নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে যেসব জানা জরুরি
নিপাহ ভাইরাস হলো বাদুড়ের মাধ্যমে সংক্রমিত একটি প্রাণিবাহিত ভাইরাস, যার সংক্রমণের ফলে মৃত্যুহার অনেক হয়ে থাকে (৪০-৭০ শতাংশ)। সাধারণত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব আফ্রিকায় এ রোগের প্রকোপ দেখা যায়। এটি হেনিপা ভাইরাসের অন্তর্গত একটি আরএনএ ভাইরাস। সংক্রমিত বাদুড়ের লালা ও মূত্রে ভাইরাসটি পাওয়া যায়। মানবদেহ ও শূকরের দেহে ভাইরাসটির সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সময় এটি মানবদেহে অ্যানসেফালাইটিস (মস্তিষ্কের প্রদাহ)-এর পাশাপাশি শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এবং শূকরের দেহে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ঘটানোর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
* সংক্রমণের ইতিহাস
সর্বপ্রথম ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায়, শূকরের খামার থেকে মানবদেহে ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে, যাতে ২৬৫ জন আক্রান্ত হয় এবং ১০৮ জন মৃত্যুবরণ করে, কিন্তু সংক্রমণটি তখন ‘অজ্ঞাত রোগ’ হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছিল। পরে ১৯৯৯ সালে ভাইরাসটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়। পোর্ট ডিক্সন, নেগেরি সেম্বিলানের ‘সুঙ্গাই নিপাহ’ (নিপাহ নদী) থেকে ভাইরাসটির নামকরণ করা হয়েছে, যেখানে প্রথম মানবদেহে ভাইরাসটি আবিষ্কৃত হয়। ইবোলা ভাইরাসের পাশাপাশি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে নিপাহ ভাইরাসটিকে ভবিষ্যৎ মহামারির সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। প্রথমে এ ভাইরাসের সংক্রমণকে ‘জাপানিজ অ্যানসেফালাইটিস’ রোগ মনে করা হলেও পরবর্তীতে দেখা যায়, জাপানিজ অ্যানসেফালাইটিস টিকা প্রাপ্ত পূর্ণ বয়স্ক মানুষেরাও এ সংক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় প্রাপ্ত বাদুড়ের দুইটি প্রজাতি Pteropus vampyrus এবং Pteropus hypomelanus, যা সাধারণভাবে “Pteropid Fruit Bat” নামে পরিচিত, এ ভাইরাসের বাহক হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। বাদুড়ের প্রস্রাব, পায়খানা আর লালার মাধ্যমে ভাইরাসটি বংশবিস্তার করে এবং সংক্রমণ ঘটায়।
* বাংলাদেশ পরিস্থিতি
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় নিপাহ ভাইরাসের রোগী পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ২০০৩, ২০০৪ এবং ২০০৫ সালে নওগাঁ, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় রোগটির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ২০২৩ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে, ১১টি সংক্রমণের ঘটনায় ৮ জনের মৃত্যু ঘটে। ২০১৫ সালের পর এটিই বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসের সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ড। আক্রান্ত ১১ জনের মধ্যে ১০ জনেরই শীতকালে কাঁচা খেজুরের রস পানের ইতিহাস রয়েছে।
* সংক্রমণের বিস্তার
প্রধানত, প্রাণিবাহিত আক্রান্ত বাদুড় আর শূকরের দেহ থেকে মানবদেহে বিস্তার লাভ করে। এছাড়াও অসুস্থ ব্যক্তির শরীর থেকে সুস্থ ব্যক্তির শরীরে রক্ত, প্রস্রাব আর সর্দির মাধ্যমে সংক্রমণ বিস্তার লাভ করতে পারে।
* যারা ঝুঁকিতে
▶ হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী
▶ আক্রান্ত শূকরের খামারি
▶ সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা সুস্থ ব্যক্তি
▶ যারা শীতকালে কাঁচা খেজুরের রস পান করে
▶ যারা বাদুড়ের আংশিক খাওয়া ফল খায়, যাতে বাদুড়ের লালা মিশ্রিত থাকে
▶ যারা বাদুড়ের বাস করা কূয়ার পানি পান বা ব্যবহার করে।
* সুপ্তাবস্থা
৪-১৪ দিন, তবে সর্বোচ্চ ৪৫ দিন পর্যন্ত হতে পারে। (সুপ্তাবস্থা হলো, কোনো রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায় থেকে রোগের লক্ষণ প্রকাশের মধ্যবর্তী সময়কাল)।
* লক্ষণ
জ্বর, মাথাব্যথা, কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, গায়ে ব্যথা, বমি, আচ্ছন্নতা, ঝিমুনি ভাব, সংজ্ঞাহীনতা, নিউমোনিয়া, অ্যানসেফালাইটিস (মস্তিষ্কের প্রদাহ), কোমা।
* রোগ নির্ণয়
▶ গলার সোয়াব, রক্ত, সিএসএফ ও প্রস্রাবের RT-PCR পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাস শনাক্তকরণ।
▶ রক্তের ওমে আর IgM পরীক্ষা।
▶ মৃত ব্যক্তির নির্দিষ্ট টিস্যুর অটোপ্সির মাধ্যমে Immunohistochemistry পরীক্ষা।
* প্রতিরোধ
▶ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
▶ আক্রান্ত মানুষ, বাদুড় ও শূকরের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
▶ শীতকাল বা অন্য যেকোনো সময়ে কাঁচা খেজুরের রস পান না করা।
▶ হিমায়িত খেজুরের রস পান না করা।
▶ বাদুড়ের আংশিক খাওয়া বা কামড়ানো ফল না খাওয়া।
▶ বাদুড়ের বসবাসকৃত কূয়ার পানি ব্যবহার না করা।
* চিকিৎসা
সুনির্দিষ্ট ও কার্যকরী কোনো ওষুধ বা টিকা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অবলম্বনই সর্বোত্তম পন্থা।
* জটিলতা
সুস্থ হওয়ার পরও রোগীদের বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে; যেমন-স্মৃতিভ্রংশতা, কাজে অমনোযোগিতা, মৃগী রোগ, খিঁচুনি ও ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন।
* মৃত্যু ঝুঁকি
আক্রান্ত রোগীদের ৪০-৭০ শতাংশ মৃত্যু বরণ করে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যা ১০০ শতাংশ। নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা না থাকায় এ ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি ও তা বৃদ্ধির মাধ্যমে মৃত্যুঝুঁকি রোধের জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক (এপিডেমিওলজি), আইইডিসিআর, ঢাকা।