আজ ৮ ডিসেম্বর নলছিটি মুক্ত দিবস এদিন লাল সবুজের পতাকা উড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা।
বালী তাইফুর রহমান তূর্য,নলছিটি(ঝালকাঠি):
আজ ৮ই ডিসেম্বর। ঝালকাঠির নলছিটি হানাদারমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে হানাদারমুক্ত হয়েছিলো নলছিটি।
রনাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা নলছিটি উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কাজী মাহবুবুল আলম লাটু জানান, ১৩ই নভেম্বর ঝালকাঠি জেলার একমাত্র সম্মুখ যুদ্ধ্স্থান তৎকালীন নলছিটি থানাধীন চাচৈর গ্রামে প্রচন্ড বেগে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধা আউয়াল এ যুদ্ধে শহীদ হলেও প্রাণ হারায় বহু পাকসেনা। তৎকালীন নলছিটি থানা (বর্তমানে ঝালকাঠির সদর উপজেলা)’র নথুল্লাবাদ ইউনিয়নের চাচৈরে অবস্থিত ‘চাচৈর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ ছিল নলছিটির মুক্তিযোদ্ধাদের সাব-ক্যাম্প। ১৯৭১ সালের ১২ই নভেম্বর রাতে যুদ্ধকালনি নলছিটির মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মরহুম মো.সেকান্দার মিয়ার নেতৃত্বে ২৮ জন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা খবর পায় চাচৈর সাব-ক্যাম্পে পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ করবে। বিষয়টি ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরকে জানালে ১৩ই নভেম্বরর সকালে তিনি ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং ঝালকাঠি সদর থানা কমান্ডার সুলতান হোসেন মাস্টার ১৫০জন সাথে চাচৈর সাব-ক্যাম্পের যোগ দেয়। এ সময় ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর মুক্তিযোদ্ধাদের রণকৌশল জানিয়ে দেন। পাকহানাদার বাহিনী ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালানোর জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। সকাল ১০ টায় এক প্লাটুন পাকহানাদার বাহিনী ঢুকে পড়ে চাচৈর গ্রামে। মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম ৩ দিক থেকে পাকহানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করে। দক্ষিণ দিক খোলা পেয়ে সেদিকে পিছু হটতে থাকে পাকহানাদার বাহিনী। ইতোমধ্যে অনেক রাজাকার ও পাক হানাদার সদস্য নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা চতুর্দিক থেকে একই এলাকার খান বাড়ি ঘিরে থাকায় মাঝখানের আঙিনায় ঢুকে আশ্রয় নেয় রাজাকার ও হানাদার বাহিনী। ইতোমধ্যে গুলি লেগে তাদের মধ্যে অনেকেই আহত হয়।
তিনি আরও জানান, পূর্বের সেই কৌশলে দক্ষিণ দিকের ছনবনে মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে হামলা করার প্রস্তুতি নিয়ে বাকি ৩ দিক থেকে গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে আতঙ্কিত করতে থাকে। এদিকে পাকসেনারাও পাল্টা গুলি ছুঁড়লে শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। এ সময় কাঠিপাড়ার আ. আউয়াল, খান বাড়ির বাসিন্দা আদু খান, হামেদ আলী, সেকান্দার মাঝি, আলেয়া ও তার ছোট ভাই শহীদ হন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে হানাদার বাহিনী দক্ষিণ দিক খোলা দেখে সেখান থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। সেখানে ওঁৎ পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা সুযোগ বুঝে ব্রাশ ফায়ার করলে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় ১৮ জন পাকহানাদার । সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে যুদ্ধ। এ সম্মুখযুদ্ধে রাজাকার ও পাকহানাদার কমান্ডারসহ প্রায় ৬০জন নিহত এবং যুক্তিযোদ্ধাসহ ৬ জন শহীদ হন। আলোচিত এই যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয় ঘটে পাক বাহিনীর। বিজয়ী হন মুক্তিযোদ্ধারা।
পরে ১৫ই নভেম্বর নলছিটির মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো,সেকান্দার আলীর নেতৃত্বে নলছিটি থানা আক্রমন করা হয়। এতে সেখানে কয়েক হানাদার নিহত হয়। এরপর ৭ই ডিসেম্বর রাতে ঝালকাঠি শহরে র্কাফিউ ঘোষণা করা হয়। এদিন নলছিটির সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মরহুম ওলিউল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নলছিটি থানা আক্রমন করে। রাতে মুক্তিযোদ্ধারা নলছিটি থানা ঘেরাও করে রাখে। এ সময় নলছিটি থানা পুলিশ প্রাথমিক পর্যায় প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও চারিদিক থেকে অবরুদ্ধ অবস্থা দেখে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এতে পাকসেনা, রাজাকার, আলবদরদের পরাজয় ঘটে। ৮ই ডিসেম্বর সকালে নলছিটি থানার তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তারা নলছিটির মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সেকান্দার আলী মিয়ার কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। সব বাহিনীকে নিরস্ত্র করে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের নলছিটির তালতলা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ফলে ৮ই ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় নলছিটি।