বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আর জিয়ার ছিয়াত্তরের ৭ মার্চ পালন—বিপরীত যাত্রা
১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ। সেদিন জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাপ্রধান এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় ওইদিন রেসকোর্স ময়দানেই আয়োজন করা হয়েছিল একটি বিশাল ইসলামী জলসার। সামরিক শাসনের অধীনে দেশে সবরকম সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও এ জলসার ব্যাপারে তা প্রযোজ্য হয়নি। হয়নি কারণ এর আয়োজকরা সবাই ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সক্রিয় সদস্য। সিরাত মাহফিল নামে আয়োজিত এই ইসলামী জলসায় সভাপতিত্ব করেন চিহ্নিত, দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী প্রয়াত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রেখেছিলেন জিয়ার উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তোয়াব। সভায় রাজাকার সাঈদী ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। এসব দাবির অন্যতম ছিল বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ ঘোষণা, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আর বেদাতি শহীদ মিনার ধ্বংস করা। জিয়ার সামরিক সরকারের দ্বিতীয় ব্যক্তি তোয়াব এসব দাবির প্রতি তার সরকারের সমর্থনের ঘোষণা দেন তার ভাষণে। এ সময় স্লোগান উঠে, ‘তোয়াব ভাই তোয়াব ভাই, চান-তারা পতাকা চাই’। আজ যখন আমরা আমাদের এগিয়ে চলা আর সুন্দর সময়গুলো উপভোগ করছি, ৪৮ বছর আগের সেই অস্বস্তিকর স্মৃতিটুকু টেনে আনার উদ্দেশ্য একটাই—তারা আছে, আছে ঘাপটি মেরে, কিন্তু আছে বহাল তবিয়তেই। তারা সুযোগ খুঁজছে আবারও ছোবল দেওয়ার। সেই অন্ধকার সময় এবং বর্তমানে আমাদের করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি, সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু
৭ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা নতুন ইতিহাস সৃষ্টির দিন। এ দিনই ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার সামনে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, যা আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃত। ৭ মার্চের ভাষণের বিচার-বিশ্লেষণ এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। তবে প্রসঙ্গক্রমে ভাষণের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হবে। দৃশ্যপট বদলে যায় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর।
১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ কীভাবে পালন করা হয় জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকালের শুরুর দিকে, তার বিবরণ দেখলাম ১৯৭৬ সালের ৮ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকের পাতায়। ছবিও ছাপা হয়েছিল। ছবিতে বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল ও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক তোয়াব প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দিচ্ছেন। উনি তখন সামরিক শাসকদের একজন এবং জেনারেল জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর ও প্রতিনিধি হিসেবে ওই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে হাজির হন।
ওই একই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান—১৯৭১ ও ১৯৭৬ সালে সমাবেশ ঘটে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় সাত মাসের মাথায় ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ ওই উদ্যানে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ওই সমাবেশ ছিল রাজনৈতিক মোল্লা ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের। আয়োজনে ছিল ‘সিরাতুন্নবী’ বলে একটি সংগঠন। ওই সমাবেশে কুখ্যাত রাজাকার ও সাম্প্রতিককালে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একটি প্রস্তাব পাঠ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরাসরি সহায়তায় দিনের আলোতে এসে হাজির হন সাঈদী।
সে সভায় যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয় তা হলো—
১. বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ ঘোষণা
২. জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তন
৩. বেদাতি শহীদ মিনার ধ্বংস করা।
জিয়ার সামরিক সরকারের দ্বিতীয় ব্যক্তি তোয়াব এসব দাবির প্রতি সরকারের সমর্থনের ঘোষণা দেন তার ভাষণে। এ সময় স্লোগান ওঠে, ‘তোয়াব ভাই তোয়াব ভাই, চান-তারা পতাকা চাই’। গোলাম আযম পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর পাকিস্তানে গিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন’ শুরু করেন। পরে সৌদি আরবে গিয়ে এই আন্দোলন চালান। জিয়ার ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ পালন ছিল গোলাম আযমের পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলনেরই অংশ।
১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর কথা ছিল না কোনো রাষ্ট্রীয় মাধ্যম বা আলোচনায়। ৭ মার্চের মোড় বদলকারী ভাষণের কোনো উল্লেখও ছিল না। ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ যারা দেখেছেন তারা স্বীকার করবেন যে, জিয়ার সামরিক জান্তা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই নির্বাসনে পাঠায়নি, মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব ও মুক্তিযুদ্ধের সব ইতিহাস বেমালুম গায়েব করে দিয়েছে। এর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে বদলে দেওয়া।
বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ার যে অভিযান শুরু হয়েছিল, এরই অংশ হিসেবে জিয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাজনৈতিক মোল্লাদের সমাবেশের আয়োজন করেন। যে উদ্যানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জন্য নতুন ইতিহাস গড়েছিলেন। সেই বাংলাদেশের বুকে ‘Owing and Disowing of Bangladesh’ অর্থাৎ বাংলাদেশকে স্বীকার-অস্বীকার করার ঘটনা-দুর্ঘটনা-দুষ্কর্ম ঘটতে শুরু করল বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। ১৯৭৫-পরবর্তী রাজনৈতিক দুর্যোগের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এ লেখা। এর জন্য সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রথমেই ৭ মার্চের ভাষণ ও প্রেক্ষাপট নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। আলোচনা করব ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও কৃত দুষ্কর্ম প্রসঙ্গে এবং তারপর সাঈদীর প্রস্তাব নিয়ে।
মার্চ মাসকে আমরা অগ্নিঝরা মার্চ বলি।
৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্য ও গুরুত্ব বুঝতে হলে আমাদের পেছনের দিকে একটু তাকাতে হবে। ’৭০ সালে আওয়ামী লীগের বিশাল নির্বাচনী বিজয় হয় এবং ছয় দফার প্রতি গণরায় প্রদান করে জনগণ। তাই সেই নির্বাচনের পর করণীয় হচ্ছে ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর হাতে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা অর্পণ করা। এর জন্যই সবাই অপেক্ষায় ছিল; কিন্তু তা হলো না। ঢাকায় গণপরিষদের অধিবেশন বসার কথা ছিল ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ। এই অধিবেশন বসা নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান নানা টালবাহানা করছিলেন। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে শুরু হয় সর্বাত্মক আন্দোলন। আন্দোলনের মুখে ইয়াহিয়া অবশেষে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ।
৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের প্রথম দিন দুপুর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের জীবনযাত্রা ছিল মোটামুটি স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় যোগ দিতে নির্বাচিত সদস্যরা হোটেল পূর্বাণীতে সমবেত হয়েছিলেন। ভুট্টোর পিপিপি দলের অধিবেশনে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মানুষের মনে কিছুটা উদ্বেগ ছিল। এ ছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল।
স্বাভাবিক এ পরিস্থিতি হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে পড়ল দুপুরে রেডিওর এক আকস্মিক ঘোষণায়। দুপুর ১টা ৫ মিনিটে ইয়াহিয়া ঘোষণা করলেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত থাকবে। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। খণ্ড খণ্ড মিছিল হোটেল পূর্বাণীর দিকে এগোতে থাকে। পরিস্থিতি মোকাবিলা ও দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধু এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সর্বাত্মক আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করেন। একই সঙ্গে ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার ঘোষণা দেন।
সন্ধ্যার মধ্যেই স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার, বঙ্গবন্ধুকে সর্বাধিনায়ক ঘোষণাসহ এর পরের সব ইতিহাস সবার জানা।
১৯৭১ সালের ১ থেকে ৬ মার্চ প্রতিদিন বাংলাদেশের জনগণ রাজপথ, মাঠঘাট সব মুখর করে রেখেছিল। প্রতিদিন ‘বাংলাদেশ’ প্রস্ফুটিত হচ্ছে আর প্রতিদিন কোটি কোটি জনগণ তা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। এরকম এক উত্তাপ ছড়ানো পরিবেশে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ তার ভাষণ দিতে মঞ্চে ওঠেন।
‘মুজিব’ আরবি শব্দ। এর অর্থ উত্তর দেওয়া, জবাব দেওয়া। জাতির ওপর সেই সময় যত অন্যায় হয়েছিল, জাতির যত প্রশ্ন ছিল—সব প্রশ্নের উত্তর দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ভাষণে।
যারা ৭ মার্চের ভাষণের বিষয়বস্তু এবং পূর্বাপর ঘটনাবলি হিসেবে না নিয়ে ভাষণের মধ্যে খুঁত ধরার চেষ্টা করেন, তাদের উদ্দেশে আমি বলতে চাই যে, বঙ্গবন্ধু এই ভাষণে জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনে উঁচুমাত্রায় রণনীতি ও রণকৌশল প্রয়োগ করেন। শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনের মধ্যে স্বাধীনতার প্রশ্ন ফয়সালা করেন। কোন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু এই ভাষণ দিয়েছেন, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। আর এই ভাষণ শুধু ভাষণ নয়; পরের দিন ৮ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত কী ফলাফল করেছিল, তাও বিবেচনায় নিতে হবে। জাতীয় প্রেক্ষাপট কী ছিল? অতীতে চারটি বিজয় অর্জন হয়—’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়, ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ইয়াহিয়া খানের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা খারিজ ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি আর ’৭০ সালের মহানির্বাচনী বিজয়।
আবার এই চারটি বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তিনটি ষড়যন্ত্র পাকিস্তানিরা করেছিল। সামরিক হস্তক্ষেপে ’৫৪ সালের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া, ছয় দফাকে বানচাল করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা। ’৭০ সালের নির্বাচনী বিজয় বানচালের জন্য ১ মার্চ সংসদ অধিবেশন বাতিল করে দেওয়া। এ ছাড়া মাথার ওপর পাকিস্তানিদের পাকিস্তান ভাঙার অভিযোগ ছিল, বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ ছিল। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে তিল তিল করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নাগরিককে স্বাধীনতার লক্ষ্যে জাগিয়ে তুলেছিলেন। ৬৬-তে ছয় দফা উত্থাপন এবং স্বশাসনের পক্ষে গণরায় অর্জন ’৭০ সালে। এ ছাড়া ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুবের শাসনতন্ত্র বাতিল করে এক মাথা এক ভোট অর্জন করে তিনি গণপরিষদের ভোট আদায় করে নেন এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন নাকি স্বাধীনতার লক্ষ্যে উত্থিত জাতির কর্তৃত্বভার প্রকাশ্যে গ্রহণ করবেন—এই প্রশ্ন তার সামনে ছিল। এই ভাষণের আগেই স্বাধীনতার পতাকা উঠেছে, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়েছে, জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়েছে, বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে দেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়েছে, জয় বাংলা বাহিনী গঠন করা হয়েছে, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ চালু হয়েছে।
এই ভাষণ দেওয়ার সময় আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কী পরিস্থিতি ছিল—মনে রাখতে হবে সেসময় ’৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পরে তাসখন্দ শান্তিচুক্তি হয়েছিল। পাকিস্তান-ভারত-রাশিয়া শান্তির বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। পাকিস্তানিদের সঙ্গে কমনওয়েলথ দেশভুক্ত এবং কমনওয়েলথবহির্ভূত ইউরোপের সব দেশের সুসম্পর্ক ছিল এবং মার্কিনি ও চীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। আর ’৬৫ সালের যুদ্ধের পরে ভারত এবং চীনের বিরোধ ছিল, ভারত এবং রাশিয়ার কোনো চুক্তি ছিল না। সেসময়টা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার শীতল যুদ্ধের সময়।
এই প্রেক্ষাপটে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীনতার লক্ষ্যে রণনীতি ও রণকৌশল এই ভাষণ বঙ্গবন্ধু প্রয়োগ করেন। মঞ্চে যখন বঙ্গবন্ধু ওঠেন, ঠিক তখনকার অবস্থা কী ছিল? বিশাল জনসমুদ্র সামনে, হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠে জয় বাংলা ধ্বনি, চোখে মুক্তির আগুন। একদিকে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ আর অন্যদিকে স্বাধীনতা শব্দটা ধ্বনিত হচ্ছে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হৃদয়ে। এই প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার প্রশ্নটি কোনোভাবেই যাতে মার না খায়, তার জন্য ওই ভাষণের মধ্য দিয়েই অসহযোগের নামে ৮ মার্চ সকাল থেকে বাংলাদেশের কর্তৃত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রহণ করেন। প্রায় ৩০টির ওপর ফরমান দিয়ে দেশ পরিচালনা শুরু করেন। ২৩ মার্চ সারা দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওঠানো হয়। পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেওয়া হয়।
কার্যত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধীন শাসন শুরু হয় এবং এই স্বাধীন শাসনকে যেন কোনোভাবেই বানচাল করতে না পারে তার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের নির্দেশনাও তিনি ভাষণে পরিষ্কারভাবে দিয়েছেন। আমরা দেখি পাকিস্তানিদের চতুর্থ ষড়যন্ত্র। ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীন স্বশাসিত বাংলাদেশের ওপর আক্রমণ। বঙ্গবন্ধু কালবিলম্ব না করে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে স্বাধীন বাংলার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে দেন। স্বাধীন বাংলাদেশ সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
এখন পূর্বাপর এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভাষণ যদি মিলিয়ে দেখেন, তাহলে দেখবেন কী নিখুঁতভাবে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ সাজিয়েছেন, বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাসের কথা, পাকিস্তানের চক্রান্তের কথা। সুতরাং এ ভাষণের মধ্য দিয়ে আমরা ফলাফল যেটি দেখি, পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে কী অপূর্বভাবে তিনি স্বশাসন এবং স্বাধীনতা, গণআন্দোলন, নির্বাচন ও সশস্ত্র প্রস্তুতির সমন্বয় সাধন করেছেন। একটি ভাষণ একটি জাতিকে স্বাধীনতা দিতে কীভাবে দাঁড় করিয়ে দিল, ইউনেসকো সেজন্য এ স্বীকৃতি দিয়েছে। যারা ইতিহাস বিকৃতি করে, ইতিহাস পাথরচাপা দেয়, এই প্রস্তাব তাদের গালে সরাসরি চপেটাঘাত, থাপ্পড়।
জাতি একটি মহামানবের অপেক্ষায় ছিল। ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে সেই মহামানব, বঙ্গবন্ধুকে আমরা পেলাম। হ্যাঁ, সব অর্থেই তিনি বাংলাদেশ। তাই কবি বাবলু জোয়াদ্দার বলেছেন, ‘সে ছিল দিঘল পুরুষ। হাত বাড়ালেই ধরে ফেলতো ৫০ হাজার বর্গমাইল, সাড়ে ৭ কোটি হৃদয়, ধরে ফেলতো বৈশাখী মেঘ অনায়াসে।’
তাই আমরা বলি, বঙ্গবন্ধু শুধু একজন ব্যক্তি নন; বঙ্গবন্ধু হচ্ছে একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, রাজনীতির কবি, জনগণের বন্ধু, রাষ্ট্রের স্থপতি, স্বাধীনতার প্রতীক, ইতিহাসের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধু অমর ছিলেন, অমরই থাকবেন।
মার্চ মাস স্বাধীনতার মাস: ৭ মার্চের ভাষণ সেই স্বাধীনতার লক্ষ্যাভিমুখী পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পথে চালিত করার ছেদ রেখা টানার বলিষ্ঠতম ঘোষণা।
৭ মার্চের ভাষণ ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দুটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু একই হাতের এপিঠ-ওপিঠ। ৭ মার্চ হাতের এপিঠ দেখান এবং ২৫ মার্চের পর দেখান হাতের ওপিঠ। তাই ৭ মার্চ ভাষণ হলো স্বশাসনের মোড়কে স্বাধীনতা যেমন, ‘ছয় দফা ছিল ওপারে যাওয়ার সাঁকো’, তেমনি ২৬ মার্চ ঘোষণা হলো, ‘স্বশাসনের খোলস মুক্ত সোনালি আভায় মোড়া স্বাধীন বাংলাদেশে’র যাত্রা বিন্দু।
পাকিস্তানিদের শেষ ষড়যন্ত্র মার খেল। এবার ওদের হারের পালা শুরু হলো। অতীতের ’৫৪ সালের পর ওদের ষড়যন্ত্রে হোঁচট খেয়েছি, সময় পার হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্রে হোঁচট খেয়েছি, অনেক সময় পার হয়েছে। ’৭০ সালের নির্বাচনের পর তৃতীয় ষড়যন্ত্রে গণরায় ছিনতাই করা হলো। হোঁচট খায়নি। থমকে গেল কয়েক মুহূর্ত। তৃতীয় ষড়যন্ত্রের পর হোঁচট না খেয়ে মার্চ মাসেই তাৎক্ষণিক জাগরণ হলো। উদ্দীপ্ত হলো পুরো জাতি। ওদের নির্বাচনী রায় ছিনিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত প্রতিহত করে বঙ্গবন্ধু দেশ-জাতিকে এগিয়ে নিল। শুরু হলো চতুর্থ ষড়যন্ত্র। ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা ১৯৫৮ সালে আর্টেব সামরিক শাসন দিয়ে আটকে দিয়েছিল বাংলাদেশের স্বশাসনের অগ্রযাত্রাকে। ১০ বছর পেছনে পড়লাম।
এবার তা হওয়ার নয়।
তাই মার্চ মাস দুই চক্রান্ত—’৭০ সালের নির্বাচনের রায় কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত মোকাবিলা এবং বাংলাদেশের জাগরণ অব্যাহতি রাখা স্বশাসনের পথে স্বাধীনতার পথে এবং ‘অপারেশন সার্চলাইট’ মোকাবিলার মাস।
মার্চ মাস দুই চক্রান্ত মোকাবিলার পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণের জাগরণ ধরে রাখা, ছয় দফার বাস্তবায়নের পথে তথা স্বশাসনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। পাকিস্তানিরা যদি তা না মেনে বলপ্রয়োগে স্তব্ধ করে দিতে চায় ’৫৮ সালের মতো, সে ক্ষেত্রে তা অগ্রাহ্য করে স্বশাসনের পথে দেশকে নিয়ে যাওয়া তথা স্বাধীনতার পথে জনগণকে নিয়ে হাঁটা, এসবই যাতে ঘটে এক ভাষণে—৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু তা করেছেন।
জনগণ ও বাংলাদেশ আর হোঁচট খাবে না, পেছনে যাবে না, এমনকি থমকেও যাবে না। হয় ছয় দফা অক্ষরে অক্ষরে হবে, না হয় স্বাধীনতা, এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে জনগণকে প্রস্তুত করার ভাষণ ৭ মার্চ। বাধা দিলে বাধবে লড়াই, যা ছিল শুধু স্লোগান, তা সত্যি সত্যি বাস্তবে প্রয়োগ করার জন্য জনগণ প্রস্তুত হয়ে গেল। জান যাবে, রক্ত ঝরবে, তবু বাধা দিলে আর থমকে যাব না, এগোব যা আছে তাই দিয়ে। লাঠি হাতে শুরু লড়াইয়ের পথে পথে, পথ থেকে কুড়িয়ে নেব অস্ত্র, ফেলে রাখবে লাঠি। এরকম সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাস মার্চ মাস।
আর সর্বোচ্চ নেতা সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দেন। পাকিস্তান থেকে ছেদ টানার ঘোষণা দেন। অসহযোগ-স্বশাসনের মোড়কে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি বুঝল ৭ মার্চের ভাষণ। স্বশাসনের মোড়কে স্বাধীনতার ঘোষণা, এমনকি জিয়াউর রহমানও বুঝলেন ৭ মার্চ ভাষণ হচ্ছে স্বাধীনতার সবুজ সংকেত। এমনকি পাকিস্তানিরা-শত্রুরা, সারা বিশ্ব বুঝল স্বশাসনের মোড়কে স্বাধীনতার ঘোষণাই দিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই ৭ মার্চের পর সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতির কাজ আরও জোরেশোরে শুরু হলো। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, স্বাধীনতা-স্বশাসন এসবই একই হাতের এপিঠ-ওপিঠ। ৯ মাস যুদ্ধ। বিজয় এলো। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে এলেন। স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হলো। হেরে গেল পাকিস্তান, হেরে গেল জামায়াত, হেরে গেল গোলাম আযম, হেরে গেল আমেরিকা প্রশাসন। হেরে গেল মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবসহ কতিপয় দেশ। হেরে গেল চীনও। এ হার অনেকে মেনে নিল, কিন্তু মেনে নিল না পাকিস্তান, আমেরিকা প্রশাসন ও গোয়েন্দা শাখা সিআইএ।
১৯৭২ সালে ভারত-রাশিয়া-পাকিস্তান সিমলা শান্তি চুক্তি হলো। পাকিস্তানসহ ওআইসি অনেক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল। শত্রুতা ভুলে বন্ধুত্বের হাত ধরাধরির প্রক্রিয়া শুরু হলো। কিন্তু তার পরও ভেতরে ভেতরে এ হার মেনে নিল না সিআইএ ও পাকিস্তান।
ঘরের শত্রু না পেলে ওরা সফল হতো না। ইতিহাসের তৃতীয় মীর জাফর মোশতাককে পেয়ে গেল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। ক্ষমতার হাতবদল হলো। বাংলাদেশকে উল্টো পথে চালানোর অপচেষ্টার কান্ডারি হলেন জিয়া। সংবিধানকে উড়িয়ে দেওয়া হলো বন্দুকের নলের ধাক্কায়। খুনিদের মহিমান্বিত করা হলো। পদায়ন করা হলো রাষ্ট্রের বড় বড় পদে। ’৭১ সালের রাজাকারদের ভাগাড় থেকে আমদানি করা হলো। জেল থেকে সব রাজাকার-খুনির ৩৯ হাজার/১২ হাজার ৫০০ ছেড়ে দেওয়া হলো। মন্ত্রিপরিষদে বসানো হলো কুখ্যাত সব ’৭১ সালের জল্লাদ ও তার সহযোগীদের। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল আওয়ামী লীগ-জাসদ-সিপিবিসহ সব দলকে নির্যাতন করা হলো। কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হলো।
ইতিহাস ধামাচাপা পড়ল, বঙ্গবন্ধুকে নির্বাসনে পাঠানো হলো। বাংলাদেশের ইতিহাস যেন শুরুই হলো ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে। ওই রাজনৈতিক মোল্লারা ঘোষণা করল ১৫ আগস্ট নাজাত দিবস।
জিয়া মুক্তিযোদ্ধা, এটা সঠিক। কিন্তু জিয়ার সব কাজ মুক্তিযোদ্ধাদের ও চেতনার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশকে মহাবিভক্তির দিকে আবার ঠেলে দেন জিয়া, যা ’৭১ সালের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মীমাংসা করা হয়।
জিয়া মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে রাজাকারদের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবার পুনরুজ্জীবিত করেন এবং রাজাকারদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেন।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সাত মাসের মাথায় ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ, কীভাবে তা পালন করা হয়, তা হুবহু তুলে ধরব। কিন্তু তার আগে রাজনীতির মানচিত্রটা কেমন ছিল এর বিবরণ জানা দরকার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা সব কারাগারে, জাসদের শীর্ষ নেতারা কারাগারে। সিপিবিসহ সব প্রগতিশীল দলের নেতারা কারাগারে। তখন প্রকাশ্যে ছিল শুধু ’৭১ সালের পরাজিত সদ্য কারামুক্ত বিভিন্ন রঙের রাজনৈতিক মোল্লারা, যারা সবাই সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে ছিল ’৭১ সালের মহাযুদ্ধে। সভা-সমাবেশ-রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল।
সামরিক বাহিনীর শাসন তথা সামরিক শাসন ছিল। রাতে কারফিউ থাকত। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। সারা দেশে রাজনৈতিক কর্মীদের হয়রানি চলছিল। এরকম অবস্থায় জিয়া শাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। জিয়ার সঙ্গে ছিল বিমানবাহিনী প্রধান এম এ জি তোয়াব, নৌবাহিনী প্রধান ছিলেন অ্যাডমিরাল, রাষ্ট্রপতি হিসেবে পুতুল হয়ে বসে ছিলেন এককালের বিচারক বিচারপতি সায়েম।
এরকম পরিস্থিতিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মোল্লারা একটি ধর্মীয় সভার আয়োজন করে জিয়ার পরামর্শে। জেনারেল জিয়া নিজে না গিয়ে তোয়াবকে পাঠান এবং সেই ধর্মসভার প্রধান অতিথির পদ অলংকৃত করেন। সেই সভায় পাকিস্তান ও লিবিয়ার রাষ্ট্রদূতরা বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন। সেই সভায় সাঈদীও ছিল উপস্থাপক-প্রস্তাব পাঠক হিসেবে।
যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দরজাটা খুলে দিয়েছিলেন, সেই একই উদ্যানে জেনারেল জিয়া পাকিস্তানের আলখেল্লা পরে সাঈদীর কণ্ঠ দিয়ে বাংলাদেশ বদলে দিয়ে দ্বিতীয় পাকিস্তান ঘোষণার চরম ধৃষ্টতা দেখালেন। পাকিস্তানের প্রক্সি খেলোয়াড় তথা বদলি খেলোয়াড় হিসেবে বাংলাদেশের বুকের ওপরই পাকিস্তানের পক্ষে খেলা শুরু করল। এ তো বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা! মীর জাফর! এ তো স্বপক্ষ ত্যাগকারী বেইমান। মোশতাক যদি তৃতীয় মীর জাফর হয়, (পলাশীর প্রান্তরে বিশ্বাসঘাতকতা ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাঙালি হয়েও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেওয়ার বিশ্বাসঘাতকতার পরে) তবে জেনারেল জিয়া বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানানোর হোতা হিসেবে অবশ্যই বাংলাদেশের চতুর্থ বিশ্বাসঘাতক হিসেবে ইতিহাসের কলঙ্ক হয়ে থাকবেন।
বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের ইতিহাসে আমাদের সফলতা, বিজয়গাথা ও বীরদের যেমন সব সময় স্মরণ করব; তেমনি যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, যারা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার কলঙ্ক তাদের কথা, সেইসব ঘটনাও স্মরণে রাখতে হবে। তা না হলে চলার পথে আবার হোঁচট খেতে হবে। তাই ইতিহাসের নায়ক-মহানায়কদের যেমন আমরা সম্মানিত করব, তেমনি ইতিহাসের খলনায়কদের কলঙ্কগুলোও মনে রাখতে হবে। যারা খলনায়কদের নায়ক বানানোর চেষ্টা চালায় তারা কার্যত ইতিহাস বদলে দিতে চায়, বিকৃত করতে চায়। তাই আমি এই লেখাতে ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চের সিরাতুন্নবীর মোল্লা সমাবেশের ঘটনার কথা তুলে আনলাম। জেনারেল জিয়া আজ নেই, কিন্তু তিনি রেখে গেছেন রাজনীতির মাঠে পাকিস্তানিদের পক্ষে প্রক্সি খেলোয়াড়ের দল, বিষবৃক্ষ বিএনপিকে।
ইতিহাস দু-এক দিনের জন্য ধামাচাপা থাকে। তারপর বেরিয়ে আসে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর জিয়া ও সামরিক শাসকরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধামাচাপা বা বিকৃত করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তা আবার বেরিয়ে আসছে শেখ হাসিনার হাত ধরে।
পাকিস্তানের নির্যাতন-বৈষম্যের ইতিহাস ও ১৯৭১ সালের কলঙ্কজনক ঘটনারও ইতিহাস আছে। এ ইতিহাসও চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে। বিশেষ করে জামায়াত-রাজাকার গং। লাভ কী হলো, কলঙ্কের ঘটনা তো আর আড়াল থাকল না। ১৯৭১ সালে রাজাকাররা মানুষ খুন করে, নারী নির্যাতন করে ধর্মের নামে। ১৯৭৫ সালের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ওইসব নরপশু, ঘাতক, জামায়াত ও রাজাকারকে মহিমান্বিত করেন। এটাই সত্য ঘটনা। ১৯৭১ সালে সৈনিক জিয়া যুদ্ধ করেন, কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর জিয়া চেষ্টা করেছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার উপমহাদেশের পূর্বদিকে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানাতে।
সামরিক শাসক জিয়া রাজাকারদের পিতা ও অভিভাবক হন। রাজাকার তোষণ-পোষণকারী জিয়ার ইতিহাস আড়াল রাখার দরকার নেই। সবই প্রকাশ্যে থাকুক। জিয়া দরদিরা রাগ করবেন না। মিথ্যাচার নয়। তাই জিয়ার রাজাকারপ্রীতির স্বরূপ উদ্ঘাটনের জন্য ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাংলাদেশকে অস্বীকার করার মহাচক্রান্তের ঘটনার পুনরুল্লেখ করলাম। জেনারেল জিয়া দ্বিতীয় পাকিস্তান বানাতে ব্যর্থ হন। নিহত হন ১৯৮১ সালে, কিন্তু বাংলাদেশের একটি প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস থেকে বঞ্চিত করে জাতির সঙ্গে মহাপাপ করেছিলেন। জিয়া নেই, কিন্তু ওই অপচেষ্টা এখনো চলছে। রাজনৈতিক মোল্লারা, পাকিস্তানপন্থিরা ও তাদের দোসর বিএনপি হাল ছেড়ে দেয়নি। এখনো তারা বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানানোর চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে।
এই চক্রান্তকারীরা এখনো স্বাধীনতার ঘোষণা মানে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে মানে না। ৭ মার্চের ঘোষণা মানে না। ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যাও মানে না। সংবিধানের চার মূলনীতিও মানে না। ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের ঘটনাও মানে না। জামায়াত-জঙ্গি-রাজাকারদের সঙ্গে রাজনৈতিক পার্টনারশিপও ছাড়ে না। সেই পাকিস্তানপন্থার বিএনপি-জামায়াত চক্রের প্রতি দরদি লোক এখনো আছে। ওই ১৯৭১ সালের সময় কিছু লোকের পাকিস্তানপ্রীতি ছিল, তেমনি এখনো বিদ্যমান রয়েছে কিছু মানুষের মধ্যে বিএনপিপ্রীতি।
তারা প্রায় গণতন্ত্র, নির্বাচন ও সংসদের নামে, সংলাপের নামে মিটমাটের কথা বলে। আমি মনে করি আমাদের একটাই সিদ্ধান্ত হতে পারে, বঙ্গবন্ধু যে রকম ৭ মার্চ পাকিস্তানের মিটমাটের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বাংলাদেশকে বাংলাদেশের পথে চালিত করেছেন এবং স্বাধীনতা উপহার দিয়েছেন; ঠিক তেমনি বিএনপি এবং খালেদা জিয়ার সঙ্গে যারা পাকিস্তানের দালাল প্রক্সি খেলা খেলে তাদের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক মিটমাটের জায়গা নেই। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানকে বিদায় দিয়েছিলেন, আমাদের বিএনপি এবং খালেদা জিয়াকে বিদায় দিয়ে বাংলাদেশকে নিরাপদে, স্থায়ীভাবে বাংলাদেশের পথে চালিত করতে হবে। আর পেছনে যাওয়ার জায়গা নেই। সেজন্য বাংলাদেশে আর সামরিক সরকার না আর রাজাকার সমর্থিত সরকার না—তার গ্যারান্টি অর্জন করতে হবে। এর বিকল্প আর কিছু নেই। সেটা রাজনীতিবিদরা যতক্ষণ সিদ্ধান্ত নিতে না পারবেন, ততক্ষণ বাংলাদেশ ভূগর্তে থাকবে এবং আশঙ্কায় থাকবে। ততদিন একুশে আগস্টের মতো গ্রেনেড হামলার সম্ভাবনা থেকে যাবে। সেই জন্য আসুন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছিলেন আমাদের সেই বাংলাদেশ নিরাপদ করতে, বাংলাদেশের পথে চিরদিন রাখতে পাকিস্তানের প্রক্সি খেলোয়াড় বিএনপি-জামায়াত এবং খালেদা জিয়াকে বিদায় জানাই। রাজনীতির মাঠের বেইমানদের, মহাশত্রুদের শুধু ক্ষমতার বাইরে রাখলেই হয় না, দমন ও নিশ্চিহ্ন করে দিতে হয়—যাতে আর কোনোদিন ছোবল মারতে না পারে। সাপের শেষ রাখতে নেই।
লেখক: সাবেক মন্ত্রী ও সভাপতি
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)