পাচারের অর্থ রেমিট্যান্সে ফিরে আসছে সিপিডি
শ্রমবাজার হিসেবে বাংলাদেশের প্রবাসীদের বড় অংশই কাজ করছে মধ্যপ্রাচ্যে। এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) আসছে বেশি। এই অর্থ আগে ওই দেশে পাচার করা হয়ে থাকতে পারে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।
শনিবার রাজধানীর নিজস্ব কার্যালয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনের বিষয় ছিল- ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২২-২৩ : তৃতীয় অন্তর্বর্তীমূলক পর্যালোচনা’। সংস্থাটির মতে, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে। ফলে আগামী বাজেটে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা তৈরির পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
তাদের মতে, আগামী বাজেটে বণ্টনের ন্যায্যতা এবং অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আর বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি জাতি হিসাবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক। তবে বিষয়টি সাবধানতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে দাম কমে আসায় জ্বালানি তেলের মূল্য লিটারে ৫ থেকে ১০ টাকা কমানো সম্ভব বলে মন্তব্য করে সিপিডি।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ২১ লাখ ব্যক্তি দেশের বাইরে গেছেন। এর মধ্যে ১১ লাখের বেশি সৌদি আরবে। কিন্তু সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স কমছে। বিপরীতে বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ফলে এ বিষয়ে খুব ভালোভাবে অনুসন্ধান হওয়া দরকার। তিনি বলেন, এর কারণ বের করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করছি। তিনি আরও বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে হবে।
তার মতে, পাচার হওয়া অর্থের মধ্যে একটি ঘটনায় মাত্র ২০ কোটি টাকা দেশে ফেরত এসেছে। তবে মাত্র কয়েকটি দেশের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান চুক্তি করেছে বিএফআইইউ, যা মন্দের ভালো।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, বিএফআইইউসহ সংস্থাগুলো সরকারের অধীনে থাকলে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। তাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা ব্যবহার করা যায় না। এখানে সংস্কার দরকার। একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০২০ সালে দেশে স্বর্ণ এসেছিল পাঁচ টন। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৫৪ টন, যা আমাদের বার্ষিক চাহিদার চেয়ে ২০ টনের বেশি। এ স্বর্ণ পাচারের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
তিনি বলেন, রেমিট্যান্স এখন স্বর্ণ আকারেও আসছে। এ পরিমাণ রেমিট্যান্স ব্যাংকের মাধ্যমে এলে রিজার্ভ বাড়ত। ফলে হুন্ডি বন্ধ করা গেলে রেমিট্যান্স বেড়ে তা সংকটে থাকা রিজার্ভকে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, অর্থনীতির অনেক সূচকে আমরা পিছিয়ে আছি। তাই আগামী বাজেটে বণ্টনের ন্যায্যতা এবং অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকার নতুন ভিসা নীতিকে সাবধানতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কারণ আমেরিকাই একমাত্র বাজার, যেখানে শুল্ক দিয়েও প্রতিযোগিতায় সক্ষম। ২০২৬ কিংবা ২০২৯-এর পরে ইউরোপ, কানাডা বা ভারতের বাজারে শূন্য শুল্কের সুবিধাটা থাকছে না। কিন্তু মার্কিন বাজারে শুল্ক দিয়ে ঢুকেও প্রতিযোগিতায় সক্ষম। এই বাজারটা আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য এ বিষয়টি সাবধানতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমেরিকা এটিকে সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক ও ভালো নির্বাচনের সঙ্গে সংযুক্ত করে ভিসার বিষয়টি এনেছে। একজন নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, এটা আমাদের জন্য খুবই অপমানজনক। আমাদের নিজেদের জন্যও সুষ্ঠু নির্বাচন করা উচিত। শর্ত দিয়ে ভালো নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাওয়া, জাতি ও নাগরিক হিসাবে এটা খুবই দুঃখজনক। এটার অনুধাবনটা সব রাজনৈতিক দলেরই থাকবে বলে আশা করি।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। এই টাকা ফেরাতে প্রশাসনিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, এ যাবৎকাল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স বেশি এসেছে। কিন্তু বর্তমানে বেশি আসছে আমেরিকা থেকে। গত অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ৩ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৩ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ২ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার, যা চলতি বছরের জুলাই-এপ্রিলে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যারা যায়, তাদের বেশির ভাগই বৈধ চাকরি (হোয়াইট কালার জব) করে। অনেকেই ঘরবাড়ি ও জমিজমা বিক্রি করে দেশ থেকে টাকা নিয়ে চলে যান। অনেক শিক্ষার্থীও সেদেশে আছেন। তারা তো আর টাকা পাঠাতে পারেন না। তাহলে বিপুল এ রেমিট্যান্স আসছে কোথা থেকে। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রে পাচার হওয়া অর্থ রেমিট্যান্স আকারে আসছে। ইতোমধ্যে সরকার রেমিট্যান্সে আড়াই শতাংশ প্রণোদনাও দিচ্ছে। পাচারকারীরা এর সুযোগ নিচ্ছে। এই প্রণোদনা নিতে তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স আনছে।
তিনি বলেন, চলতি বাজেটে ৭ শতাংশ কর দিয়ে এই অর্থ ফেরত আনার সুযোগও দিয়েছে সরকার। তবে কর দিয়ে অর্থ আনার ক্ষেত্রে সাড়া মেলেনি। তিনি বলেন, বৈধ পথে রেমিট্যান্স উৎসাহিত করতে কয়েক বছর ধরেই প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। এখন কেউ ১০০ টাকা রেমিট্যান্স পাঠালে তা দেশে যিনি গ্রহণ করেন, তিনি পান ১০২ টাকা ৫০ পয়সা। এই সুযোগ অর্থ পাচারকারীরা নিচ্ছে বলে অনেকের সন্দেহ। আরও গভীরে গিয়ে বিষয়টির অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, রেমিট্যান্স কোথা থেকে আসছে, তা এখনই দেখা দরকার। এদিকে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে আলাদা আইন রয়েছে। তাই পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে প্রশাসনিক কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, সাধারণ মানুষ ব্যবহার করেন- এমন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক সাময়িকভাবে কমানো হলে তারা স্বস্তি পাবেন। সেক্ষেত্রে বাজার মনিটরিং করাও প্রয়োজন। দরিদ্রদের প্রত্যক্ষ সহায়তার আওতা বাড়ানো দরকার। সঠিক ব্যক্তিরা পাচ্ছেন কিনা, সেটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, রপ্তানি বৃদ্ধির হার ইতিবাচক না। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হচ্ছে। এখানে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য নিম্নমুখী হলেও দেশের বাজারে এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। বর্তমানে অকটেন, পেট্রোল, ডিজেলসহ জ্বালানি তেলে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি লিটারে ৫ থেকে ১০ টাকা কমানোর সুযোগ আছে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কেনার পর বর্তমানে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রতি লিটার ডিজেলে ৫ এবং প্রতি লিটার অকটেনে ১৩ টাকা মুনাফা করে। ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর- এই ৭ বছরে বিপিসি ৪৩ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা লাভ করেছে। কর দেওয়ার পর নিট মুনাফা ৩৬ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। চলতি বছরে ৭ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা কর দিয়েছে বিপিসি। সব মিলিয়ে বিপিসির অনেক টাকা মুনাফা রয়েছে।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকার দীর্ঘদিন জ্বালানি খাতে বেশি ভর্তুকি দিয়েছে। এখানে এখন কিছু করা যেতে পারে। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ে, তখন দেশের বাজারের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে, তখন স্থানীয় বাজারে কমানো হয় না। বাংলাদেশে গত আগস্টে হঠাৎ অকটেন, পেট্রোলসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৩৩ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়। বৃদ্ধির ওই হার ছিল গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরপর গ্যাস-বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়। এছাড়া ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্যে বেশি দামে আমদানি করতে হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণে অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই প্রভাব পড়ে। বাড়তে থাকে পণ্যমূল্য এবং মূল্যস্ফীতির হার।
ড. ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, চলতি অর্থবছরে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। এ কারণে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে। তাই আগামী বাজেটে বাস্তবতার আলোকে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।