আমাদের কৃষি ও সংস্কৃতি
আমরা বলি—কৃষিই কৃষ্টি। কৃষ্টি শব্দের অর্থ—কর্ষণ, লাঙ্গল চালনা, কৃষিকর্ম বা সংস্কৃতি। এ অঞ্চলের সংস্কৃতি মূলত কৃষিনির্ভর। অনেক আগে থেকেই এ অঞ্চলের মানুষ ফসলের খাতিরে বছরকে মাস ও ঋতুতে বিভক্ত করে এসেছে। পূর্ণিমার চাঁদ রাশিচক্রের যে নক্ষত্রে (যেমন বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ প্রভৃতি) দাঁড়িয়ে পূর্ণরূপে দেখা দিত, সে নক্ষত্রের নামানুসারে সে মাসের নাম হয়ে যায় বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ প্রভৃতি। জানা যায়, রাজা শশাঙ্কের আমলে বাংলা সনের ব্যবহার ছিল এবং সে সময় অগ্রহায়ণ মাসকে বছরের প্রথম মাস ধরা হতো। কারণ ‘হায়ণ’ অর্থ বছর, ‘অগ্র’ অর্থ প্রথম। হেমন্তের গোলা ভরা ধান আর নবান্নের উত্সবে মুখর মানুষ সে সময় অগ্রহায়ণে বাংলা নববর্ষের উৎসব করত।
চাঁদ, সূর্য ও নক্ষত্রের গতিবিধি, ঝড়-বৃষ্টি, শীত ও উষ্ণতার হ্রাস-বৃদ্ধি মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই লক্ষ করে এসেছে। আর বহুদিনের এই পর্যবেক্ষণকে প্রয়োগ করেছে কৃষিকাজে। ফসল ফলার প্রকৃতিগত পদ্ধতিকে মানুষ জেনেছে এক নির্দিষ্ট সময়ের প্রক্রিয়া। আমাদের দেশের বিচিত্র প্রকৃতির সঙ্গে বাংলা সন প্রবর্তনের সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রকৃতি অনুযায়ী এ দেশে ফসল ফলে। আর অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক হওয়ায় ফসল রোপণ ও সংগ্রহের মৌসুম অনুযায়ী বাংলা সনের প্রবর্তন হয়। এজন্য বাংলা সনের আর এক নাম ‘ফসলি সাল’।
সম্রাট আকবর প্রবর্তিত বাংলা সন তখনকার বৃহত বঙ্গ অর্থাৎ সুবে বাংলায় গৃহীত হয় এ দেশের আর্থ-সমাজ ব্যবস্থার চালিকাশক্তিরূপে। গ্রাম ও কৃষি-অর্থনীতিনির্ভর দেশের রাজস্ব আদায় হতো তখন ফসল থেকে। সুতরাং কর আদায়ের এমন একটা সময় নির্বাচন প্রয়োজন ছিল যখন সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়। অনেকের মতে রাজস্ব আদায়ের জন্য বৈশাখ ছিল অগ্রহায়ণের চেয়ে নানা দিক থেকে সুবিধাজনক। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে বাংলার নিম্নাঞ্চলের অনেক এলাকা জলমগ্ন অথবা কর্দমাক্ত থাকায় জমিদারের নায়েব গোমস্তাদের চলাচলের অসুবিধা হয় এবং সে সময় দিন ছোট থাকার কারণে দিনের মধ্যেই দূর অঞ্চলের কর আদায় করে তারা সেরেস্তায় ফিরে আসতে পারে না। সে কারণে চৈত্র-বৈশাখে বড় দিন এবং শুষ্ক পথ-ঘাট কর আদায়ের জন্য বিশেষ সুবিধাজনক ছিল।
ঐতিহ্যগতভাবেই বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে সবাই নিজ নিজ জমিতে চাষ দিত। সব জমিতে একদিনে চাষ দেওয়া সম্ভব নয় বলে বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে প্রত্যেক জমিতেই এক পাক কিংবা দুই পাক করে লাঙ্গল দিয়ে রাখা হতো। এই রীতির নাম ছিল ‘হাল বৈশাখ’। বর্তমানেও অনেক জায়গায় এই রীতি প্রচলিত রয়েছে। বৈশাখপূর্ব বাঙালির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আচার চৈত্রসংক্রান্তি। সংক্রান্তি মানে এক ক্রান্তি তথা এক কিনারা থেকে আরেক কিনারায় যাওয়া। চৈত্র মাসে চৈতালি ফসল উঠে গিয়ে পুরো মাঠই শুকনা খরখরে হয়ে যেতে পারে। এই সময় প্রকৃতিতে কী কী খাদ্য মানুষের এবং অন্য প্রাণীর জন্য থাকে তা জানা দরকার। তাই চৈত্রসংক্রান্তিতে প্রকৃতির খোঁজখবর নেওয়া হয়। চৈত্রসংক্রান্তির খাদ্য তালিকায় কোনো মাছ-মাংস থাকবে না, থাকবে চোদ্দো রকমের কুড়িয়ে পাওয়া শাক। যেমন হেলেঞ্চা, ঢেকি, সেঞ্চি, কচু, থানকুনি, তেলাকুচা, নটে, গিমা, খারকোন, বতুয়া, দণ্ডকলস, নুনিয়া, শুশ্নি, হাগড়া, পাট, সাজনা ইত্যাদি। এইসব শাক কুড়াতে মেয়েরা এক-দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন। এই দূরত্বের মধ্যে অন্তত চোদ্দো রকমের শাক পাওয়া গেলে ধরে নেওয়া হয় প্রকৃতি ও পরিবেশ ভালো আছে।
পরিবেশ-প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি প্রাগৈতিহাসিক। আগে মানুষ বিশ্বাস করত প্রকৃতির মধ্যে অতি-ভৌতিক, জীবনধাত্রী এবং জীবনধারণ করার মতো সমস্ত শর্ত বিদ্যমান। এজন্য প্রাগৈতিহাসিক সময়ের মানুষ প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখাত, প্রকৃতির জন্য প্রার্থনা করত। প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধামিশ্রিত চেতনা ছিল বলেই মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সহমর্মিতার সম্পর্ক দৃঢ় ছিল। কৃষির উৎপাদন পদ্ধতি এবং মানুষের জীবিকার উৎসকে কেন্দ্র করে যেসব আচার-অনুষ্ঠান সমাজে গড়ে উঠেছিল সেসব উৎসব নানা কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। যদি আমরা আবার স্থায়িত্বশীল কৃষিব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারি, তাহলে কৃষির মাধ্যমে মানুষ ও প্রকৃতি-পরিবেশের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। যে কৃষি ও প্রকৃতি মানুষের প্রাণ বাঁচায়, সেই কৃষি ও প্রকৃতি যদি বাঁচে তবে তার সঙ্গে জীবনের উত্সবসমূহও বাঁচবে।
চেয়ারম্যান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা