুলো তিনি ভাগ করে দিয়েছিলেন। বাসার সব কাজ আমাকে দিয়ে করাতেন, আর বাইরের কাজগুলোর দায়িত্ব নিজে নিয়েছিলেন।
সালমা ইসলাম বলেন, করোনায় মৃত্যুতে তিনি শহিদি মর্যাদা পেয়েছেন। আমরা জেনে এসেছি, দেশরক্ষার্থে যারা মারা যান, তারা শহিদি মর্যাদা পান। আবার মহামারিতে যারা মারা যান, তারাও শহিদি মর্যাদা পান। করোনা মহামারির সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সালমা ইসলাম বলেন, করোনা মহামারির সময় তিনি (নুরুল ইসলাম) শুধু ছটফট করতেন, ড্রয়িংরুম থেকে বেডরুম, বেডরুম থেকে ড্রয়িংরুমে যেতেন। তার শুধু একটাই কথা ছিল-কখন কবে করোনা মহামারি যাবে, কবে তিনি অফিস করতে পারবেন। তার ধৈর্যসীমা যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। আমি মনে করতাম, তিনি তো অফিস করলেই ভালো থাকতেন। সালমা ইসলাম বলেন, আমি মাঝেমধ্যে দেখতাম তিনি (নুরুল ইসলাম) চোখের পানি ফেলতেন। আমি জিজ্ঞাসা করতাম, তুমি কান্নাকাটি করছ নাকি?
চোখের পানি মুছে বলতেন, না তো, আমি কাঁদিনি। কী বলো? আমি বুঝতে পারতাম না, কী কারণে তার মন খারাপ। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সালমা ইসলাম বলেন, নুরুল ইসলাম রাতভর আল্লাহ ও রাসুল সম্পর্কে বিভিন্ন কথাবার্তা শুনতেন। তিনি নামাজ আদায় করতেন। তিনি শুধু দেশ ও মানুষের কথাই ভাবতেন। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি স্বজন এবং পরিচিতজনদের খোঁজখবর নিতেন। সালমা ইসলাম বলেন, উনি (নুরুল ইসলাম) যুগান্তরকে এত বেশি ভালোবেসেছিলেন, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তিনি যেসব দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন, সেই অনুযায়ীই চলছে যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশন।
যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘তুমি রবে নীরবে’। আমি এখানে একটু স্পর্ধা নিয়ে বলতে চাই-নুরুল ইসলাম রবে সরবে। এবং তিনি সরবেই আছেন। তিনি বলেন, অনেক জীবন অসম্পূর্ণ থাকে, অসফল হয়। মানুষের একজীবনে সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। কিন্তু নুরুল ইসলাম সেই মানুষ, যিনি একজীবনে সবদিক থেকে সফল হয়েছেন। স্বপ্নকে অতিক্রম করে তিনি স্বপ্নসারথি হয়েছেন। কোনো মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। যেমন নুরুল ইসলামের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার শিক্ষাদীক্ষা, কর্ম-কোনোটাই শেষ হয়ে যায়নি। কারণ, তিনি ৭০ হাজার মানুষ রেখেছেন, যারা শিক্ষা থেকে দীক্ষা নিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। একজন মানুষের জীবনে এর চেয়ে বেশি কী পাওয়ার আছে।
সাইফুল আলম বলেন, নুরুল ইসলাম এমন স্থানে পৌঁছেছেন, যেখানে অন্যদের পৌঁছানো সম্ভব নয়। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশ, মানুষ ও মাটিকে ভালোবেসে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। এতটা গুণ যে মানুষটির মধ্যে রয়েছে, তিনি অনেক উচ্চতায় পৌঁছে গেছেন। যুগান্তর সম্পাদক বলেন, নুরুল ইসলামের কর্মের মূল প্রেরণায় যিনি রয়েছেন, তিনি যুগান্তরের প্রকাশক, যমুনা গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম। একজন মানুষ সফল হওয়ার জন্য পেছনে একজন মহীয়সী নারী দরকার। সেই রকম মহীয়সী নারী সালমা ইসলাম। আমরা সৌভাগ্যবান এই কারণে, নুরুল ইসলামের অনুপস্থিতিতে অ্যাডভোকেট সালমা ইসলামের ছায়ায় তার সন্তানরা রেখে যাওয়া কাজ দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সাইফুল আলম আরও বলেন, নুরুল ইসলামের কথা আলোচনা করলে শেষ হবে না। তবে শুধু আলোচনা নয়, কাজের মাধ্যমে তাকে স্মরণ করতে হবে। রেখে যাওয়া কাজগুলো এগিয়ে নিতে হবে।
বিএম জাহাঙ্গীর বলেন, নুরুল ইসলামের জীবন ছিল অসাধারণ; কিন্তু মানুষ হিসাবে ছিলেন সাধারণ। তিনি বিশ্বাস করতেন-কর্মেই শক্তি এবং কর্মেই মুক্তি। কর্মই একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল তার। জীবনের সব ক্ষেত্রে তিনি শৃঙ্খলা মেনে চলতেন। সময় কীভাবে কাজে লাগাতে হয়, তার অনন্য দৃষ্টান্ত যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। বিএম জাহাঙ্গীর আরও বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) নুরুল ইসলামের স্মরণসভা। এক্ষেত্রে সবার আগে আমাদের মহান আল্লাহকে মনে রাখতে হবে। এরপর মনের ভেতর থেকে নুরুল ইসলামের জন্য দোয়া করতে হবে। তার মতে, মহান এই ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা করলে স্বল্প সময়ে শেষ হবে না। এজন্য লম্বা সময় দরকার। তিনি (বিএম জাহাঙ্গীর) বলেন, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার (নুরুল ইসলাম) নিজের আমল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কেউ তাকে সত্যিকারে ভালোবেসে থাকলে, দুটি বিষয় মনে রাখা জরুরি-প্রথমত, কীভাবে আমল বা দোয়া করলে তার কাছে পৌঁছাবে, সেভাবে আমল করতে হবে। মনের ভেতর থেকে তার জন্য দোয়া করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জীবিত অবস্থায় তিনি যেভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে কাজ করা উচিত। তার আদর্শ ধারণ করে রেখে যাওয়া কাজগুলো বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রত্যয়ী হতে হবে। তাহলে কেবল তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে।
ফাহিম আহমেদ বলেন, ‘প্রতিবছর এই দিনটি এলেই আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। প্রয়াত চেয়ারম্যান সাহেব চেয়েছিলেন বলেই যমুনা টেলিভিশন আজ এই পর্যায়ে এসেছে। তিনি টেলিভিশনের সংবাদ, টকশো এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের গুণগতমানের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন। এ কারণে আমরা টকশোসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এমন কোনো ব্যক্তিকে অতিথি করি না, যিনি আমাদের টেলিভিশনের মানের সঙ্গে যান না। আগামী দিনেও আমরা সেই মান ধরে রাখার চেষ্টা করব।
সন্তোষ শর্মা বলেন, কর্মের কারণেই নুরুল ইসলাম উচ্চতর অবস্থানে পৌঁছে গেছেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো-দেশ স্বাধীন করার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। স্বাধীনতার পর কাজ করেছেন দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। তিনি বলেন, ‘নুরুল ইসলাম আমার অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলেন। দেশের বাইরে তিনি এক টাকাও পাচার করেননি। যা আয় করেছেন, সব আবার দেশেই বিনিয়োগ করেছেন। একজন শিল্পপতির দেশের জন্য এর চেয়ে বড় অবদান আর কী হতে পারে।’
অনুষ্ঠানে অন্য বক্তারা বলেন, নুরুল ইসলাম শুধু একজন ব্যক্তি নন, শিল্প খাতের একটি বিপ্লবের নাম। ব্যবসা অঙ্গনে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রেখেছেন সফলতার স্বাক্ষর। যৌবনে অস্ত্র হাতে ৭১ সালে দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন রণাঙ্গনের প্রথম সারির এই যোদ্ধা। আর স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শুরু করেন নতুন যুদ্ধ। এ যেন অবিরাম পথচলা। মেধা, সততা, পরিশ্রম ও সাহসিকতার সঙ্গে বিশ্বমানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন আপসহীন এই কর্মবীর। এসব প্রতিষ্ঠান সারা বিশ্বেই বাংলাদেশকে তুলে ধরছে। দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী ছিলেন তিনি। দেশকে নিয়ে বিশাল স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু সেই স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়নের আগেই ৭৪ বছর বয়সে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই স্বপ্নদ্রষ্টা। তারা বলেন, নুরুল ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে অ্যাডভোকেট সালমা ইসলামের নেতৃত্বে তার পরিবার দেশ ও যমুনা গ্রুপকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে। যমুনা আরও অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।
বনানী কবরস্থানে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও দোয়া-মোনাজাত : বৃহস্পতিবার সকালে বনানী কবরস্থানে তার কবরে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ সময় পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং পরিচালনা করা হয় দোয়া ও মোনাজাত। নুরুল ইসলামের পরিবার, যমুনা গ্রুপ, যুগান্তর এবং যমুনা টেলিভিশনের পক্ষ থেকে এসব কর্মসূচি পালন করা হয়।
এ সময় বর্তমান চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম ও যমুনা গ্রুপের পরিচালক মেহনাজ ইসলাম গ্রুপের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। যমুনা বিল্ডার্সের পরিচালক আব্দুল মালেক, যমুনা বিল্ডার্সের পরিচালক (অপারেশন) আব্দুল খালেক এবং যমুনা ফিউচার পার্কের পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রউফসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন মক্কা থেকে আগত মো. আবু ইউসুফ।
এরপর যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম ও যুগ্ম-সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে যুগান্তরের পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন হাফেজ মো. আব্দুল মালেক। যুগান্তর পরিবারের পক্ষে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উপসম্পাদক-আহমেদ দীপু, এহসানুল হক বাবু ও বিএম জাহাঙ্গীর। আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান বার্তা সম্পাদক আবদুর রহমান, নগর সম্পাদক মিজান মালিকসহ বিভিন্ন বিভাগের প্রধানরা।
পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া ও মোনাজাত শেষে অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি দেশকে যেমন ভালোবাসতেন, তেমনই পরিবার ও কর্মীদেরও ভালোবাসতেন।
আমার সৌভাগ্য যে তার মতো একজন মানুষকে জীবনে চলার পথে পেয়েছি, তার সহধর্মিণী হতে পেরেছি। তিনি অসুস্থ অবস্থায়ও হাসপাতাল থেকে সবার খোঁজ নিতেন। কে কেমন আছে, ফ্যাক্টরি কেমন চলছে, কীভাবে চলছে। কর্মীদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো হয়েছে কি না জানতে চাইতেন। সাইফুল আলম বলেন, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও যমুনা গ্রুপের স্বপ্নদ্রষ্টাকে হারিয়ে আমরা শোকে মর্মাহত। তার সঙ্গে ২৫-৩০ বছর কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিংবদন্তি এ শিল্পোদ্যোক্তার জীবন শূন্য থেকে শুরু হয়ে পরিপূর্ণ হয়ে শেষ হয়েছে। বিদেশের ব্যাংকে তার কোনো টাকা জমা নেই। কোনোদিন ঋণখেলাপি হননি। তিনি সবকিছুই করেছেন দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসেই।
২০২০ সালের ১৩ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে নুরুল ইসলাম ইন্তেকাল করেন। পরের দিন ১৪ জুলাই রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় বনানীর কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন আপসহীন এই যোদ্ধা। মৃত্যুর এক মাস আগে ১৪ জুন নুরুল ইসলামের করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। ওইদিনই তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। করোনায় তার কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশিষ্ট এই শিল্পোদ্যোক্তার চিকিৎসায় এভারকেয়ারে ১০ সদস্যবিশিষ্ট মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। এর বাইরে চীনের ৪ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং সিঙ্গাপুরের মাউন্ড এলিজাবেথ হাসপাতালের ২ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। ফলে সব চেষ্টা ব্যর্থ করে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি।
যমুনা গ্রুপ ও যমুনা টিভির কর্মসূচি : বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে যমুনা গ্রুপ ও যমুনা টেলিভিশনও পৃথক কর্মসূচির আয়োজন করে। কিংবদন্তি এই শিল্প উদ্যোক্তার জীবনী নিয়ে ‘স্বপ্নদ্রষ্টা-আজীবন প্রেরণার উৎস বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম’ শিরোনামে তথ্যচিত্র প্রচার করে যমুনা টেলিভিশন। এ ছাড়া সকালে বনানীতে কবর জিয়ারত শেষে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে যমুনা টিভি পরিবার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন যমুনা টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম আহমেদ, প্রধান বার্তা সম্পাদক তৌহিদ হোসেন, জিএম (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) ইউসুফ মামুনসহ অন্যরা। স্মৃতিচারণ উপলক্ষ্যে শোক বই খোলে যমুনা টেলিভিশন। শোক বইতে স্বাক্ষর করেন তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ইবরাহিম বীরপ্রতীক, এনসিসি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুল আমিন ও যমুনা টেলিভিশনের সিইও ফাহিম আহমেদ।
এছাড়া যমুনা গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে গ্রুপের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উপস্থিতিতে কর্মবীর নুরুল ইসলামের রুহের মাগফিরাত কামনা করে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন এসএম আবদুল ওয়াদুদসহ সিনিয়র কর্মকর্তারা।