বেড়েছে ছিনতাই-চুরি-ডাকাতি
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে চুরি-ছিনতাইসহ প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। বিশেষ করে অপরাধ পরিস্থিতি ক্রমেই চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিগত সময়ের তুলনায় রাজধানীতে চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে। খোদ পুলিশের পরিসংখ্যানেই এমন চিত্র উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার পরিবর্তনের পর থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল কমে যাওয়ায় অপরাধীরা বেশি সক্রিয় হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাতের বেলায় বের হয়ে জীবনও যাচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) এনামুল হক সাগর বলেন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও খুনের বিষয় নিয়ে আমরা সব সময়ই কাজ করি। সব সময় চেষ্টা থাকে এই অপরাধগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার। এর মধ্যে আমরা ছিনতাই নিয়ে বেশি কাজ করছি। ছিনতাইয়ের ঘটনা যাতে আরও কমে যায়—সে বিষয়ে সারা দেশের সব ইউনিটের দায়িত্বশীলদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অপরাধ বাড়ছে, নাকি কমছে—এ বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টা পরিসংখ্যানভিত্তিক। ফলে পরিসংখ্যানই বলবে, বেড়েছে নাকি কমেছে।
গত ২০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ‘ওয়েলকাম’ পরিবহনের একটি চলন্ত বাসে ভয়াবহ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতদের হামলায় ঐ বাসের চার যাত্রী গুরুতর আহত হন। এর আগের দিন ১৯ ডিসেম্বর ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে রূপালী ব্যাংকে দুই কিশোরসহ তিন জন ডাকাতির চেষ্টা করে। ১৮ ডিসেম্বর রাতের ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কে ফারজানা আক্তার নামে এক নারী ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। এর দুই দিন আগে ১৬ ডিসেম্বর রাতে আসাদগেট এলাকায় দেশীয় অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে ছিনতাই করে কয়েক জন এমন দৃশ্যের কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। ১৮ ডিসেম্বর রাতে সায়েদাবাদে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মো. কামরুল হাসান (২৩) নামে এক ব্যক্তি মারা যান। এর আগে ১৫ ডিসেম্বর রাতে মগবাজারে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মারা যান হাবিবুল্লাহ (১৮) নামে এক কিশোর। হরহামেশাই ঘটছে এমন ঘটনা।
রাজধানীসহ সারা দেশে চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতির মতো প্রকাশ্যে অপরাধ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি পুলিশের মাসিক অপরাধ পর্যালোচনাতেও উঠে আসে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল কার্যক্রম বাড়িয়ে ছিনতাই শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। উপদেষ্টা বলেন, ‘শেষ রাতের দিকে সাধারণত ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি হচ্ছে। আমরা পুলিশকে ইন্সট্রাকশন দিয়েছি, শেষ রাতে যেন প্যাট্রলিং বাড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশের টহল বাড়িয়ে ছিনতাই যাতে কমিয়ে আনা যায়, সে চেষ্টা করতে হবে।’
প্রতি বছরই বাড়ছে অপরাধ
পুলিশের প্রায় ছয় বছরের তথ্য বিশ্লেষণ দেখা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে প্রতি বছরই ছিনতাই বেড়ে চলেছে। ২০১৯ সাল থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৪৭ হাজারের বেশি অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে অভিযোগ ছিল ৬ হাজার ৮৮০টি, ২০২০ সালে ৭ হাজার ২০০, ২০২১ সালে ৮ হাজার ৪৯৮, ২০২২ সালে ৯ হাজার ৫৯১, ২০২৩ সালে ৯ হাজার ৪৭৫ এবং ২০২৪ আগস্ট পর্যন্ত ৫ হাজার ৮৮৩টি ঘটনা মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা মেট্রোপলিটন ও রেঞ্জ এলাকায় ১৫ হাজার ৪১৯টি অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অপরাধ তথ্য বলছে, গত ১১ মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২০৮টি, চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ৪৩৭টি এবং খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৫১৪টি। অভিযোগ রয়েছে, চুরি ও ছিনতাইয়ের বেশির ভাগ ঘটনার মামলা নেয় না পুলিশ। ফলে প্রকৃত অপরাধের চিত্র সব সময় আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত অপরাধ চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ডাকাতি ছিল ১৩৫টি, চুরি ৯০৪টি ও খুন ২৩৩ জন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে দেখা গেল ডাকাতি ২৩০টি, চুরি ৯৬৬টি ও খুন ২০৪টি। পাশাপাশি বার্ষিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে ডাকাতির ঘটনা ছিল ১ হাজার ৫৪৬টি, চুরি ৩ হাজার ৯০টি ও খুন ৩ হাজার ২৩ জন। সেখানে ২০২৪ সালে এসে ডাকাতি হয়েছে ১ হাজার ৯০২টি, চুরি ১১ হাজার ৩১০টি এবং খুন ৩ হাজার ৪৩২ জন। অর্থাৎ ২০২৪ সালে আগের বছরের তুলনায় চুরি বেড়েছে ৮ হাজারেও বেশি। খুনও বেড়েছে ৪ শতাধিকের মতো।
ছিনতাইয়ের কারণে রাজধানীতে রাতে ও ভোরে চলাচল করতে মানুষ ভয় পাচ্ছেন। ঘটছে চুরি ও ডাকাতির ঘটনা। পুলিশ ও ঢাকার আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ মাসে ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন ১৬ জন। চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় কত মামলা হয়েছে, তা নিজেদের ওয়েবসাইটে তুলে ধরেছে পুলিশ সদর দপ্তর। অনেক ক্ষেত্রে চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ নিয়ে যান না। ফলে শুধু মামলার পরিসংখ্যান দিয়ে অপরাধের প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না।
ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাদ আলী রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমার কাছে যে রিপোর্ট, তাতে দেখা যায় ছিনতাই অনেক বেড়ে গেছে। অধিকাংশ ছিনতাই হচ্ছে মোবাইল ফোন। তিনি বলেন, বাসে যাত্রী বসে থাকে, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দেয়। ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে ফোন ছিনতাই হচ্ছে। তিনি রাস্তাঘাটে ফোন ব্যবহারের সময় সতর্ক থাকার আহ্বান জানান এবং পুলিশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে উদ্যোগী হচ্ছে বলে জানান।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, কোন কোন এলাকায় বেশি চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি সংঘটিত হচ্ছে—সে ব্যাপারে পুলিশকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করতে হবে। এসব অপরাধপ্রবণ এলাকায় কারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে হবে। একই সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক অপরাধীকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। তিনি বলেন, রাতের বেলা চুরি ও ছিনতাই যদি বেশি হয়, তাহলে পুলিশের টহল দলকে আরও জোরদার করতে হবে।